নয় বছরের শিশু রুবেলের চার-পাঁচ দিন ধরে ঠান্ডা-কাশি, সঙ্গে যুক্ত হয়েছে শ্বাসকষ্ট; শনিবার মা হালিমা আক্তার তাকে নিয়ে যান বাংলাদেশ শিশু হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউটে।
টিকেট কাউন্টারের সামনে কথা হল মোহাম্মদপুরের বাসিন্দা হালিমা আক্তারের সঙ্গে। তিনি বলেন, 'ছেলেটা সাত-সকালে স্কুলে যায়, তখন ঠান্ডা বাতাস কানে লাগে। এজন্য ঠান্ডা লেগে গেছে। কানে টুপিও পরতে চায় না।'
হাসপাতালটিতে চিকিৎসকের জন্য অপেক্ষায় ছিলেন বনশ্রীর শায়লা রহমান। তার আড়াই বছরের মেয়ে লাবনী তিন দিন ধরে ভুগছে ঠান্ডা-জ্বরে। শায়লা বলেন, 'ঠান্ডায় ওর দুটো নাকই বন্ধ হয়ে আছে। ১০০/১০১ ডিগ্রি এমন জ্বরও আছে। খাওয়া-দাওয়া করছে না একদম, সারা দিন কান্নাকাটি করে।'
রুবেল ও লাবনীর মত অনেক শিশুকেই শনিবার দেখা গেল শিশু হাসপাতাল ইনস্টিটিউটে। বেশির ভাগই এসেছে ঠান্ডাজনিত সমস্যা নিয়ে। এসব শিশুর অভিভাবকরা বলছেন, শীতের শুরু থেকেই তাদের ঠান্ডাজনিত সমস্যা কমবেশি লেগেই আছে। তিন-চার দিন ধরে ঢাকায় শীত জেঁকে বসায় সেই সমস্যা আরও বেড়েছে।
এমন অবস্থায় শীতের সময়টাতে শিশুদের সুস্থ রাখতে ঠান্ডা বাতাস ও ধুলোবালি এড়িয়ে চলার পরামর্শ দিচ্ছেন হাসপাতালটির চিকিৎসকরা। বাইরে যেতে মাথা ঢেকে রাখার পাশাপাশি মাস্ক পরার কথা বলছেন তারা।
শনিবার শিশু হাসপাতালে দুই বছরের সন্তানকে নিয়ে এসেছিলেন মালিহা কেয়া, থাকেন পুরান ঢাকায়। তিনি বললেন, 'বাচ্চাটার অনেক ঠান্ডা লাগছে, কোনোভাবেই সারছে না। ডাক্তার দেখাইলাম। রক্ত পরীক্ষা, বুকের এক্সরে দিছে, দেখি রিপোর্টে কী আসে।'
শিশু হাসপাতালের জরুরি বিভাগের সামনে শিশুকে কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন টিপু আহমেদ। এক সপ্তাহ ধরে তার সন্তানের ঠান্ডা ও কাশি হওয়ার কথা জানিয়ে তিনি বলেন, 'হাঁচি, কাশি চলতেই আছে। বুকে গড়গড় শব্দ হয় খালি। ভাবছিলাম আস্তে আস্তে হয়ত ঠিক হয়ে যাবে, না পেরে হাসপাতালে নিয়ে আসলাম। নিউমোনিয়া হয়ে গেছে কি না, চিন্তা হচ্ছে। দেখি ডাক্তার কী বলে।'
তবে ঢাকায় তিন দিন পর শনিবার কুয়াশার চাদর সরিয়ে সূর্যের দেখা মিলেছে। এদিন রাজধানীতে সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ছিল ১৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস। আবহাওয়া অধিদপ্তর বলছে, আগামী কয়েকদিন শীতের অনুভূতি কমে আসতে পারে। তবে শীত থাকবে মাসজুড়েই।
নতুন বছরের শুরুতে তীব্র শীতের সঙ্গে পালস্না দিয়ে বাড়ছে বায়ুদূষণের মাত্রাও। আন্তর্জাতিক বায়ুমান প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান আইকিউএয়ারের পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী এই শীতে ঢাকার বাতাস 'অস্বাস্থ্যকর থেকে ঝুঁকিপূর্ণ' পর্যায়ে থাকছে।
শনিবার বিকাল ৪টায় ঢাকার বাতাসের একিউআই ছিল ১৮২; এ মানকে 'অস্বাস্থ্যকর' বলা হয়। বাংলাদেশের পরিবেশ অধিদপ্তরের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত দৈনিক বায়ুমান সূচক অনুযায়ী, গত কয়েকদিন ঢাকার বাতাস 'খুবই অস্বাস্থ্যকর' ছিল।
ধুলোবালি আর শীতে শিশুরা ঠান্ডাজনিত রোগে ভুগলেও অনেকে আবার ঘরোয়াভাবেই চিকিৎসা নিচ্ছেন। মিরপুরের ১২ নম্বর এলাকার শাকিল আহমেদ বলেন, শীতের শুরুতেই তার দুই ছেলের ঠান্ডাসর্দি লেগে যায়। মাঝে বিরতি দিয়ে আবার শুরু হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, 'সবসময়ই শীত আসলে ওদের ঠান্ডা লাগে। নিয়মিত নেবুলাইজিং করাচ্ছি, গরম পানি খাওয়াচ্ছি, যাতে বাতাস না লাগে ওই রকমভাবে বাইরে বের হতে দিচ্ছি। এমনি ঠিক হয়ে যাবে, তাই আর ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাইনি।'
শিশু হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. মাহবুবুল আলম বলেন, হাসপাতালটিতে মোট রোগীর সংখ্যা কমলেও বর্তমানে বেড়েছে ঠান্ডাজনিত রোগী। গত ডিসেম্বর থেকেই এমন রোগী আসছেন বলে জানান তিনি।
শীতের রোগবালাই থেকে সুরক্ষার ব্যাপারে এই চিকিৎসক বলেন, 'ঠান্ডার সময় তো ঠান্ডা লাগবেই। শীতের সময় ধুলাবালি উড়ে বেশি। ধুলা আর ঠান্ডা মিলে শ্বাসকষ্ট উঠে যায়। ছোট শিশুদের বাইরে বের করা যাবে না। বের হলেও মাথা ঢেকে দিতে হবে, মাস্ক পরবে। ঠান্ডা কাটিয়ে নিয়ে নরমাল পানি খাওয়াতে হবে, আর উষ্ণ পানিতে গোসল করাতে হবে।'
আইসিডিডিআর,বি-তে ৮০ শতাংশই শিশু
এদিকে, শীত তীব্র হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বেড়েছে ডায়রিয়া রোগের প্রকোপ। রাজধানীতে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হচ্ছে শিশুরা। আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশ (আইসিডিডিআর,বি) হাসপাতালে প্রতিদিনই ভর্তি হচ্ছে ছয়শ থেকে সাতশোর মতো শিশু। এমন অবস্থা যে হাসপাতালের সামনে তাঁবু গেড়ে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে ডায়রিয়া আক্রান্তদের।
মহাখালীর হাসপাতালটিতে গিয়ে দেখা যায়, প্রধান গেটের পরই বড় করে টানানো হয়েছে তাবু। যদিও এখনো সেখানে বেড করার প্রয়োজন পড়েনি। হাসপাতালের প্রধান ভবনের শুরুতেই নার্সরা এন্ট্রি নিচ্ছেন এবং চিকিৎসকরা রোগীদের দেখভাল করছেন। এই দুই বুথে ভিড় লেগেই আছে সারাদিন। এর ভেতরেই ইমার্জেন্সি ওয়ার্ডে চিকিৎসা নিচ্ছেন ডায়রিয়া আক্রান্ত শিশু ও বয়স্করা। আর আউটপেশেন্ট ডিপার্টমেন্ট (ওপিডি) এ শিশুদের খাওয়ানো হচ্ছে স্যালাইন।
ভেতরে গিয়ে দেখা যায়, ইমার্জেন্সি রুমের বেডে তিন বছরের শিশু মুসাকে নিয়ে শুয়ে আছেন তার বাবা মো. বিপস্নব হোসেন। তারা এসেছেন কেরানিগঞ্জ থেকে। দুদিন ধরে ছেলের মাঝে মাঝে পাতলা পায়খানা হচ্ছিল। শুক্রবার অনেক বেশি বেড়ে যায়, সঙ্গে জ্বরও আসে। এজন্য রাতেই তাকে নিয়ে আইসিডিডিআর, বিতে ছুটে আসেন তিনি।
পাশের আরেকটি বেডে ছেলে মো. ইউসুফ আলীকে কোলে নিয়ে বসে আছেন মা শারমিন আক্তার। তারা এসেছেন জামালপুর থেকে। ছেলে ইউসুফ আলীর বয়স ১১ মাস। প্রায় ছয় দিন ধরে পাতলা পায়খানা ইউসুফের। জামালপুরে চিকিৎসক দেখানো হলেও লাভ হয়নি। তাই ঢাকায় নিয়ে এসেছেন। চিকিৎসকরা বলেছেন, তাকে স্যালাইন খাওয়াতে।
হাসপাতালে আগত শিশুদের ইমার্জেন্সি ওয়ার্ডে নিয়ে গুরুতর না হলে কিছু সময় চিকিৎসা ও স্যালাইন খাইয়ে ও পরামর্শ মোতাবেক ছুটি দিয়ে দেওয়া হচ্ছে।
আইসিডিডিআর,বির তথ্য বলছে, শনিবার সকাল থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত ২৬৭ জন ডায়রিয়া রোগী হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে এসেছেন। অন্যদিকে, শুক্রবার ৬৪৮ জন ডায়রিয়া আক্রান্ত রোগী হাসপাতালে আসেন। ২০২৫ সালের প্রথম দিন ১ জানুয়ারি চিকিৎসা নেন ৮৫০ জন।
আইসিডিডিআর,বির তথ্য বলছে, শনিবার সকাল থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত ২৬৭ জন ডায়রিয়া রোগী হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসেন। অন্যদিকে, শুক্রবার (৩ জানুয়ারি) ৬৪৮ জন ডায়রিয়া আক্রান্ত রোগী চিকিৎসা নেন। ২০২৫ সালের প্রথম দিন, ১ জানুয়ারি চিকিৎসা নেন ৮৫০ জন। চিকিৎসা নিতে আসা রোগীদের ৮০ শতাংশই শিশু।
এর আগে ২০২৪ সালের ২৮ ডিসেম্বর এ হাসপাতালে চিকিৎসা নেন ৮৯১ জন, ২৯ ডিসেম্বর ৮২৬ জন, ৩০ ডিসেম্বর ৯১৩ জন, ৩১ ডিসেম্বর ৮৮৪ জন।
হাসপাতালের তথ্য অনুযায়ী, গত দুই মাসে গড়ে ৭০০ থেকে ৮০০ রোগী আইসিডিডিআর,বি হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন। ২৪ সালের নভেম্বর-ডিসেম্বরে গড়ে ৮৫০ থেকে ৯০০ রোগী চিকিৎসা নিয়েছেন। হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীদের ৮০ শতাংশই শিশু।
আইসিডিডিআর,বির জ্যেষ্ঠ কমিউনিকেশন ম্যানেজার এ কে এম তারিফুল ইসলাম খান বলেন, প্রতিবছর শীত এলেই ডায়রিয়া রোগে আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ে। বিশেষ করে নভেম্বর, ডিসেম্বর, জানুয়ারি ও ফেব্রম্নয়ারি এই চার মাস রোটাভাইরাসের প্রভাব বেশি থাকে।
তিনি আরও বলেন, আইসিডিডিআর,বিতে ভর্তি ৫০তম রোগীর টয়লেট পরীক্ষা করে দেখা হয়- ডায়রিয়ার কারণ ভাইরাস নাকি ব্যাকটেরিয়াজনিত। পরীক্ষায় দেখা গেছে, বর্তমান সময়ে ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ রোগীর ডায়রিয়া হচ্ছে রোটাভাইরাসের কারণে। বাকি ৫০ শতাংশ অন্য ভাইরাস কিংবা ব্যাকটেরিয়ার কারণে।
আইসিডিডিআর,বির বিজ্ঞানী ডা. লুবাবা শাহরিন বলেন, গরম ও শীতকালের ডায়রিয়া ভিন্ন কারণে হয়ে থাকে। এই শীতকালে যে ডায়রিয়া হচ্ছে তার বড় কারণ ভাইরাল ইনফেকশন। আমরা এখানে আগত রোগীদের স্টুল টেস্ট করে দেখেছি বর্তমানে সবচেয়ে বেশি ডায়রিয়া হচ্ছে রোটাভাইরাসের কারণে। প্রতিবছর শীতকালে ডায়রিয়া রোগী আসে। তবে এ বছর আমরা এর পরিমাণ একটি বেশি পাচ্ছি। গত দুই সপ্তাহে এখানে ৮০০ থেকে ৯০০ এর মতো রোগীকে আমরা চিকিৎসা দিয়েছি। আর আসা রোগীদের মাঝে ৮০ শতাংশই ছিল পাঁচ বছরের নিচের বয়সী শিশু। এতে আমরা ধারণা করছি এই ভাইরাল ইনফেকশনে শিশুরা বেশি আক্রান্ত হচ্ছে।