সুইজারল্যান্ডের দাভোসে বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের বার্ষিক সভায় যোগদান শেষে দেশে ফিরেছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। শনিবার বিকালে তাকে বহনকারী ফ্লাইটটি হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণ করে। এর আগে শুক্রবার রাতে (সুইজারল্যান্ড সময়) জুরিখ আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা দেন তিনি।
চার দিনের এই ব্যস্ত সফরে প্রধান উপদেষ্টা বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের বার্ষিক সভার পাশাপাশি ৪৭টি অনুষ্ঠান ও বৈঠকে অংশ নেন। প্রধান উপদেষ্টা সর্বশেষ বৈঠক করেন বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডবিস্নউটিও) মহাপরিচালক ড. এনগোজি ওকোনজো-ইওয়েলার সঙ্গে। শুক্রবার এই বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে বাংলাদেশকে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উত্তরণে সহায়তা করার কথা জানান ডবিস্নউটিও মহাপরিচালক। পাশাপাশি তিনি শীর্ষস্থানীয় ব্যবসা প্রতিষ্ঠানকে বাংলাদেশে সরবরাহ কাঠামো স্থানান্তরের জন্য উৎসাহিত করবেন বলেও উলেস্নখ করেন।
বৈঠকে বাংলাদেশের আসন্ন এলডিসি উত্তরণ প্রসঙ্গ উলেস্নখ করে ড. এনগোজি বলেন, 'ডবিস্নউটিও এই প্রক্রিয়া 'মসৃণ' করায় বিষয়টি নিশ্চিত করবে।'
অধ্যাপক ইউনূসের উদ্দেশে তিনি বলেন, 'আমরা কিছু নীতি কাঠামো করবো এবং আপনাদের সঙ্গে কাজ করব। বৈশ্বিক শীর্ষস্থানীয় তিন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আলোচনা হয়েছে এবং বৈশ্বিক লজিস্টিক বিকেন্দ্রীকরণের অংশ হিসেবে তাদের সরবরাহ কাঠামো বাংলাদেশে স্থানান্তরে উৎসাহিত করতে চেষ্টা করা হবে।'
প্রধান উপদেষ্টা ড. এনগোজির নেতৃত্বের প্রশংসা করে বলেন, 'বৈশ্বিক বাণিজ্য আলোচনায় তিনি নতুন গতিশীলতা এনেছেন। দুর্নীতি ও স্বৈরশাসকের ঘনিষ্ঠ অলিগার্ক ব্যবসায়ীদের কারণে বাংলাদেশের অর্থনীতি যে ধ্বংস হয়েছিল, তার থেকে বেরিয়ে এখন ব্যবসার জন্য উন্মুক্ত।'
অন্তর্বর্তীকালীন সরকার অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার এনেছে এবং বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণে চট্টগ্রাম বন্দরের সেবা সহজ করা হয়েছে উলেস্নখ করে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, 'আন্তর্জাতিক সব চুক্তির সঙ্গে তৎকালীন ক্ষমতাসীন পরিবারের ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিবর্গ যুক্ত ছিলেন। আমরা দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই শুরু করেছি।'
ড. এনগোজি বলেন, 'জুলাই বিপস্নবে অংশ নেওয়া তরুণ বিক্ষোভকারীদের চেতনায় আমি মুগ্ধ। তারা সবচেয়ে শক্তিশালী বার্তাগুলো পাঠিয়ে এক অভূতপূর্ব উদাহরণ স্থাপন করেছে।'
দেশের স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনার ক্ষেত্রে অধ্যাপক ইউনূসের নেতৃত্বের প্রশংসা করে তিনি আরো বলেন, 'আপনি স্থিতিশীলতার এক প্রতিমূর্তি। আপনার নেতৃত্বে বাংলাদেশে স্থিতিশীলতা ও শান্তি ফিরে এসেছে।'
বৈঠকে ড. এনগোজি বাংলাদেশকে মৎস্য ভর্তুকি চুক্তি অনুমোদনের আহ্বান জানান। এর জবাবে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, বাংলাদেশ বিষয়টি পর্যালোচনা করে দেখবে।
বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের এসডিজি বিষয়ক মুখ্য সমন্বয়ক লামিয়া মোরশেদ উপস্থিত ছিলেন।
চার দিনে ৪৭টি অনুষ্ঠান ও বৈঠকে অংশগ্রহণ
সূত্র জানায়, বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের বার্ষিক সভার পাশাপাশি চার দিনে প্রায় ৪৭টি অনুষ্ঠান ও বৈঠকে অংশ নিয়ে সুইজারল্যান্ডের দাভোস সফরের সমাপ্তি টানেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। তার উপ-প্রেস সচিব আবুল কালাম আজাদকে উদ্ধৃত করে বাসস লিখেছে, 'প্রধান উপদেষ্টা ডবিস্নউইএফ চলাকালীন খুব ব্যস্ত দিন কাটিয়েছেন এবং তিনি বেশ কয়েকজন সরকারপ্রধান, রাষ্ট্রপ্রধান এবং বিশিষ্ট ব্যক্তিদের সাথে বৈঠকে যোগ দিয়েছেন।'
বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের বার্ষিক সভার ফাঁকে ফাঁকে চারজন সরকারপ্রধান বা রাষ্ট্রপ্রধান, চারজন মন্ত্রী পর্যায়ের ব্যক্তি, জাতিসংঘ এবং সম পর্যায়ের সংস্থার ১০ জন প্রধান বা শীর্ষ নির্বাহী, ১০ জন সিইও/উচ্চ পর্যায়ের ব্যবসায়ী, নয়টি অনুষ্ঠান (আনুষ্ঠানিক নৈশভোজ এবং মধ্যাহ্নভোজসহ), আটটি মিডিয়া ইভেন্ট এবং আরও দুটি অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছেন অধ্যাপক ইউনূস।
বাসস লিখেছে, '২১ জানুয়ারি দাভোসে পৌঁছানোর পর থেকে ব্যস্ততার মধ্য দিয়ে দিনগুলো কাটিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা। সফরের প্রথম দিন তিনি সাতটি অনুষ্ঠানে যোগ দেন এবং শীর্ষ সম্মেলনের ফাঁকে জার্মান চ্যান্সেলর ওলাফ শলৎসের সঙ্গে বৈঠক করেন। পূর্ব তিমুরের প্রেসিডেন্ট হোসে রামোস-হোর্তা, মিউনিখ সুরক্ষা সম্মেলনের চেয়ারম্যান রাষ্ট্রদূত ক্রিস্টোফ হিউসজেন, থাই প্রধানমন্ত্রী পায়োংটার্ন সিনাওয়াত্রা, মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিম, জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক হাইকমিশনার ফিলিপ্পো গ্র্যান্ডি এবং ফিনল্যান্ডের প্রেসিডেন্ট আলেকজান্ডার স্টাবের সাথেও সাক্ষাৎ করেন ইউনূস।
সফরের দ্বিতীয় দিন প্রায় ১৪টি অনুষ্ঠান এবং অনেক পার্শ্ব ইভেন্টে যোগ দেন তিনি। জার্মানির ফেডারেল চ্যান্সেলারির প্রধান এবং বিশেষ কার্যনির্বাহী মন্ত্রী উলফগ্যাং শ্মিট; বেলজিয়ামের রাজা ফিলিপ; থাইল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী পায়োংটার্ন সিনাওয়াত্রা; সুইজারল্যান্ডের ফেডারেল পররাষ্ট্র বিভাগের ফেডারেল কাউন্সিলর ইগনাজিও ক্যাসিস; সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাই সংস্কৃতি ও শিল্প কর্তৃপক্ষের চেয়ারপারসন শেখা লতিফা বিনতে মোহাম্মদ বিন রশিদ আল মাকতুম; জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস; কঙ্গোর প্রেসিডেন্ট ফেলিক্স শিসেকেদি; জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক প্রাক্তন মার্কিন বিশেষ দূত জন কেরি; প্রাক্তন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী টনি বেস্নয়ার; এবং জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাই কমিশনার ফোলকার টুর্কসহ অন্যদের সঙ্গে ডবিস্নউইএফ-এ বৈঠক করেন প্রধান উপদেষ্টা।
তিনি সম্মেলনের সময় 'জলবায়ু ও প্রকৃতির অবস্থা' শীর্ষক একটি পূর্ণাঙ্গ অধিবেশনে বক্তব্য দেন এবং ডাভোসের একটি হোটেলে সামাজিক উদ্যোক্তাদের জন্য শোয়াব ফাউন্ডেশনের একটি অনুষ্ঠানে যোগ দেন।
২৩ জানুয়ারি ইউনূস ১৪টি নির্ধারিত অনুষ্ঠান এবং অনেক পার্শ্ব কর্মসূচিতে যোগ দেন। তিনি মেটা পস্ন্যাটফর্মস ইনকর্পোরেটেডের গেস্নাবাল অ্যাফেয়ার্সের প্রেসিডেন্ট স্যার নিক ক্লেগ; সংযুক্ত আরব আমিরাত-ভিত্তিক গেস্নাবাল লজিস্টিকস প্রোভাইডার ডিপি ওয়ার্ল্ডের গ্রম্নপ চেয়ারম্যান এবং প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সুলতান আহমেদ বিন সুলায়েম; অধিকার গোষ্ঠী অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের মহাসচিব অ্যাগনেস ক্যালামার্ড; ডেনিশ শিপিং এবং লজিস্টিকস কোম্পানি এপি মোলার-মায়ার্সে্কর চেয়ারম্যান রবার্ট মারস্ক উগলা; এবং বিশ্বব্যাংকের অপারেশনস বিভাগের এমডি আনা বিজের্ডের সাথে বৈঠক করেন।
প্রধান উপদেষ্টা ডবিস্নউইএফ শীর্ষ সম্মেলনে ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের প্রতিষ্ঠাতা ক্লাউস শোয়াব আয়োজিত একান্ত বৈঠকে যোগ দেন এবং বৈঠকের ফাঁকে ডাভোসের ক্লাইমেট হাবে একটি অনুষ্ঠানে বক্তৃতা দেন।
সফরের শেষ দিন শুক্রবার প্রধান উপদেষ্টা সাতটিরও বেশি অনুষ্ঠানে যোগ দেন। সম্মেলনের ফাঁকে মার্কিন বিনিয়োগকারী রে ডালিও, মারিনো ম্যানেজমেন্ট এবং ডালিও ফ্যামিলি অফিসের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যাপক ইউনূসের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। এছাড়া জেনেল গ্রম্নপের (রেড সি গেটওয়ে টার্মিনাল কোম্পানি) নির্বাহী কমিটির চেয়ারম্যান আমের আলীরেজা দেখা করেন প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে।