জুলাই গণ-অভু্যত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া ছাত্রনেতাদের নতুন রাজনৈতিক দলের আত্মপ্রকাশ আজ। আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করা হচ্ছে নতুন এই দলের নাম, নেতৃত্ব ও কমিটি। জুলাই গণ-অভু্যত্থানে সামনের সারিতে থাকা ছাত্রনেতারাই নতুন রাজনৈতিক দলের শীর্ষ পদগুলোয় আসছেন।
জাতীয় নাগরিক কমিটি ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের উদ্যোগে গঠিত নতুন রাজনৈতিক দলটির নাম 'জাতীয় নাগরিক পার্টি' নির্ধারণ করা হয়েছে। আর ইংরেজিতে দলটির নাম হবে 'ন্যাশনাল সিটিজেন পার্টি। যা সংক্ষেপে 'এনসিপি' নামেই পরিচিতি পাবে। অন্তর্বর্তী সরকারের সাবেক উপদেষ্টা নাহিদ ইসলামকে দলটির আহ্বায়ক, আখতার হোসেনকে সদস্যসচিব, নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারীকে প্রধান সমন্বয়কারী, হাসনাত আবদুলস্নাহকে দক্ষিণাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক ও সারজিস আলমকে উত্তরাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক পদে চূড়ান্ত করা হয়েছে।
বৃহস্পতিবার দুপুর থেকে বিকেল পর্যন্ত রাজধানীর বাংলামোটরে জাতীয় নাগরিক কমিটির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে জাতীয় নাগরিক কমিটি ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের যৌথ বৈঠক হয়। সেখানে এসব সিদ্ধান্ত হয়। বৈঠকে অংশ নেওয়া জাতীয় নাগরিক কমিটির দায়িত্বশীল চারজন নেতা দলের নাম ও যেসব পদে নেতৃত্ব চূড়ান্ত হয়েছে, সেগুলো নিশ্চিত করেছেন।বৈঠক সূত্র জানিয়েছে, জ্যেষ্ঠ যুগ্ম আহ্বায়ক ও জ্যেষ্ঠ যুগ্ম সদস্যসচিব পদে একাধিক প্রার্থী থাকায় এসব পদে নেতৃত্ব এখনো চূড়ান্ত হয়নি। শুক্রবার রাজধানীর মানিক মিয়া অ্যাভিনিউয়ে নতুন এই দলের আত্মপ্রকাশ অনুষ্ঠান হবে। সেখানে দলের শীর্ষ পদে মনোনীতদের নাম ঘোষণা করা হবে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা জানান, ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে শেখ হাসিনার স্বৈরশাসনের বিদায়ঘণ্টা বাজানো বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা জাতীয় নাগরিক কমিটির সঙ্গে এক হয়ে নতুন রাজনৈতিক দল প্রতিষ্ঠা করছেন। তাদের এই নতুন দল গঠন দেশের রাজনীতি নতুন মাত্রা যোগ করেছে।
সংশ্লিষ্টদের ভাষ্য, পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনই এখন রাজনীতির প্রধান আলোচনা। সেই নির্বাচনে এখন পর্যন্ত ক্ষমতাচু্যত আওয়ামী লীগের অংশ নেওয়ার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। ভোট দূরে থাক, রাজনীতির আলোচনা থেকেই অনেকটা দূরে আছে জাতীয় পার্টি। এই অবস্থায় নতুন দলই আগ্রহের কেন্দ্রে চলে এসেছে।
এদিকে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে ভোটের মাঠে নতুন দলটি কতটা প্রভাব বিস্তার করবে, সে নিয়ে আলোচনা ও পর্যালোচনা চলছে নানা মহলে। এরই মধ্যে এ নিয়ে বিভিন্ন জরিপও হয়েছে।
গত ১৫ থেকে ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত চালানো ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (বিআইজিডি) এক জরিপে দেখা যায়, ৩৮ শতাংশ মানুষ তখন পর্যন্ত কাকে ভোট দেবেন বা ভোট দেবেন কি না, সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেননি। যাঁরা ভোট দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, সেই বাকি ৬২ শতাংশ মানুষের মধ্যে ৪০ শতাংশ মানুষ বলেছেন, গণ-অভু্যত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া শিক্ষার্থীরা যদি রাজনৈতিক দল গঠন করেন, সেই দলকে তাঁরা ভোট দেবেন। এ ছাড়া ১৬ শতাংশ বিএনপিকে, ১১ শতাংশ বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীকে এবং ৯ শতাংশ ক্ষমতাচু্যত আওয়ামী লীগকে, ৩ শতাংশ মানুষ অন্যান্য ইসলামি দল ও ১ শতাংশ জাতীয় পার্টিকে ভোট দেওয়ার কথা জানিয়েছেন। অবশ্য এই জরিপ নিয়ে মতভিন্নতা রয়েছে।
বিশ্লেষকেরা বলছেন, প্রতীকনির্ভর বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচনে খুব বেশি ব্যতিক্রম না হলে মার্কা দেখেই ভোট দেন ভোটাররা। আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগ মাঠে না থাকলেও তার বিপরীতে জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী আন্দোলন কিংবা ছাত্রদের নতুন দলের নতুন প্রতীকে ভোটার জোয়ার বইয়ে দেবেন, এর সম্ভাবনা খুব কম। নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও বিশ্বাসযোগ্য হলে বিএনপিকে হারিয়ে অন্য কোনো দলের সরকার গঠনের সম্ভাবনাও কম। বিএনপিও তা-ই মনে করে।
তবে ক্ষমতা থেকে দূরে থেকেও তরুণদের নতুন দল রাজনীতির গুণগত পরিবর্তন আনতে পারবেন, এমনটাই আশা করছেন অনেকেই। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের ধারণা, দেশের মানুষ যদি মনে করে, তারা তিনটি দলকে দেখেছে, সেনাশাসনও দেখেছে। তারা এবার পরিবর্তন চায়, তরুণ নেতৃত্ব যদি সেই পরিবর্তনের আকাঙ্খা সত্যিই জনমনে গেঁথে দিতে পারে, তাহলে হয়তো নতুন কিছু ঘটতে পারে।
এমন সম্ভাবনার কথা বলছেন নতুন দলের উদ্যোক্তারাও। তাঁদের ভাষ্য, আগের হিসাব এবার বদলে গেছে। অনেক নতুন ভোটার ভোট দেবেন, সামনের নির্বাচনে অনেক কিছুই হতে পারে। নতুন দল জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) নির্বাচনের প্রস্তুতি আছে। যে নির্বাচনই হোক, সে নির্বাচনে দল সফলতা পাবে।
এদিকে জাতীয় নাগরিক কমিটির সদস্য মোহাম্মদ মিরাজ মিয়ার পাঠানো এক বার্তায় জানানো হয়, নতুন রাজনৈতিক দল গঠনের পর পূর্ণ উদ্যমে জাতীয় নাগরিক কমিটি তার কার্যক্রমে ফিরবে।
বার্তায় আরও বলা হয়, আহ্বায়ক, সদস্য সচিব, মুখপাত্র ও মুখ্য সংগঠক ছাড়া জাতীয় নাগরিক কমিটির অবশিষ্ট অর্গানোগ্রাম, নির্বাহী কমিটি, সেলসমূহ ও সার্চ কমিটি বিলুপ্ত ঘোষণা করা হয়েছে। অর্থাৎ, জাতীয় নাগরিক কমিটির সাংগঠনিক গতিশীলতা বৃদ্ধির জন্য শিক্ষা, সংস্কৃতি, জলবায়ু, কূটনীতি, দপ্তর, সোশ্যাল মিডিয়া বিষয়ক যে সেলগুলো করা হয়েছিল, সোগুলো বিলুপ্ত ঘোষণা করা হয়েছে।
আহ্বায়ক, সদস্য সচিব, মুখপাত্র, মুখ্য সংগঠক এর পাশাপাশি 'যুগ্ম' ও 'সহ' যে পদগুলো ছিল (যেমন-যুগ্ম আহবায়ক, যুগ্ম সদস্য সচিব, যুগ্ম মুখ্য সংগঠক, সহ-মুখপাত্র ইত্যাদি) সেগুলোও বিলুপ্ত করা হয়েছে। তাছাড়াও, জরুরি সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য ৩৪ সদস্যের যে নির্বাহী কমিটি এবং কমিটিতে নতুন সদস্য নেওয়ার জন্য যে সার্চ কমিটি ছিল সেগুলোও বিলুপ্ত করা হয়েছে। কারণ এই পদগুলোতে থাকা অনেক সদস্য আসন্ন রাজনৈতিক দলে যুক্ত হতে যাচ্ছেন। তাই ২৮ ফেব্রম্নয়ারি নতুন দল গঠন পরবর্তী ১৫ কার্যদিবসের মধ্যে বর্তমান আহ্বায়ক, সদস্য সচিব, মুখপাত্র ও মুখ্য সংগঠক দায়িত্ব নিয়ে জাতীয় নাগরিক কমিটির কার্যপদ্ধতি নির্ধারণ করবেন। বর্তমানে দায়িত্ব থাকা ব্যক্তিরা তাদের দায়িত্ব নতুনদের কাছে হস্তান্তর করবেন। নতুন নেতৃত্বরাই পরবর্তীতে নির্বাহী কমিটিতে কারা থাকবেন, সেল ও সম্পাদকগুলোতে কারা থাকবেন- এসব বিষয়ে তাদের সাধারণ সভায় সিদ্ধান্ত নেবেন। দলে যোগ দিচ্ছেন না এমন সদস্যদের সদস্যপদ বহাল থাকবে।
দল গঠনের পর থেকে জানাক সিভিল-পলিটিক্যাল পস্ন্যাটফর্ম হিসেবেই থেকে যাবে। আর কোনো দল গঠনের উদ্যোগ নেবে না। এছাড়া, আগামী দিনে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং জনগণের স্বার্থে জাতীয় নাগরিক কমিটি সবসময় দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ও সক্রিয়ভাবে কাজ করে যাবে।
অর্থাৎ, জাতীয় নাগরিক কমিটি আত্মপ্রকাশের সময় দেশকে একটি নতুন রাজনৈতিক দল উপহার দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। জনগণের পক্ষ থেকে চলমান বাস্তবতায় বাংলাদেশমুখী, মধ্যপন্থি, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও গণতান্ত্রিক একটি রাজনৈতিক দলের যে প্রয়োজনীয়তা অনুভব হচ্ছিল, তারই পরিপ্রেক্ষিতে জাতীয় নাগরিক কমিটি ২৮ ফেব্রম্নয়ারি একটি নতুন রাজনৈতিক দল জাতিকে উপহার দিচ্ছে। এই দল আত্মপ্রকাশের পর নতুন করে আর দ্বিতীয় কোন রাজনৈতিক দল গঠনের কাজ জাতীয় নাগরিক কমিটি করবে না। জাতীয় নাগরিক কমিটি তার সাংগঠনিক কার্যক্রম বর্তমানের মতোই একটি সিভিক পলিটিক্যাল পস্নাটফর্ম হিসেবেই চালিয়ে যাবে।
বার্তায় আরও জানানো হয়,উপজেলা, থানা ও ওয়ার্ডে জাতীয় নাগরিক কমিটির যে প্রতিনিধি কমিটিগুলো গঠিত হয়েছিল এবং পেশাজীবীদের নিয়ে যে উপ-কমিটি বা প্রতিনিধি কমিটি হয়েছিল সেসব কমিটির যেসব সদস্য আসন্ন রাজনৈতিক দলে যুক্ত হতে ইচ্ছুক, তারা নাগরিক কমিটি থেকে রাজনৈতিক দলে কোন প্রক্রিয়ায় যুক্ত হবে সেটি দ্রম্নত সময়ের মধ্যেই জানিয়ে দেওয়া হবে।