আজ মাহে রমজানের ১০ম দিবস। মাহে রমজানের প্রথম দশক তথা রহমতের দশকের শেষ দিন। পুরো বছরের ১২টি মাসের মধ্যে 'মাহে রমজান' ফজিলত ও মর্যাদায় অতুলনীয়। মাহে রমজানের এই বিশেষত্বের কারণ হচ্ছে- এই মাসে আলস্নাহ তায়ালার পক্ষ থেকে প্রিয়নবী হযরত রাসুলে করিম সালস্নালস্নাহু আলাইহি ওয়া আলিহী ওয়াসালস্নামের ওপর পবিত্র কোরআন শরিফ অবতীর্ণ হওয়া। এ সম্পর্কে পবিত্র কোরআনে আলস্নাহ পাক ইটশাদ করেন: অর্থাৎ 'রমজান সেই মাস, যাতে কোরআন নাজিল হয়েছে। যা সমগ্র মানবমন্ডলীর জন্য হেদায়ত স্বরূপ। যাতে সুস্পষ্ট পথ প্রদর্শন এবং সত্যা-মিথ্যা নির্ণয়ের স্পষ্ট নির্দেশাবলি বিদ্যমান রয়েছে।' (সূরা বাকারা, আয়াত: ১৮৫) এ আয়াতাংশ থেকে বুঝা যায় যে, পবিত্র কোরআন শরিফ শুধু মুসলমানদের ধর্মগ্রন্থ নয়; বরং পৃথিবীর সব জাতি-গোষ্ঠী, পৃথিবীর সব দেশ ও অঞ্চল এবং পৃথিবীর সব ধর্মের মানুষের জন্য সম্পূর্ণ তত্ত্ব ও তথ্য সংবলিত বিশ্বজনীন আলোকময় এক মহাগ্রন্থ। এ মহাগ্রন্থে সমগ্র মানবজাতির সার্বিক মুক্তির নিয়ম-নীতি ও উপায়-উপকরণ বাতলে দেয়া হয়েছে। মানবজাতি যদি তার কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছুতে চায়, আর মুসলমানরা যদি চায় তাদের হৃত-গৌরব ফিরে পেতে- তাহলে অবশ্যই কোরআনের স্মরণাপন্ন হতে হবে। বিশেষ করে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে প্রত্যেক মুমিন-মুসলমানকে শুদ্ধ ও সঠিকভাবে কোরআন তিলাওয়াত শিখতে হবে। সঠিক অর্থ ও ব্যাখ্যাসহ কোরআন বুঝতে হবে। সবশেষে কোরআনের অনুশাসন তথা হুকুম-আহকাম আন্তরিকতা ও একনিষ্ঠতার সঙ্গে মেনে চলতে হবে।
মহাগ্রন্থ আল কোরআনে ধর্মীয় বিধিবিধানের পাশাপাশি মানুষের সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, পারিবারিক, সামরিক, বৈজ্ঞানিক, রাষ্ট্রীয় ও আন্তর্জাতিক সব সমস্যার সুষ্ঠু ও ভারসাম্যপূর্ণ সমাধান নিহিত রয়েছে। তন্মধ্যে মাত্র ৫০০ আয়াতে ইসলামী শরিয়তের বিধিবিধান বিবৃত হয়েছে (সূত্র: তাফসিরে আহমদি) কিন্তু বাকি আয়াতগুলোতে জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিভিন্ন বিষয়ের নিঁখুত বর্ণনা, ঐতিহাসিক ঘটনা, পৃথিবীর বিভিন্ন জাতি-গোষ্ঠী ও জনপদের নানা উত্থান-পতনের কাহিনী অত্যন্ত সাবলীল ভাষায় বিবৃত হয়েছে। কোরআনের পাঠক সে যে কোনো ধর্মের হোক না কেন, কোরআন পাঠ করলে বা শ্রবণ করলে বিমোহিত না হয়ে পারে না। ভাষাশৈলীতে বা শব্দের গাঁথুনিতে অথবা বাক্যবিন্যাসে, ঘটনার বর্ণনায় বা বক্তব্যের উপস্থাপনায় অথবা বিজ্ঞানের তত্ত্বে ও তথ্যে- এ গ্রন্থের সঙ্গে তুলনীয় কোনো গ্রন্থ পৃথিবীতে নেই এবং হতে পারে না। সর্বশক্তিমান মহামহিম আলস্নাহ জালস্না শানুহু এ সম্পর্কে বিশ্ববাসীকে চ্যালেঞ্জ দিয়ে বলেন, 'হে দুনিয়ার অবিশ্বাসী সম্প্রদায়! তোমরা যদি আমার প্রিয় হাবিবে করীম সালস্নালস্নাহু আলাইহি ওয়া আলিহী ওয়াসালস্নামের প্রতি নাজিলকৃত কোনো বিষয়ে যদি বিন্দুমাত্রও সংশয় করো, তাহলে এর মতো কোনো একটি সূরা (আয়াতাবলি) নিয়ে আসো...' (সূরা বাকারা, আয়াত:২৩)। উলেস্নখ্য যে, আলস্নাহ পাকের এ চ্যালেঞ্জ কোনো কালের জন্য সীমাবদ্ধ নয়; যে কোনো সময়ে যে কেউ এ চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করতে পারে। কিন্তু না, মহান আলস্নাহর এ চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করা এখনো পর্যন্ত কারো পক্ষে সম্ভব হয়নি, কোনো দিন হবেও না।। আলস্নাহ্ বলেন, 'আর যদি এর সাদৃশ্য কোনো আয়াতাবলি আনতে না পারো, অবশ্য ভবিষ্যতেও তোমরা এর সাদৃশ্য কোনো সূরা আনতে পারবে না, তাহলে হে অবিশ্বাসী সম্প্রদায়! ভয় করো সেই আগুনকে, যার ইন্ধন হবে মানুষ ও পাথর- যা অবিশ্বাসীদের জন্য প্রস্তুত রাখা হয়েছে। (সূরা বাকারা, আয়াত:২৪)।
পবিত্র কোরআনের সঙ্গে মাহে রমজানের রয়েছে নিবিড় সম্পর্ক। বস্তুত, পবিত্র কোরআন নাজিলের কারণেই মাহে রমজানের এত ফজিলত এবং এত মর্তবা। পবিত্র কোরআন অক্ষয়, অবিনশ্বর ও চিরঞ্জীব এক অমূল্য গ্রন্থ। পৃথিবীর সর্বাধিক পঠিত গ্রন্থও এটি। এটি তিলাওয়াত বা পাঠ করলে যেমন সওয়াব আছে, তেমনি মন-দিল লাগিয়ে শুনলেও সমান সওয়াব অর্জিত হয়। আমাদের প্রিয়নবী হযরত রাসুলে করীম সালস্নালস্নাহু আলাইহি ওয়া আলিহী ওয়াসালস্নাম ইরশাদ করেন, 'যে ব্যক্তি পবিত্র কোরআন থেকে একটি অক্ষর তিলাওয়াত করল, সে একটি নেকি হাসিল করল। আর একটি নেকি সওয়াব হয় ১০ গুণ। আমি এটা বলছি না যে, আলিফ-লাম-মীম একটি হরফ; বরং আলিফ একটি হরফ, লাম একটি হরফ, আর মীম একটি হরফ (তিরমিজি ও দারেমি শরিফ)। পবিত্র হাদিসে কোরআন শরিফ তেলাওয়াত করাকে 'আফজালুল ইবাদাত' বা সর্বোৎকৃষ্ট ইবাদাত বলা হয়েছে। কোরআনের ফজিলত বর্ণনা করে রাসুলে করিম সালস্নালস্নাহু আলাইহি ওয়া আলিহী ওয়াসালস্নাম ইরশাদ করেছেন, 'আলস্নাহ্ তাবারাকা ওয়া তায়ালা ইরশাদ করেন- আমার জিকির ও আমার কাছে প্রার্থনা করা থেকে কোরআন (তিলাওয়াত ও গবেষণা) যদি কোনো ব্যক্তিকে ব্যস্ত রাখে, আমার কাছে প্রার্থনাকারী ব্যক্তিকে আমি যা দিয়ে থাকি, তার চেয়ে কোরআন তেলাওয়াতকারী ব্যক্তিকে বেশি দেই। আলস্নাহর বাণীর ফজিলত সব বাণীর ওপর এমনই যে, যেরূপ আলস্নাহ্ তায়ালার ফজিলত সব সৃষ্টিজগতের ওপর।' (তিরমিজি)।
আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা নির্বিশেষে আমাদের প্রত্যেকেরই উচিত- নিয়মিতভাবে শুদ্ধরূপে কোরআন তিলাওয়াতে মনোনিবেশ করা। এ জন্য আমাদের প্রত্যেকেরই শুদ্ধরূপে কোরআন শেখার প্রতি আগ্রহী হওয়া প্রয়োজন। কোরআন শিক্ষার প্রতি গুরুত্বারোপ করে আলস্নাহর রাসুল সালস্নালস্নাহু আলাইহি ওয়া আলিহী ওয়া সালস্নাম বলেন, 'তোমাদের মধ্যে ওই ব্যক্তিই সর্বোত্তম, যে নিজে কোরআন শিখে এবং অন্যদের শিখায়' (বুখারি)। আমরা অনেকেই কোরআন পাঠ করি সত্য এবং এর ফলে, আলস্নাহ্ তায়ালার অনুগ্রহে সওয়াবের অধিকারীও হই নিঃসন্দেহে, কিন্তু কোরআনে আলস্নাহ্ তায়ালা কী বলেছেন, তার কিছুই বুঝি না। তাই আমাদের সবার উচিত, অর্থ বুঝে কোরআন পড়া। আলস্নাহর প্রিয় রাসুল সালস্নালস্নাহু আলাইহি ওয়া আলিহী ওয়াসালস্নাম বলেছেন, 'যার পেটে (অন্তরে) কোরআনের কোনো অংশ নেই, নিশ্চয়ই সে উজাড় ঘরের মতো' (তিরমিজি)। তাই আমাদের সবাইকে সহি শুদ্ধভাবে কোরআন তেলাওয়াত করার পাশাপাশি সঠিক, নির্ভুল ও নির্ভরযোগ্য অনুবাদ ও তফসির অধ্যয়ন করে কোরআনে আলস্নাহ্ জালস্না শানুহু কী বলেছেন, কেন বলেছেন এসব জানতে হবে। আর যথাসাধ্য কোরআনের অনুশাসন মেনে চলতে হবে। আলস্নাহ্ আমাদের তওফিক দিন। আমিন! বিহুরমাতি রাহমাতুলিস্নল আলামীন সালস্নালস্নাহু আলাইহি ওয়াআলিহী ওয়াসালস্নাম।
আবছার তৈয়বী: লেখক, গবেষক ও ইসলামী চিন্তাবিদ। প্রতিষ্ঠাতা-সভাপতি: প্রবাসী সাংবাদিক সমিতি (প্রসাস), দুবাই, ইউ.এ.ই। চেয়ারম্যান:আহলে বায়ত (আ.) ইসলামী গবেষণা কেন্দ্র, আবুধাবি, ইউ.এ.ই। সঁহঃুঢ়রহম@মসধরষ.পড়স