প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, আওয়ামী লীগ আগামী জাতীয় নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে কি না, সেই সিদ্ধান্ত তাদেরই নিতে হবে। তিনি এও বলেছেন, ভোটে কারা অংশ নিতে পারবে, সেই সিদ্ধান্ত নেয় নির্বাচন কমিশন।
যুক্তরাজ্যের সংবাদমাধ্যম বিবিসিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে মুহাম্মদ ইউনূস এ কথা বলেন। মুহাম্মদ ইউনূস ঢাকায় তার সরকারি বাসভবনে সাক্ষাৎকার নিয়েছেন বিবিসির দক্ষিণ এশিয়া সংবাদদাতা সামিরা হুসেইন। ইংরেজি সাক্ষাৎকারটি বৃহস্পতিবার বিবিসির ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়েছে।
এদিকে, ভারতে পালিয়ে যাওয়া শেখ হাসিনা ও তার দল এ বছরের শেষ দিকে অনুষ্ঠেয় নির্বাচনে অংশ নেবেন কি না তা এখনো স্পষ্ট নয়। মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে বাংলাদেশে তার বিচারের প্রক্রিয়া চলছে।
সাক্ষাৎকারে ইউনূস বলেন, 'তারা এটা (ভোট) করতে চায় কি না, সেই সিদ্ধান্ত তাদেরকেই (আওয়ামী লীগ) নিতে হবে। তাদের সিদ্ধান্ত তো আমি নিতে পারি না। কারা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে তা নির্বাচন কমিশন ঠিক করে।'
গত ৫ অগাস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের দুই দিন বাদে শান্তিতে নোবেলজয়ী মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার যাত্রা করে। ইউনূস বলেন, 'শান্তি ও শৃঙ্খলা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এবং অর্থনীতি। ভেঙে চুরমার হয়েছে অর্থনীতি, বিধ্বস্ত অবস্থা। যেন ১৬ বছর ধরে কোনো ভয়ানক টর্নেডো চলছে এবং আমরা (বিধ্বস্ত) টুকরোগুলো জড়ো করার চেষ্টা করছি।'
বিবিসি লিখেছে, ২০০৯ সালে প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হওয়ার পর 'লৌহমুষ্টিতে' বাংলাদেশ শাসন করেন শেখ হাসিনা। তার আওয়ামী লীগ সরকারের সদস্যরা ভিন্নমতকে 'নির্মমভাবে দমন করে'। প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে তার বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীদের হত্যা ও কারাগারে পাঠানোর ব্যাপক অভিযোগ ছিল।
ছাত্রদের নেতৃত্বাধীন অভু্যত্থান শেখ হাসিনাকে ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য করে। আন্দোলনকারীদের চাওয়া মত নতুন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের নেতৃত্ব দিতে বাংলাদেশে ফিরে আসেন ইউনূস। তিনি বলেন, অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য তার সরকার কত দ্রম্নত প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার করতে পারে তার ওপর নির্ভর করে ২০২৫ সালের ডিসেম্বর থেকে ২০২৬ সালের মার্চের মধ্যে নির্বাচন করবেন।
ইউনূস বলেন, 'আমাদের চাওয়া-যদি দ্রম্নত সংস্কার করা যায়, তাহলে ডিসেম্বরেই আমাদের নির্বাচন হবে। আর যদি সংস্কার দীর্ঘতর হয়, তবে আমাদের আরও কয়েক মাস সময় লাগতে পারে।'
গত গ্রীষ্মে বাংলাদেশে ছড়িয়ে পড়া সহিংস বিক্ষোভের প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, 'আমরা সম্পূর্ণ বিশৃঙ্খল অবস্থার মধ্যে ছিলাম। মানুষকে তারা গুলি করে হত্যা করেছে।'
কিন্তু প্রায় সাত মাস পেরোলেও ঢাকার মানুষ বলছে, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি আগের অবস্থায় এখনো ফেরেনি, পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে না। সেই প্রশ্নে তিনি বলেন, 'উন্নতি আসলে আপেক্ষিক বিষয়। উদাহরণ হিসেবে আপনি যদি গত বছরের সাথে তুলনা করেন তাহলে ঠিক আছে। এখন যা ঘটছে, তা অন্য যে কোনো সময়ের চেয়ে আলাদা নয়।'
শেখ হাসিনার পতনের পর যখন ইউনূসকে সরকারের দায়িত্ব নিতে বলা হয়, তখন তিনি 'হতভম্ব' হয়ে পড়েছিলেন। সে কথা তুলে ধরে তিনি বিবিসিকে বলেন, 'সরকারের নেতৃত্ব দেওয়ার বিষয়ে আমার কোনো ধারণা ছিল না। আগে কখনো সরকার যন্ত্রের কোনো অংশ চালাইনি এবং সেই দায়িত্বই তখন কাঁধে এল।'
দায়িত্ব নেওয়ার পর আইনশৃঙ্খলা পুনরুদ্ধার ও অর্থনীতি ঠিক করাই দেশের জন্য অগ্রাধিকার ছিল জানিয়ে ইউনূস বলেন, 'এসব ঠিক হওয়ার পরে আমরা সংগঠিতভাবে কাজ শুরু করি।'
বাংলাদেশের এখনকার বহু সংকটের জন্য আগের সরকারকে দুষছেন ইউনূস। তিনি বলেন, 'আমি বলছি যে, হঠাৎ করে তৈরি করা একটি আদর্শ দেশ বা একটি আদর্শ শহর আমরা নই, এ বিষয়টি আপনাকে বিবেচনায় নিতে হবে। এটা সেই ধারাবাহিকতা- যা আমরা উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছি, এই দেশটি বহু, বহু বছর ধরে এভাবে চলছে।'
বিবিসি লিখেছে, এখন ইউনূস সরকারের সময়ে শেখ হাসিনার রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সম্পৃক্তদের নিরাপত্তা নিয়ে যে প্রশ্ন উঠেছে। শেখ হাসিনা ভাষণ দিতে আসছেন- এমন ঘোষণায় গত ফেব্রম্নয়ারিতে আওয়ামী লীগের অনেকের বাড়িঘরে ভাঙচুর হয়। এর মধ্যে শেখ হাসিনার বাবা প্রয়াত শেখ মুজিবের বাড়ি গুঁড়িয়ে দেওয়ার ঘটনাও রয়েছে।
আওয়ামী লীগ সোশাল মিডিয়ার পোস্টে অন্তর্বর্তী সরকারের বিরুদ্ধে 'সহিংসতাকে বৈধতা দেওয়ার' অভিযোগ তুলেছে। দলটি দাবি করছে, বাংলাদেশ তাদের জন্য 'নিরাপদ নয়'।
এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে ইউনূস বিবিসিকে বলেন, 'আদালত রয়েছে, আইন রয়েছে, থানা রয়েছে- তারা সেখানে গিয়ে অভিযোগ জানাতে পারে, অভিযোগ নথিভুক্ত করতে পারে। কেবল বিবিসির সাংবাদিকের কাছে অভিযোগ করলেই হবে না, আপনাকে থানায় গিয়ে অভিযোগ জানাতে হবে এবং দেখুন আইন তার পথে রয়েছে কি না।'
ট্রাম্প প্রশাসনের বিদেশি সহায়তা কমানোর সিদ্ধান্ত এবং ইউএস এজেন্সি ফর ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্টের অর্থায়নের প্রায় সব কর্মসূচি বন্ধ করার সিদ্ধান্ত বাংলাদেশের মত দেশগুলোর ওপর প্রভাব ফেলবে। এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে ইউনূস বলেন, 'এটা তাদের সিদ্ধান্ত।'
ওই সহায়তা যে কাজে লাগছিল, সে কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, 'তারা যেটা করছিল, সেটা আমরাই করতে চেয়েছিলাম, যেমন দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই করা। কিন্তু সেই সক্ষমতা তো আমাদের ছিল না।'
বাংলাদেশে সরকারি উন্নয়ন সহায়তার নিরিখে তৃতীয় অবস্থান যুক্তরাষ্ট্রের। দেশটি গত বছর ৪৫ কোটি ডলার বিদেশি সহায়তা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। ঘাটতি কীভাবে পূরণ হবে, এ প্রশ্নের উত্তরে ইউনূস বলেন, 'যখন এটা হবে, তখন আমরা করব।'
জুলাই চার্টার আমাদের পথ দেখাবে
এদিকে, অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, ছয়টি কমিশনের সুপারিশ করা সংস্কার প্রস্তাবগুলো নিয়ে সংলাপ শেষে রাজনৈতিক দলগুলো জুলাই সনদ (জুলাই চার্টার) স্বাক্ষর করবে। জুলাই চার্টার আমাদের পথ দেখাবে। অন্তর্বর্তী সরকার এই সনদের সুপারিশগুলোর কিছু অংশ বাস্তবায়ন করবে আর বাকিগুলো বাস্তবায়ন করবে পরবর্তী রাজনৈতিক সরকার। আগামী নির্বাচন চলতি বছরের ডিসেম্বরে বা আগামী বছরের জুনের মধ্যে অনুষ্ঠিত হবে।
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক মানবাধিকার সংগঠন 'রাইট টু ফ্রিডম'-এর প্রেসিডেন্ট উইলিয়াম বি মাইলাম বৃহস্পতিবার রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। এ সময় প্রধান উপদেষ্টা এ কথা বলেন। এ সময় 'রাইট টু ফ্রিডম'-এর নির্বাহী পরিচালক জন ড্যানিলোউইচ উপস্থিত ছিলেন। প্রধান উপদেষ্টার ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে এই কথা জানানো হয়েছে।
সাবেক দুই কূটনীতিক উইলিয়াম বি মাইলাম ও জন ড্যানিলোউইচ প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ইউনূসকে রাইট টু ফ্রিডমের কার্যক্রম সম্পর্কে অবহিত করেন। তারা বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক উত্তরণে সহায়তার অংশ হিসেবে তাদের প্রচেষ্টার পরিকল্পনার কথা প্রধান উপদেষ্টার কাছে তুলে ধরেন। অধ্যাপক ইউনূস রাইট টু ফ্রিডমের কাজ এবং বাংলাদেশের মানবাধিকার ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধকে এগিয়ে নিতে সহায়তা প্রচেষ্টার জন্য তাদের প্রশংসা করেন।
মাইলাম ১৯৯০-এর দশকের গোড়ার দিকে বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের দূত ছিলেন। অন্তর্র্বতী সরকারের সংস্কার উদ্যোগের প্রশংসা করে তিনি বলেন, জুলাই অভু্যত্থান বাংলাদেশে ব্যাপক সংস্কার এবং একটি সত্যিকারের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য বড় সুযোগ এনে দিয়েছে।
ঢাকায় যুক্তরাষ্ট্রের উপ-রাষ্ট্রদূত হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন জন ড্যানিলোউইচ। তিনি বলেন, 'ভুয়া খবর ও ভুল তথ্যের বিপদ মোকাবিলায় বাংলাদেশের ইতিবাচক বয়ান এবং জোরালো প্রচেষ্টা প্রয়োজন।'
ঘণ্টাব্যাপী বৈঠকে অধ্যাপক ইউনূস কূটনীতিকদের বলেন, 'ছয়টি কমিশনের সুপারিশকৃত সংস্কারের ওপর সংলাপ শেষে রাজনৈতিক দলগুলো জুলাই সনদ স্বাক্ষর করবে।' 'জুলাই চার্টার আমাদের পথ প্রদর্শন করবে', উলেস্নখ করে তিনি বলেন, 'অন্তর্বর্তী সরকার জুলাই সনদের সুপারিশগুলোর কিছু অংশ বাস্তবায়ন করবে এবং বাকিগুলো বাস্তবায়ন করবে পরবর্তী রাজনৈতিক সরকার।'
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, 'রাজনৈতিক দলগুলো ভোটের আগে কম সংস্কারে সম্মত হলে চলতি বছরের ডিসেম্বরে জাতীয় নির্বাচন হবে। অথবা আগামী বছরের জুনের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।'
প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সাবেক দুই কূটনীতিকের সাক্ষাতে বর্তমান বাংলাদেশ-মার্কিন সম্পর্ক, রোহিঙ্গা সংকট, আগের আমলে চুরি যাওয়া কোটি কোটি ডলার উদ্ধার, সার্ক পুনরুজ্জীবিত করার প্রধান উপদেষ্টার প্রচেষ্টাসহ নানা বিষেেয় আলোচনা হয়।