রাজধানীর নাবিস্কো মোড়ে টিসিবি'র পণ্যবোঝাই ট্রাক এসে পৌঁছে বৃহস্পতিবার দুপুরে। ট্রাক আসার সঙ্গে সঙ্গেই সেখানে অপেক্ষমাণ নারী-পুরুষ ছুটে যান টিসিবির ট্রাকের দিকে। কিছু সময়ের মধ্যে দুই শতাধিক মানুষের সারি তৈরি হয়, যেখানে শুধু নিম্ন আয়ের মানুষের থাকার কথা থাকলেও দেখা গেছে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মচারী, মধ্যবিত্ত, চাকরিজীবীসহ নানা পেশার মানুষ। প্রখর রোদে দাঁড়িয়ে অপেক্ষার হাত উঁচিয়েছেন তারা পণ্যের জন্য। অন্তর্বর্তী সরকারের নির্দেশে বেশ কিছু দিন বন্ধ থাকার পর, ৫ মার্চ থেকে ফের ৬৪ জেলায় ট্রাকসেলের মাধ্যমে সাধারণের মাঝে পণ্য বিক্রি শুরু হয়েছে।
ক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে কুলিয়ে উঠতে না পেরে অভাবী মানুষের সারিতে দাঁড়াচ্ছেন মধ্যবিত্তরা। এদিকে দীর্ঘ সময় ধরে লাইনে দাঁড়িয়ে থেকে পণ্য কিনতে না পেরে খালি হাতে ফিরছেন অনেকেই। তবে চাহিদার তুলনায় বরাদ্দ কম পাওয়ায় সবাইকে পণ্য দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না বলে জানান ডিলাররা।
শাকিল হোসেন সীমিত বেতনে চাকরি করেন একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে। নিজেকে মধ্যবিত্ত বলে দাবি করলেন। পোশাক আশাক দেখেও তাই মনে হয়। তিনিও ওএমসের পণ্য কিনতে এসেছেন। চালসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় আয়ের সঙ্গে ব্যয়ের সঙ্গতি রাখতে পারছেন না। তাই বাধ্য হয়েই এসেছেন ওএমএসর নির্ধারিত মূল্যে পণ্য নিতে। তবে মধ্যবিত্তসুলভ মর্যাদা বজায় রাখতে নিজে লাইনে দাঁড়াননি। টাকা দিয়ে এক কিশোরকে লাইনে দাঁড় করিয়ে শাকিল দাঁড়িয়েছেন অদূরে।
নাবিস্কো মোড়ে পণ্যের জন্য লাইনে দাঁড়িয়েছেন বেসরকারি চাকরিজীবী ফরহাদ হোসেন। একটি মোটর কোম্পানির এই কর্মকর্তা জানালেন, বাজারে সর ধরনের দ্রব্যের দাম বাড়ায় সংসার চালানো কঠিন হয়ে পড়েছে। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মচারী শহিদ মুন্সী জানান, যে সয়াবিন তেল বাজারে ১৯০-২০০ টাকা লিটারে বিক্রি হয়, টিসিবি থেকে তা মাত্র ১০০ টাকায় পাওয়া যাচ্ছে। একসঙ্গে দুই লিটার কেনা যাচ্ছে।
তবে, অনেকেই অভিযোগ করেছেন যে, এসব পণ্যের উপকারি উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন হচ্ছে না। নাসিমা সুলতানা নামে একজন বলেন, এক পরিবারের এক সদস্য পণ্য কিনলে তো যথেষ্ট, কিন্তু বহু পরিবার একসঙ্গে লাইনে দাঁড়িয়ে পণ্য কিনছে, যা প্রকৃত অভাবীদের পণ্য পাওয়ার সুযোগ কমিয়ে দিচ্ছে। কিছু দোকানদারও এই সুযোগ নিয়ে পণ্য কিনে আবার বিক্রি করছে বলে অভিযোগ করেন তিনি।
টিসিবি'র ডিলার জানান, একজন ভোক্তা সর্বোচ্চ দুটি ভোজ্যতেল, দুই কেজি মসুর ডাল, এক কেজি চিনি, দুই কেজি ছোলা এবং ৫০০ গ্রাম খেজুর কিনতে পারবেন। এর মোট মূল্য ৫৮৮ টাকা।
রাজধানীর ওএমএসর বিভিন্ন স্পট ঘুরে এমন চিত্র সহজেই মিলছে। লাইনে দাঁড়াবেন কি দাঁড়াবেন না- এমনতর দ্বিধা দ্বন্দ্বে ভোগা লোকের সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে। সাতরাস্তা ট্রাকসেলের অদূরে দাঁড়িয়ে আছেন শওকত আলী। তিনি তৃতীয় শ্রেণির সরকারি কর্মচারী। তিনিও পারছেন না বাজারের চালের দামের সঙ্গে কুলিয়ে উঠতে। তাই তিনিও এসেছেন ওএমএসর ট্রাকের পাশে। যদি অন্য কাউকে দিয়ে এখান থেকে পণ্য নিতে পারেন! তিনি বলেন, বাজারে চালসহ সব পণ্যের দাম যে বেড়েছে তা ওএমএসর লাইন দেখেই বোঝা যায়, বাজারে যেতে হয় না। পণ্য কিনতে আসা অনেকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল তারা নিজের জন্য নয়; যাদের বাসায় কাজ করেন তাদের জন্য এসেছেন। তবে, কাজের ফাঁকে নিজেদের জন্যও পণ্য নিতে আসেন এদের কেউ কেউ।
পর্যবেক্ষকরা বলছেন, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমেছে; অন্যদিকে, বেড়েছে নিত্যপণ্যের দাম। এমন পরিস্থিতিতে সুলভে পণ্য কেনার জন্য স্বস্তির ঠিকানা হয়েছে খাদ্য বিভাগের ওএমএস। আগে নিম্ন আয়ের লোকজন খোলাবাজারে পণ্য কেনার জন্য ভিড় করতেন। বর্তমান পরিস্থিতিতে মধ্যবিত্তরাও দাঁড়াচ্ছেন লাইনে। নগরীর একাধিক খাদ্য বিভাগের ওএমএস-এর ডিলারের দোকানে দেখা যায় মানুষের দীর্ঘ সারি। বিশেষ করে নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্তরা কম দামে পণ্য কিনতে লাইনে দাঁড়াচ্ছেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন ডিলার জানান, মানুষ খুব কষ্টে রয়েছেন। আগে ট্রাক থেকে নিম্ন আয়ের মানুষ পণ্য কিনতেন। এখন মধ্য আয়ের মানুষেরও দেখা যায়। নিয়ম অনুযায়ী যারা সিরিয়ালে সামনে দাঁড়ান; তারা পণ্য কিনতে পারছেন। আর যারা শেষের দিকে থাকেন; তাদের অনেককে খালি হাতে ফিরতে হচ্ছে।
রমজান মাসে তেল, ডাল, চিনি, ছোলা ও খেজুর বিক্রি হচ্ছে ট্রাক থেকে। ঢাকার ৫০ পয়েন্টেসহ সারাদেশে এই পণ্য বিক্রি করেছে টিসিবি। টিসিবির মুখপাত্র হুমায়ুন কবির এই তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
টিসিবির তথ্য অনুযায়ী, একজন ক্রেতা ১০০ টাকা লিটার দরে সর্বোচ্চ দুই লিটার সয়াবিন তেল, ৬০ টাকা কেজি দরে দুই কেজি করে মসুর ডাল ও ছোলা, ৭০ টাকা কেজি দরে এক কেজি চিনি এবং ৭৭ টাকা ৫০ পয়সা দিয়ে ৫০০ গ্রাম খেজুর কিনতে পারছেন। এর মধ্যে প্রতি লিটার সয়াবিন তেলের দাম রাখা হয়েছে ১০০ টাকা।
টিসিবি জানিয়েছে, খোলা ট্রাক সেলের মাধ্যমে এসব পণ্য বিক্রি করা হবে, তাই সবার জন্য উন্মুক্ত থাকবে। যে কেউ লাইনে দাঁড়িয়ে ন্যায্যমূল্যের এসব পণ্য নিতে পারবেন। আগে প্রতি ট্রাকে ৩৫০ জনের প্যাকেজ থাকলেও এবার থাকছে ২৫০ জনের।
সাধারণত কার্ড নেই, এমন সাধারণ ভোক্তাদের কাছে ট্রাকের ট্রাকসেল কার্যক্রমের মাধ্যমে ভর্তুকি মূল্যে পণ্য বিক্রি করা হয়। গত বছরের ২৪ অক্টোবর ট্রাকসেল কার্যক্রম হাতে নেয় টিসিবি। পরিবার কার্ড না থাকলেও প্রতিদিন ঢাকা ও চট্টগ্রামে সাড়ে ২৪ হাজার মানুষ ভর্তুকি মূল্যে এসব পণ্য কেনার সুযোগ পেতেন। শুরুতে এ কার্যক্রম ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত চালু থাকার কথা থাকলেও মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে না আসায় ডিসেম্বর পর্যন্ত কার্যক্রম চালিয়ে নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। ফলে, দুই মাস সাত দিন চলার পর ৩১ ডিসেম্বর থেকে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে এ কর্মসূচি বন্ধ করে দেয় সংস্থাটি।
বাণিজ্য উপদেষ্টা সেখ বশিরউদ্দীন ২ মার্চ বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সভায় জানান, রমজানে বাজার স্থিতিশীল রাখতে এবং নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য সুবিধা নিশ্চিত করতে ৫ মার্চ থেকে ৬৪ জেলায় ট্রাকসেলে টিসিবির পণ্য বিক্রি শুরু হবে। এরই মধ্যে এ কার্যক্রম ছয় জেলায় চলমান আছে। নতুন করে ৫৬ জেলায় কার্যক্রম যুক্ত হবে।
ওই সভায় তিনি বলেন, আমরা ন্যায় প্রতিষ্ঠা করতে চাই। কারো প্রতি জুলুম করা হবে না, তবে, কেউ জুলুম করলে তাকে ছাড় দেওয়া হবে না। এ সময় অন্যায় প্রতিরোধে জেলা প্রশাসকদের সর্বশক্তি নিয়োগের আহ্বান জানান তিনি।
সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার একদম প্রাথমিক ধাপ টিসিবির ন্যায় সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থার উপকারভোগী নির্বাচন করা উলেস্নখ করে তিনি বলেন, এটা নিশ্চিত করতে পারলে মানুষের মধ্যে আপনাদের (জেলা প্রশাসকদের) গ্রহণযোগ্যতা বাড়বে। মানুষ আপনাদের ইজ্জত (সম্মান) দেবে বলে যোগ করেন বাণিজ্য উপদেষ্টা।