রোববার, ০৪ মে ২০২৫, ২১ বৈশাখ ১৪৩২

ঐক্য ও সম্প্রীতিবোধে উজ্জীবিত হওয়াই রমজানের শিক্ষা

আবছার তৈয়বী (আবুধাবি থেকে)
  ০৭ মার্চ ২০২৫, ০০:০০
ঐক্য ও সম্প্রীতিবোধে উজ্জীবিত হওয়াই রমজানের শিক্ষা
ঐক্য ও সম্প্রীতিবোধে উজ্জীবিত হওয়াই রমজানের শিক্ষা

আলস্নাহ্‌ রাব্বুল আলামীন নির্দেশিত ও প্রিয় রাসূল সালস্নালস্নাহু আলাইহি ওয়া আলিহী ওয়াসালস্নাম প্রদর্শিত ইসলামের প্রতিটি বিধি-বিধানে মানবজীবনের জাগতিক ও আধ্যাত্মিক কল্যাণসমূহ সত্যিই বিশ্ববাসীর হৃদয়ে নাড়া দেয়। তেমনি মাহে রমজানের রুহানি বা অন্তর্গত দর্শন খুবই তাৎপর্যপূর্ণ ও গণবান্ধব। মাহে রমজানে আচরিত ইবাদত-বন্দেগি ও নানা আয়োজনের মাঝে মুসলমানদের ঐক্য-শৃঙ্খলা, সৌহার্দ্য-ভ্রাতৃত্ব, শান্তি ও সম্প্রীতিবোধের প্রকৃষ্ট দৃষ্টান্তরূপে দেদীপ্যমান। মাসজুড়ে একই পদ্ধতি অনুসরণে, একই সময়ে সূত্রবদ্ধ জীবন যাপনে মানুষে মানুষে সম্প্রীতিবোধ জাগ্রত হয়। ঐক্য ও উজ্জীবনের সঞ্জীবনী সুর ধ্বনিত হয় সব ক্ষেত্রে। অশান্তি ও অস্থিরতা কেটে যায় সম্মিলিত পদচারণায়, অভিন্ন আচরণ ও দৃষ্টিভঙ্গির অনুকূল প্রভাবে।

আমাদের জেনে রাখা প্রয়োজন, মুসলিম জাতিসত্তার জীবনীশক্তির দুটি উৎস। ১. তাকওয়া ও ২. ঐক্য। আর তাকওয়ার ভুষনে নিজেকে সুশোভিত করা এবং ঐক্য ও সম্প্রীতির বন্ধনে আবদ্ধ থাকার প্রেরণা দেয় মাহে রমজান। মুসলমানরা একই সময়ে একই নিয়ম-পদ্ধতি মেনে এবং অভিন্ন উদ্দেশে মহান আলস্নাহর নির্দেশে সিয়াম সাধনায় প্রবৃত্ত হয়ে সম্মিলিত শক্তি হিসেবে নিজেদের অস্তিত্ব জানান দেয় মাহে রমজানে। সারা বিশ্বে একই পদ্ধতিতে সিয়াম সাধনায় মনোনিবেশ করে মুসলমানরা বিশ্ববাসীকে এটাই জানিয়ে দেয় যে- 'মুসলিম মিলস্নাত' একই সূত্রে আবদ্ধ ও সুশৃঙ্খল। আলস্নহ জালস্না শানুহু ও প্রিয়নবী সালস্নালস্নাহু আলাইহি ওয়া আলিহী ওয়াসালস্নাম এর নির্দেশের প্রতি ঐক্যবদ্ধভাবে সমর্পিত সকলেই। এই যে মিলনের সুর, অভিন্ন চিন্তা-চেতনা, আচার-আনুষ্ঠানিকতা, ধর্মীয় ঐক্যের বহিঃপ্রকাশ মাহে রমজানে অনুশীলিত হয়- তা যেন আলস্নাহ্‌ ও তাঁর প্রিয় রাসূল সালস্নালস্নাহু আলাইহি ওয়া আলিহী ওয়াসালস্নাম ইচ্ছারই প্রতিফলন। মহান আলস্নাহর অমোঘ বাণী- 'ওয়াতাসিমু বিহাবলিলস্নাহি জমিয়াউঁ ওয়ালা তার্ফারাক'ু- অর্থাৎ 'তোমরা সকলে আলস্নাহ্র রজ্জুকে দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে ধরো এবং পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ো না'। (সূরা আলে ইমরান : ১০৩) মুসলমানরা সিয়াম সাধনা ও অভিন্ন ইবাদত-বন্দেগির মাধ্যমে নিজেদের সামষ্টিক ঐক্য ও সংহতি প্রকাশ করে। সৌহার্দ্য-সম্প্রীতিবোধে উজ্জীবন, ঐক্যের ভিত্তি ও উপলক্ষ হিসেবে মাহে রমজানের চেয়ে দীর্ঘকালীন প্রভাব বিস্তারকারী ধর্মীয় আয়োজন দ্বিতীয়টি আর নেই।

পৃথিবীতে নানাভাবে ঐক্যের ডাক শোনা যায়। বিভিন্ন জাতি-গোষ্ঠির সম্মিলনে সে ঐক্য কোনটি গঠনমূলক ও কল্যাণমূলক, আবার নানা দেশ ও জাতি-গোষ্ঠির সমন্বয়ে এমন ঐক্যও গঠিত হয় যা- বিশ্ব মানবতার ধ্বংস সাধনে সদা তৎপর। সে ঐক্যের কোন কোনটি আঞ্চলিক, কোনটি ভাষাভিত্তিক, কোনটি চেতনা ও আকিদাগত। মানবতার অনিষ্ট ও ধ্বংস সাধনে এবং অন্যের ক্ষতির জন্য কোনো ঐক্যে ইসলামের সায় নেই; বরং আছে নিষেধাজ্ঞা, আছে ধিক্কার। ইসলাম বিশ্ব মানবতাকে ডাক দিয়েছে বাস্তব বুনিয়াদের ওপর প্রতিষ্ঠিত এক সার্বজনীন মানবিক গণঐক্যের। সে ঐক্য হবে- শান্তির, সৃজনশীলতার, জ্ঞানের, কল্যাণের এবং সুন্দরের। যে একতা মানুষের মাঝে পারস্পরিক সহমর্মিতা ও ভ্রাতৃত্ববোধ জাগ্রত করে সে 'ইউনিটি'ই ইসলামে অনুমোদিত। মুসলমানরা মাহে রমজানে আলস্নাহ তায়ালা ও প্রিয়নবী হযরত রাসূলে করিম সালস্নালস্নাহু আলাইহি ওয়া আলিহী ওয়াসালস্নাম এর ইচ্ছা ও আদেশে সমর্পিত হয়ে মানবিক কর্তব্য পালনের ক্ষেত্রে সুদৃঢ় ঐক্যের বুনিয়াদ রচনা করে থাকে। আমরা জানি- ঐক্যহীনতায় সমাজ, পরিবার ও রাষ্ট্রীয় জীবনে দ্বন্দ্ব-সংঘাত, অশান্তি-অস্থিরতা এবং অবিশ্বাস দানা বেঁধে ওঠে। যে সমাজে শান্তি-শৃঙ্খলা ও পারস্পরিক সৌহার্দ্য-সম্প্রীতিবোধ নেই, সেখানে আশার আলো নেই, নেই সুন্দরভাবে বাঁচার আশাও।

মাহে রমজানে মাসজুড়ে রোজাদারদের মাঝে বহুভাবে ঐক্য ও ভ্রাতৃত্ববোধ জাগ্রত হয়। লাখো কোটি রোজাদার একই নিয়মে একই পদ্ধতিতে অভিন্ন লক্ষ্য উদ্দেশে সিয়ামের নির্দিষ্ট আচার-কর্তব্য পালনে অধিক মনোযোগ দেয়। সবার মাঝে শান্তি-শৃঙ্খলা, ভ্রাতৃত্ব, পারস্পরিক যোগাযোগ, সম্প্রীতি, সহমর্মিতা এবং চিন্তায় ও কাজে ঐক্যবদ্ধতার মিলনের সুর বাজে ত্রিশ দিন ধরে। এই ঐক্য ও সম্প্রীতির অনুকূল প্রভাব পড়ে দেশ ও জাতির জীবনে। তখন অশুভ চিন্তা, পরস্পর বিদ্বেষ ভাব, পরনিন্দা, মিথ্যাচার, শঠতা এবং অন্যের ক্ষতি করার প্রবণতা প্রবৃত্তিগতভাবেই কমে যায়। শুভবোধ ও কল্যাণ চিন্তায় রোজাদারের সময়টুকু নির্বিঘ্নে ও প্রশান্তিতে কেটে যায়। রোজার পালনীয় উপলক্ষগুলোতে রোজাদার খুঁজে পায় উজ্জীবনী শক্তি, শান্তি- শৃঙ্খলা ঐক্য ও সমৃদ্ধির মূলমন্ত্র। সিয়াম সাধনার এই শিক্ষা ও অনুশীলন ধরে রাখলে আমাদের পুরো জাতির জীবনই পাল্টে যাবে। ফলে, জাতি হিসেবে আমরা কল্যাণকামী, উন্নত এবং সমৃদ্ধ হতে পারবো। আলস্নাহ্‌ আমাদের তাওফিক দিন। আমিন। বিহুরমাতি রাহমাতুলিস্নল আলামীন সালস্নলস্নাহু আলাইহি ওয়া আলিহী ওয়াসালস্নাম।

আবছার তৈয়বী: লেখক, গবেষক ও ইসলামী চিন্তাবিদ।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে