নারীদের ওপর সম্প্রতি যে জঘন্য হামলার খবর আসছে, তা গভীর উদ্বেগজনক বলে মন্তব্য করে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, এটি 'নতুন বাংলাদেশ'-এর যে স্বপ্ন আমরা দেখছি, তার সম্পূর্ণ বিপরীত। আমরা এ নতুন বাংলাদেশে নারী-পুরুষ সবার সমান অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে অঙ্গীকারবদ্ধ। আমরা আমাদের সব শক্তি প্রয়োগ করে এ অধিকার প্রতিষ্ঠা করব। তিনি নারী ও শিশুদের নিরাপত্তা রক্ষায় সর্বোচ্চ সজাগ থাকার আহ্বান জানান।
শনিবার রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে আন্তর্জাতিক নারী দিবস উদযাপন উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন।
পতিত স্বৈরাচার দেশে নৈরাজ্য সৃষ্টি করতে বিপুল পরিমাণ অর্থ বিনিয়োগ করছে বলে মন্তব্য করে তিনি বলেন, 'আমাদের এখন ততটাই সতর্ক থাকতে হবে, যেমনটা আমরা যুদ্ধের মতো পরিস্থিতিতে ছিলাম।'
নারী ও শিশুদের নিরাপত্তা রক্ষায় সর্বোচ্চ সজাগ থাকার আহ্বান জানিয়ে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, 'নিপীড়নের বিরুদ্ধে সামাজিক ঐক্য গড়ে তুলুন। একে অন্যের পাশে দাঁড়ান। একটি সুন্দর ও শান্তিপূর্ণ সমাজ গড়তে সরকারকে সহযোগিতা করুন।'
অধ্যাপক ইউনূস বলেন, 'আজকের বিশ্বে নারীরা যতটুকু অধিকার আর স্বাধীনতা চর্চা করতে পারছেন, এর পুরোটাই তাদের আন্দোলন-সংগ্রামের মাধ্যমে অর্জন করতে হয়েছে। আন্তর্জাতিক নারী দিবসের সূচনা হয়েছিল নারীদের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সংগ্রামের মধ্য দিয়ে। বাংলাদেশেও নারীরা ন্যায্য অধিকারের জন্য যুগ যুগ ধরে সংগ্রাম করে এসেছেন। তেভাগা থেকে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন, ভাষা আন্দোলন থেকে মুক্তিযুদ্ধে বাংলার নারী সমাজ সক্রিয় ভূমিকা রেখেছে। তিনি বলেন, 'ইতিহাসের অনেক বীর নারীদের আমরা ভুলে গেছি, তাদের অবদানের কথা জানি না। কিন্তু জুলাই কন্যাদের নেতৃত্ব ও আত্মত্যাগের কথা আমরা কিছুতেই ভুলে যেতে দেব না।'
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, 'জুলাই গণ-অভু্যত্থানে অংশ নেওয়া নারীরা বিভিন্ন সময় আমাকে তাদের সংগ্রাম ও আশা-আকাঙ্ক্ষার কথা জানিয়েছে। আমরা যে নতুন বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন দেখছি, নারীদের অংশগ্রহণ ও তাদের অধিকার নিশ্চিত করা ছাড়া তা সম্ভব হবে না। এই অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য নারীদের সঙ্গে পুরুষদেরও সহযোদ্ধা হয়ে কাজ করতে হবে।'
সমাজে নারীদের ন্যায্য স্থান প্রতিষ্ঠার জন্য পুরুষদের উৎসাহী হয়ে সহযোগিতায় এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়ে অধ্যাপক ইউনূস বলেন, 'নতুন বাংলাদেশ'-এ আমরা আমাদের প্রত্যাশিত পরিবারকে নতুনভাবে গড়তে চাই। যেটা সব মা-বাবা, ভাইবোনের নিশ্চিত ও স্বীকৃত অধিকারের পরিবার।'
প্রধান উপদেষ্টা আরও বলেন, 'আন্তর্জাতিক নারী দিবস আমাদের নতুন করে নারীদের সংগ্রামের ইতিহাস মনে করিয়ে দেয়, অনুপ্রেরণা আর সাহস জোগায়। সমাজে নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠায় যারা কাজ করছেন, তাদের প্রতি আহ্বান জানাই, যত বাধাই আসুক না কেন, ইতিহাস আমাদের যে সুযোগ করে দিয়েছে, সে সুযোগ আমরা পরিপূর্ণভাবে ব্যবহার করবই। আমরা নতুন বাংলাদেশ গড়বই। এই আমাদের প্রতিজ্ঞা।'
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, 'কয়েকদিন আগে তারুণ্যের শক্তিকে উজ্জীবিত করে নতুন বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে দেশজুড়ে আয়োজিত 'তারুণ্যের উৎসব-২০২' এ রেকর্ডসংখ্যক নারী ক্রিকেট, ফুটবল, কাবাডি, ব্যাডমিন্টন, ভলিবল, বাস্কেটবলসহ বিভিন্ন খেলায় অংশ নিয়েছেন। এ উৎসবে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে ২৭ লাখ ৪০ হাজার মেয়ে প্রায় ৩ হাজার খেলা ও সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডে অংশ নেন। সর্বস্তরের মানুষ দর্শকসারিতে বসে তাদের উৎসাহ জুগিয়েছেন। হাজার হাজার দর্শকের এমন উপস্থিতিই প্রমাণ করে, বাংলাদেশের সমাজে নারীর অধিকার ও অংশগ্রহণ প্রতিষ্ঠায় পুরুষদেরও স্বতঃস্ফূর্ত সমর্থন রয়েছে।'
নারীবিরোধী যে শক্তি মাথাচাড়া দেওয়ার চেষ্টা করছে, তা দেশের সব মানুষকে সঙ্গে নিয়ে অবশ্যই মোকাবিলা করা হবে বলে জানান প্রধান উপদেষ্টা। তিনি বলেন, 'আমাদের সমাজে এখনো এমন বহু মানুষ আছেন, যারা নিপীড়িত নারীদের পাশে দাঁড়ানোর বদলে তাদের খাটো করে দেখেন, অবজ্ঞার চোখে দেখেন। অথচ নারীর প্রতি সহিংসতা, নারী নির্যাতন প্রতিরোধ করতে, বৈষম্যহীন, সুন্দর বাংলাদেশ গড়তে নারীর পাশে দাঁড়ানো, তাদের সমর্থন জানানোর কোনো বিকল্প নেই।'
ড. ইউনূস বলেন, 'আমাদের সমাজে নারীকে খাটো করে দেখার এই দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টাতে হবে, তা না হলে আমরা জাতি হিসেবে এগোতে পারব না।'
অনুষ্ঠানে আন্তর্জাতিক নারী দিবস উপলক্ষে অদম্য নারী পুরস্কার তুলে দেন প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস। পুরস্কার পাওয়া নারীরা হলেন- অর্থনীতিতে শরিফা সুলতানা, শিক্ষা ও চাকরিতে হালিমা বেগম, সফল জননী মেরিনা বেসরা, জীবন সংগ্রামে জয়ী লিপি বেগম, সমাজ উন্নয়নে মো. মুহিন (মোহনা) এবং বিশেষ বিবেচনায় বাংলাদেশ নারী ক্রিকেট দল।
মহিলা ও শিশু বিষয়ক উপদেষ্টা শারমীন এস মুরশিদের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথির বক্তব্য রাখেন বাংলাদেশে জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়কারী গোয়েন লুইস এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক গীতি আরা নাসরিন।
অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য দেন মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মমতাজ আহমেদ।
পঞ্চগড় সীমান্ত
বিএসএফের গুলিতে
ফের বাংলাদেশি নিহত
পতাকা বৈঠক
পঞ্চগড় প্রতিনিধি
পঞ্চগড়ের ভিতরগড় সীমান্তে ভারতের অভ্যন্তরে বিএসএফের গুলিতে মো. আল আমিন (৩৬) নামের এক বাংলাদেশি নাগরিক নিহত হয়েছেন। লাশটি ভারতীয় পুলিশের কাছে হস্তান্তর করেছে বিএসএফ।
শুক্রবার রাত ৩টার পর পঞ্চগড় সদর উপজেলার অমরখানা ইউনিয়নের ভিতরগড় সীমান্তের ৭৪৪ নম্বর মেইন পিলারের ৭ নম্বর সাব-পিলার-সংলগ্ন এলাকার ওপারে ভারতের ভাটপাড়ায় কাঁটাতারের বেড়ার লিংক রোডসংলগ্ন এলাকায় এ ঘটনা ঘটে।
এদিকে, এ ঘটনায় শনিবার বেলা ১১টার দিকে ওই সীমান্তে বিজিবি-বিএসএফ ব্যাটালিয়ন কমান্ডার পর্যায়ে পতাকা বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে এ ঘটনার কড়া প্রতিবাদ জানিয়ে মরদেহ ফেরত চেয়েছে বিজিবি। নীলফামারী ৫৬ বিজিবি ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল শেখ মো. বদরুদ্দোজা এসব তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
নিহত মো. আল আমিন পঞ্চগড় সদর উপজেলার হাড়িভাসা ইউনিয়নের জিন্নাতপাড়া এলাকার সুরুজ আলীর ছেলে। তিনি সীমান্তে চোরাকারবারির সঙ্গে জড়িত ছিলেন বলে জানিয়েছে বিজিবি।
শেখ মো. বদরুদ্দোজা জানান, আল আমিন নামের ওই ব্যক্তি প্রায়ই সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে অনুপ্রবেশ করতেন বলে জানা গেছে। তিনি চোরাকারবারের সঙ্গে জড়িত এবং ভারতীয় চোরাকারবারিরা তাদের পৃষ্ঠপোষকতা করতেন। পাঁচ থেকে ছয় দিন আগে আল আমিন ভারতে গিয়েছিলেন বলে জানা গেছে। শুক্রবার রাত তিনটার পর ১০ থেকে ১৫ জন চোরাকারবারি ভারত থেকে গরু নিয়ে বাংলাদেশের দিকে আসছিলেন। এ সময় ভারতের ৪৬ বিএসএফ ব্যাটালিয়নের ভাটপাড়া বিএসএফ সদস্যরা তাদের লক্ষ্য করে গুলি ছোড়েন। এতে আল আমিন ভারতের অভ্যন্তরেই মারা যান। বিষয়টি জানতে পেরে বিজিবি ঘটনার প্রতিবাদ জানিয়ে পতাকা বৈঠক আহ্বান করে।
বদরুদ্দোজা বলেন, 'পতাকা বৈঠকে বিএসএফ দাবি করেছে, গরু নিয়ে চোরাকারবারিরা বাংলাদেশে আসার সময় বিএসএফ বাধা দিলে তারা বিএসএফের ওপর আক্রমণ করেন। এতে তাদের বিএসএফ সদস্যরা আহত হয়েছেন। পরে আত্মরক্ষার্থে তারা গুলি চালালে ওই ব্যক্তি মারা যায় বলে দাবি করেছে বিএসএফ।'
লাশ হস্তান্তরের বিষয়ে বদরুদ্দোজা বলেন, 'পতাকা বৈঠকে আমরা জানিয়েছি, কেউ অপরাধ করলে তার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। কিন্তু গুলি করে হত্যা কখনোই কাম্য নয়। এ ঘটনায় আমরা তীব্র প্রতিবাদ জানাই। পরে আমরা লাশ ফেরত চাইলে আইনগত প্রক্রিয়া শেষে বিজিবি ও বিএসএফের উপস্থিতিতে দুই দেশের পুলিশের মাধ্যমে লাশ হস্তান্তর করবে বলে জানিয়েছে বিএসএফ।'