দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম মৎস্য প্রজননক্ষেত্র হালদা নদী। প্রতিবছর এপ্রিল থেকে জুনে এ নদীতে রুই, কাতলা, মৃগেল, কালিবাউশের মতো কার্প জাতীয় মা মাছ ডিম ছাড়ে। দেশের কার্প জাতীয় মাছের সবচেয়ে বড় প্রাকৃতিক প্রজননকেন্দ্র হিসেবে পরিচিত এই নদীর রুই, কাতলা, মৃগেল ও কালিবাউশ যেমন দ্রম্নত বাড়ে, স্বাদেও তেমনি অতুলনীয়। দেশের অন্যান্য নদীর রুইজাতীয় মাছের চেয়ে হালদার মাছ দ্বিগুণেরও বেশি হারে বাড়ে, বড়ও হয় খুব তাড়াতাড়ি। হালদার মাছের স্বাদ অন্যান্য মাছের চাইতে বেশি। যে কারণে এখানকার মাছের পোনার দাম দেশের অন্যান্য রুইজাতীয় মাছের পোনার চেয়ে অনেক গুণ বেশি।
একইসঙ্গে হালদায় রয়েছে প্রচুর গাঙ্গেয় ডলফিন। এসব কারণে হালদার খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্বব্যাপী। ডিম ছাড়ার মৌসুম আসলেই নদীর পাড়ে ভিড় জমান মিডিয়াসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের রেণু, পোনা ও মৎস্য চাষি। সৃষ্টি হয় একটি উৎসবমূখর পরিবেশের। তবে বিগত পাঁচ বছর ধরে হালদা নদীর পশ্চিমাংশে বেঁড়িবাধের ফলে ভিড় করছেন পর্যটক। সারাবছর বিশেষ করে শুক্রবার এলেই পর্যটকদের উপচেপড়া ভিড় থাকে। হাটহাজারী উপজেলার উত্তর মাদার্শা নৌ পুলিশ ফাঁড়ি প্রকাশ ফাঁড়ি বিট এলাকায় দুপুর গড়িয়ে বিকেল এলেই পর্যটকদের আনাগোনা বেড়ে যায়। উপজেলার বিভিন্ন এলাকা থেকে নানা বয়সী পর্যটক আসেন হালদাকে এক নজর দেখতে। বন্ধের দিন বিকেলে নৌকায় বসে পরিবার পরিজন কিংবা বন্ধু বান্ধবসহ একটু বেড়াতে কিছুটা সময় কাটাতে। প্রাকৃতিক পরিবেশে গড়া ওঠা নদীর পাড়ে সারি সারি বস্নকের উপর অংশে পাঁচ ছয় ফুট পর পর বসার স্থান করে দেওয়ায় বৃদ্ধি পেয়েছে সৌন্দর্য্য। পর্যটকরা এসেই যে যার মত বসে নদীর অপরুপ সৌন্দর্য্য উপভোগ করেন। কেউবা নদীতে ডিঙ্গি নৌকা নিয়ে ঘুরতে নেমে পড়েন। ব্যস্ত হয়ে পড়েন সুন্দর কাটানো সময়গুলোকে বেঁধে রাখতে সেলফিবাজি কিংবা ফটোশেসনে।
তবে পর্যাপ্ত ফাস্টফুড, চায়ের দোকান, চটপটি ফুসকার দোকান না থাকায় ভ্রমণের পরিপূর্ণ স্বাদ পান না তারা। ফাস্টফুড, বাচ্চাদের খাবার, খেলনা, বিনোদন পার্ক, ছাউনি, বৈদু্যতিক আলোর ব্যবস্থা কিছুই নেই। বিশেষ করে নেই কোন শৌচাগার, টয়লেট। পাবলিক টয়লেট না থাকায় পর্যটক নারী পুরুষদের অবর্ণনীয় দুর্ভোগের সম্মুখিন হতে হয়। ফলে নদীর সৌন্দর্য্য উপভোগে একবার ভ্রমণে আসলেও দ্বিতীয়বার আসতে চান না কেউ। তাই সামান্য উদ্যোগ নিলেই হালদা নদী হতে পাড়ে পর্যটকদের জনপ্রিয় একটি পর্যটক কেন্দ্র।
সরেজমিনে দেখা গেছে, ঘন কুয়াশায় হালদার পাড় ঢেকে থাকলেও নারী পুরুষ অনেক পর্যটক ভিড় করছেন হালদার পাড়ে। কুয়াশার মাঝেও নদীর সৌন্দর্য্য অপরুপ দৃশ্য তাদের ঘরে আটকিয়ে রাখতে পারেনি। কেউ বাইক নিয়ে কেউবা প্রাইভেট কিংবা ভাড়া করা গাড়িতে করে বন্ধুবান্ধব, পরিবার নিয়ে এসেছেন বেড়াতে। এসেই অনেকে ভাসমান দোকানের দিকে ছুটছেন এক কাপ গরম চা খেতে। কেউ কেউ পাড়ে অপেক্ষমান ডিঙ্গি নৌকায় ঘুরতে নেমে পড়েন। কেউ কেউ হাঁটাহাঁটি করছেন পাড়ে। তবে ঘোরাঘুরির পর অনেকে (নারী) চটপটি কিংবা ফুসকার দোকান খুঁজলেও না পেয়ে হতাশ। অনেকে ছোট্ট বাচ্চার খেলনা তালাশ করেও পাননি। দোকানের পরিবেশ ভালো না লাগা কিংবা পছন্দের ফাস্টফুড না পাওয়ায় খালিমুখেই ফিরে যাচ্ছেন অনেকে। ঘন কুয়াশা থেকে রেহাই পেতে খোলা আকাশ ছাড়া বসার কোনো স্থান পাননি।
বাচ্চাদের বিনোদনে কোনো পার্ক, খেলনার সরঞ্জাম না পেয়ে হতাশ নগরীর বায়েজীদ থেকে পরিবার নিয়ে আসা ব্যাংকার শফিকুর রহমান প্রতিবেদককে বলেন, আবহাওয়া ভালো না থাকলেও বন্ধের দিনে পরিবার নিয়ে ঘুরতে এসেছেন। ভেবেছিলেন এখানে অন্যান্য পর্যটন কেন্দ্রের মত অনেক কিছু থাকবে। কিন্তু নদী আর কিছু নৌকা ছাড়া বিনোদনের কিছুই নেই। যে পরিমান পর্যটকের আনাগোনা সে তুলনায় কিছুই নেই। হাটহাজারী পৌর এলাকার বাসিন্দা সজল কান্তি নাথ বলেন, শশুড়বাড়ির লোকজন নিয়ে এসেছি নৌকায় ঘোরাঘুরির পর ফাস্টফুড খেতে চেয়েছি কিন্তু দুই-একটি ভাসমান দোকান ছাড়া আর কিছু নাই। আক্ষেপ করে বলেন, ছোট্ট মেয়েকে নিয়ে নৌ পুলিশের টয়লেটে যেতে হয়েছে। হালদার খ্যাতি চারদিকে কিন্তু পর্যটকদের কোন ব্যবস্থা নেই এখানে। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের এটা নিয়ে ভাবা উচিৎ।
হাটহাজারী সরকারি কলেজের শিক্ষার্থী শিহাব ও ফতেয়াবাদ কলেজের ফয়সাল বলেন, বেঁড়িবাধের পর বিগত পাঁচ বছর ধরে প্রতিদিন অসংখ্য পর্যটক আসেন হালদা নদীতে ঘুরতে। কিন্তু এখানে ভালো উন্নতমানের দোকান, বিনোদন পার্ক, পাবলিক টয়লেট, দর্শনীয় বসার সিট, বাচ্চাদের খেলনার কোন সরঞ্জাম না থাকায় পর্যটকরা হতাশ হয়ে ফিরে যান।
ভাসমান দোকানদার স্থানীয় আলমগীর (৫৭), সাইদুল আলম (৫৫), মো. গোলাফ (৬৭) বলেন, প্রতিদিন বিকেলে পর্যটকের আনাগোনা থাকলেও শুক্রবার বেশি হয়। যদি এখানে বিনোদন পার্ক, শিশু পার্ক বিশেষ করে পুলিশ ফাঁড়ির মুখে দুটি ও উত্তরে দুটি করে পাবলিক টয়লেটের ব্যবস্থা করে তাহলে পর্যটকের সংখ্যা আরও বাড়বে।
নৌকার মাঝি বারিঘোনা এলাকার আবু তাহের (৫৫) বলেন, এ ঘাটে ৩১টি নৌকা আছে। মাদার্শা, উর্কিরচর, বারিঘোনা, খলিফারঘোনাসহ বিভিন্ন এলাকা থেকে মাঝিরা নৌকা নিয়ে আসেন পর্যটকদের ভ্রমনে। শুক্রবারে প্রতিজনের ৫শ' থেকে ৮ শ' টাকা উপার্জন হয়। যদি সুন্দর করে এ স্থানকে সাজানো হয় তাহলে পর্যটকের সংখ্যা বাড়বে। নৌ পুলিশের ইনচার্জ এএসআই রমজান বলেন, 'কি আর করা আসলে তো ফিরিয়ে দিতে পারিনা। তবে অনেক সময় বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়তে হয়। হালদার এ পাড়কে বিনোদনের জন্য একটু সুসজ্জিত করলে জনপ্রিয় পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে উঠবে এতে অবিশ্বাসের কিছু নাই।'
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এবিএম মশিউজ্জামান বলেন, দুই থেকে একদিনের মধ্যে পরিদর্শন করবেন।