সোমবার, ১২ মে ২০২৫, ২৯ বৈশাখ ১৪৩২
'স্বজনপ্রীতিতে ঘর বরাদ্দ, প্রকৃত গৃহহীনরা বঞ্চিত

আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘর বেচা-কেনার হিড়িক!

সুব্রত কুমার ফৌজদার, ডুমুরিয়া (খুলনা)
  ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০০:০০
আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘর বেচা-কেনার হিড়িক!
আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘর বেচা-কেনার হিড়িক!

খুলনার ডুমুরিয়ায় আশ্রয়ন-২ প্রকল্পের ঘর বেচা-কেনার অভিযোগ উঠেছে। মোটা অংকের টাকা নিয়ে ঘরের দখল হস্তান্তর করছে সুবিধাভোগীরা। কেউ কেউ ঘর ভেঙে জায়গা দখলের চেষ্টাও করছে। কিছু ঘর প্রভাবশালীরা দখলে নিয়ে তালা ঝুলিয়েছে। তবে এ নিয়ে সরকারের তেমন একটা নজর নেই প্রকল্পের দিকে!

জানা যায়, ২০২১-২২ ও ২৩ অর্থ বছরে চার ধাপে ডুমুরিয়া উপজেলায় গৃহহীন এবং বাস্তচু্যত ১ হাজার ১৫৫ পরিবারের মাঝে জমিসহ ঘর হস্তান্তর করে আওয়ামী লীগ সরকার। ঘরগুলো নির্মাণে ২১ কোটি ৮৩ লাখ ১৫ হাজার টাকা ব্যয় দেখানো হয়। প্রতি ঘরের জন্য ২ শতাংশ জমি বরাদ্দ দেওয়া হয়। অর্থাৎ ২৩.১ একর সরকারি সম্পতির উপর এ ঘর নির্মাণ করা হয়। এসব ঘর নির্মাণ থেকে শুরু করে দলিল হস্তান্তর পর্যন্ত ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। গৃহহীন পরিবারকে ঘর দেওয়ার কথা থাকলেও সচ্ছল ব্যক্তিদের নামে ঘর বরাদ্দ দেওয়া হয়। আ'লীগ নেতাদের সরাসরি হস্তক্ষেপ ও স্বজনপ্রীতির কারণে প্রকৃত গৃহহীন পরিবার আড়ালে পড়ে এবং ঘর পায় সচ্ছল ব্যক্তিরা! ফলে প্রকল্পের অধিকাংশ ঘর ফাঁকা থাকে। ঘর দখলে রেখে তারা অন্যত্র বসবাস করে। যে কারণে বেচা-কেনা হচ্ছে। নিরানব্বই বছরের বন্দোবস্ত দলিলে ১৩ নং শর্তে স্পষ্ট উলেস্নখ আছে, জমির সমস্ত বা কোন অংশ বিক্রয়, দান বা অন্য কোন প্রকার হস্তান্তর কিংবা বন্টননামা বা বাটোয়ারা করা যাবে না। এসব নিয়মনীতিকে উপেক্ষা করে অবাদে সরকারি সম্পত্তি বেচা-কেনা বা দখল হস্তান্তর করা হচ্ছে।

কাঁঠালতলা এলাকায় আশ্রয়ন প্রকল্পে ১০৫টি ঘর রয়েছে। ইতিমধ্যে ১৫-২০টি ঘর বেচা-কেনা হয়ে গেছে। ৪নং ঘর প্রাপ্ত রহিমার বাড়ি রোস্তমপুর। তার কাছ থেকে ঘরের দখল নিয়েছেন ফরিদা খাতুন। তার বাড়ি নতুন রাস্তা এলাকায়। ফরিদা জানান, ঘরটি ২ বছর আগে তিনি ৩০ হাজার টাকায় কিনেছেন। ১৩ নম্বর ঘরে থাকেন ফাতেমা। তিনি জানান, প্রথমে যারা ঘর পেয়েছিলেন তাদের মধ্যে অধিকাংশই বিত্তবান লোক। যে কারণে ঘর বিক্রি করে দিচ্ছেন। ৫৬ নম্বর ঘরটি দখল হস্তান্তর হয়েছে। এর নতুন মালিক সুভাশীনি এলাকার শহিদুল ইসলাম। তিনি ৩০ হাজার টাকায় কিনেছেন। এরআগে ঘরটি চুকনগরের জনৈক মিন্টুর ছিল।

৭২নং ঘরের মালিক চাকুন্দিয়া গ্রামের আব্দুল কাদের মোল্যা জানান, গত ৫ আগস্টে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর ৬৬নম্বর ঘরটি তালা বদ্ধ করেছেন গোবিন্দ কাটি গ্রামের জনৈক ইব্রাহিম নামে এক ব্যক্তি। ঘরটিতে বর্তমান কেউ থাকে না। অনৈতিক সুবিধা নিতে তিনি (ইব্রাহিম) ঘরে তালা বদ্ধ করেছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। এদিকে ৩ মাসের বিদু্যত বিল বকেয়া থাকায় আশ্রয়ন প্রকল্পের ২টি যান্ত্রিক ঢেঁকি ৬-৭ মাস বন্ধ রয়েছে।

মঙ্গলবার সকালে সাজিয়াড়া আবাসনে খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, ৩০টি ঘরের মধ্যে প্রায় অর্ধেক ঘর বেচা-কেনা হয়ে গেছে। ৩নং ঘরের মেরিনা বেগম জানান, আমাদের কোন জায়গা-জমি নেই। সরকার ঘর দেয়ার পর ৫ সদস্যের পরিবার নিয়ে একঘরে বসবাস করে আসছি। এখানে ২, ৪ ও ৫নংসহ প্রায় ১২-১৪টি ঘর বেচা-কেনা হয়ে হয়েছে। ৪নং ঘরে বর্তমান থাকেন হতদরীদ্র রেশমা খাতুন। তিনি জানান, ৩০ হাজার টাকা দিয়ে মাসুমা বেগমের নিকট থেকে ৩শ' টাকার নন-জুডিশিয়াল স্ট্যাম্প করে ঘরটি কিনেছেন।

এদিকে বরাতিয়া এলাকায় একটি ঘর ভেঙ্গে জায়গা দখলের পায়তারা করছে। মরিয়ম বেগম জানান, ফাও ঘর তাই নিয়েছেন। এখন প্রয়োজন হচ্ছে তাই ভেঙে বড় করে করছেন। গত ২ বছর আগে ভদ্রা নদীর তীরে হযরত আলীর নামে ঘরটি বরাদ্দ হলেও তিনি দলিল বুঝে পাননি এখনো।

ডুমুরিয়ার সমাজসেবক এসএম আলমগীর কবির জানান, অপরিকল্পিতভাবে নিচু জায়গায় আবাসনের ঘর নির্মাণ হয়েছে। বর্ষাকালে অধিকাংশ ঘর পানিতে নিমজ্জিত হয়। তাছাড়া ঘর নির্মাণে অতি নিম্নমানের সরঞ্জামাদি ব্যবহৃত হয়েছে। তিনি বলেন, 'সরকারের উদ্দেশ্য ছিল ভালো। কিন্তু দলের নেতাকর্মীর স্বজনপ্রীতি ও দলীয়করণের কারণে সচ্ছল ব্যক্তিদের ঘর দেওয়ায় সরকারের আসল উদ্দেশ্য ব্যাহত হয়েছে। আর প্রকৃত গৃহহীনরা সরকারের এ সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়েছে।'

ভূমি অফিস জানায়, মুজিব শতবর্ষ উপলক্ষে আশ্রয়ন প্রল্পের আওতায় ৪টি ধাপে উপজেলার ধামালিয়া ইউনিয়নে ৩৮টি, রঘুনাথপুরে ৭টি, রুদাঘরায় ১০৮টি, খর্ণিয়ায় ৩২টি, আটলিয়ায় ৩১২টি শোভনায় ৩২৫টি, সাহসে ৫টি, ভান্ডারপায় ১৫৭টি, ডুমুরিয়া সদর ইউনিয়নে ৮৯টি ও রংপুর ইউনিয়নে ৮২টি গৃহ নির্মাণ করা হয়। উপজেলায় মোট ১১৫৫টি ঘরের মধ্যে ৮৮০টি ঘরের দলিল হস্তান্তর করা হয়েছে।

এ বিষয়ে ডুমুরিয়া সহকারি কমিশনার (ভূমি) ও ভারপ্রাপ্ত ইউএনও মো. আসাদুল ইসলাম জানান, সরকার ভূমিহীন হিসেবে যাদের ঘর ও জমি দিয়েছেন তারা কোনভাবেই হস্তান্তর বা ভাড়া দিতে পারবে না। বন্দোবস্তকৃত দলিলে সু-স্পষ্ট তা বলা আছে। সুতরাং যাদের ঘর দেওয়া হয়েছে তারা ব্যাতিত অন্য কেউ ঘর দখলে থেকে বসবাস করা আইনত অবৈধ। তদন্তে প্রমাণিত হলে ওইসব দলিল বাতিল হতে পারে। তিনি বলেন, ঘর দখল বা বে-দখল করার সাথে যারাই জড়িত থাকুক না কেন তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে