বৃহস্পতিবার, ২২ মে ২০২৫, ৮ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

অপরূপ সৌন্দর্যে ঘেরা কক্সবাজার

জাবেদ আবেদীন শাহীন, কক্সবাজার
  ০৯ জানুয়ারি ২০২১, ০০:০০
অপরূপ সৌন্দর্যে ঘেরা কক্সবাজার
কক্সবাজারে নৈসর্গিক সৌন্দর্যে ভরা মনোমুগ্ধকর সাগরের নীল জলরাশি ও ঢেউয়ের গর্জন এবং দীর্ঘতম সমুদ্রসৈকত -যাযাদি

সারি সারি সবুজ ঝাউবীথি, পাহাড়, ঝর্ণা, আর নরম বালির মাঝে দীর্ঘ অপরূপ সৈকত কক্সবাজার। সাগরের নীল জলরাশি আর ঢেউয়ের গর্জন সাথে হিমেল হাওয়ায় মনোমুগ্ধকর এক পরিবেশ। নৈসর্গিক সৌন্দর্যে ভরা পৃথিবীর দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকত কক্সবাজার। সৃষ্টিকর্তা যেন রূপসী বাংলার সব রূপ ঢেলে দিয়েছে বালুর আঁচলে। ১২০ কিলোমিটারের দীর্ঘ দর্শনীয় সমুদ্র সৈকতের কারণে প্রতি বছর দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ভ্রমণপিয়াসী পর্যটক প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি কক্সবাজারে ঘুরতে আসে। নাজিরার টেক থেকে শুরু করে শাহপরীর দ্বীপ পর্যন্ত বিস্তৃত সৈকতের বেলাভূমি। ভ্রমণকারীরা কক্সবাজার থেকে টেকনাফ পর্যন্ত সাগরের পাড় ঘেঁষে বয়ে যাওয়া মেরিন ড্রাইভ প্রাণবন্ত হয়ে উপভোগ করে।

সুদীর্ঘ সমুদ্র সৈকত, দিগন্ত বিস্তৃত নীল সমুদ্র, বড় পাহাড়, বৌদ্ধ মন্দির আর প্যাগোডাসহ নানান আকর্ষণ নিয়ে গড়া পর্যটন রাজধানী কক্সবাজারে পা রাখলেই সাগরতীরে বেড়াতে মন চাইবে। এই শীত মৌসুমে সাগরের লোনা জলে রৌদ্রস্নান আর সূর্যাস্তের নয়নাভিরাম দৃশ্য অবলোকনসহ শরীরের প্রশান্তি জুড়াবে। ভোরের স্নিগ্ধ আলোয় সমুদ্র সৈকতের ভিন্ন রূপ আর সন্ধ্যার পরে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে। বিশেষ করে পূর্ণিমার রাতে আকাশের উজ্জ্বল চাঁদ সমুদ্রের জলে প্রতিফলনের দৃশ্য আনন্দের মাত্রাকে বহুগুণে বাড়িয়ে দেয়। কক্সবাজার জেলায় রয়েছে মাতামুহুরী, বাঁকখালী, রেজু, কোহালিয়া ও নাফ নদী। উপভোগ করা যায় মহেশখালী, কুতুবদিয়া, সোনাদিয়া, শাহপরীর দ্বীপ ও সেন্টমার্টিন দ্বীপের প্রাকৃতিক পরিবেশ।

1

সিলেটের পর্যটক সামাদ হোসাইন ও আরিফা বিনতে হক বলেন, ছেলে-মেয়েদের বার্ষিক পরীক্ষা শেষ হওয়ার পর কক্সবাজারে বেড়াতে এসেছেন। শীতে স্বচ্ছ নীল জলরাশির বিশাল সমুদ্র সৈকত। প্রকৃতি আর সময়ের এত আয়োজন একসঙ্গে উপভোগের সুযোগকে হাতছাড়া করতে চায়। তাইতো পরিবার-পরিজন নিয়ে করোনার মধ্যেও সবাই ছুটে এসেছেন প্রিয় শহর কক্সবাজারে। এর মধ্যে তারা গাড়ি ভাড়া করে মেরিন ড্রাইভে ঘুরে এসেছেন। খুব ভালো লেগেছে চমৎকার প্রাকৃতিক সবুজ পরিবেশ।

এদিকে, শুধু সমুদ্র সৈকতই নয়, কক্সবাজারে দর্শনীয় স্থানগুলো হলো বার্মিজ মার্কেট, হিলটপ রেস্টহাউস, লাবনী পয়েন্ট, পাহাড় ঝর্ণা হিমছড়ী, পাথুরে সৈকত ইনানী, নাইক্ষ্যংছড়ী লেক ও ঝুলন্ত ব্রিজ, রামু বৌদ্ধ বিহার, রাবার বাগান, ডুলাহাজরা সাফারি পার্ক, কলাতলী বীচ, লং মেরিন ড্রাইভ, রেডিয়েন্ট ফিশ অ্যাকুয়ারিয়াম, দরিযানগর, নয়নাভিরাম প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিন, সোনাদিয়া দ্বীপ, পাহাড়ি দ্বীপ মহেশখালী, রামু লামার পাড়া বৌদ্ধ ক্যাঙ, কক্সবাজার বৌদ্ধ মন্দির, সোনাদিয়া দ্বীপ, ইতিহাসখ্যাত কানারাজার গুহা, রাখাইন পলস্নী ভ্রমণপিপাসু পর্যটককে আকৃষ্ট করে। তাছাড়া নানারকম জিনিসের পসরা সাজিয়ে সৈকতসংলগ্ন এলাকায় রয়েছে ছোট-বড় অনেক দোকান যা পর্যটকদের বাড়তি আকর্ষণ করবে। কেনাকাটার জন্য রয়েছে বেশকিছু ভিন্ন আঙ্গিকের মার্কেট। বিশেষ করে প্রসিদ্ধ বার্মিজ মার্কেটে রয়েছে রাখাইন রমণীদের দ্বারা পরিচালিত বিভিন্ন রকম হস্তশিল্প ও মনোহরি পণ্যের দোকান। এছাড়া পর্যটকদের জন্য গড়ে উঠেছে ঝিনুক মার্কেট, ঝিনুক শিল্পের রকমারি জিনিসপত্রের প্রধান বিক্রয় ও বিপণন কেন্দ্র। তাছাড়া সমুদ্র সৈকতে রয়েছে ঘোড়ায় চড়ার ব্যবস্থা, স্পিডবোট, ওয়াটার বাইক, মোটরবাইক,

প্যারাসাইকেলিং, সার্ফিংসহ নানা বিনোদনের ব্যবস্থা। বিশেষ করে কক্সবাজার শহর থেকে লং মেরিন ড্রাইভ সড়কে যাওয়ার পথে বেশ কয়েকটি প্রাকৃতিক ঝর্ণা, সমুদ্র আর পাহাড়সহ দর্শনীয় স্থানের দেখা মিলবে। সাথে চলার পথে সমুদ্রের গর্জন, পাখির কূজন ও পাহাড়ি ঝর্ণার প্রাকৃতিক পরিবেশ।

খুলনার পর্যটক আবদুর রহমান জানান, 'করোনা একটা ভীতিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে। দীর্ঘদিন কোথাও যাওয়া সম্ভব হয়নি। বাড়ির সবাই আতঙ্ক নিয়ে কাটিয়েছি দীর্ঘ ৯ মাস। বলতে গেলে এক প্রকার গৃহবন্দি ছিলাম। তাই মানসিক প্রশান্তির আশায় পরিবারের সবাইকে নিয়ে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে সৈকতের নোনাজলে স্নান করতে এসেছি। অসম্ভব রকমের ভালো লাগছে কেনাকাটা, পর্যটন স্পটগুলোতে ঘুরাঘুরি, সামুদ্রিক মাছের তৃপ্তিদায়ক খাবার, আড্ডা, পরিবারসহ খুবই মজা করছি। কক্সবাজারে না আসলে খুব মিস হতো বলে মনে করি।'

কক্সবাজার হোটেল-মোটেল-গেস্ট হাউস মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক আবুল কাশেম সিকদার বলেন, পর্যটকদের আকৃষ্ট করতে বিভিন্ন ধরনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। পর্যটন মৌসুম শুরু হয়েছে। কক্সবাজারে প্রায় ৫ শত ছোট-বড় হোটেল, রিসোর্ট, গেস্ট হাউজ আছে। তাদের হোটেল অনেক আগে থেকে প্রায় সব রুম বুকিং আছে। মূলত প্রতি বছর নভেম্বর/ডিসেম্বর মাস থেকে পর্যটন মৌসুম শুরু হয় সেটা চলে মার্চ মাস পর্যন্ত ধারাবাহিকতায়। আশা করছেন এবার ব্যবসা ভালো হবে।

কক্সবাজার রেস্তোরাঁ মালিক সমিতির সভাপতি নইমুল হক চৌধুরী টুটুল বলেন, তাদের সমিতির প্রত্যেক রেস্টুরেন্টকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে যাতে করে কোনো পর্যটক যেন খাবার বেলায় হয়রানি না হয়। যে কোনো খাবারের দাম যেন বেশি রাখা না হয়। বিশেষ করে আচরণগত বিষয়ে বেশি সতর্ক করা হয়েছে।

এদিকে, কক্সবাজার ভ্রমণে গিয়ে পর্যটকদের বেশি আকর্ষণ থাকে সামুদ্রিক বিভিন্ন মাছের মেনু্যর প্রতি। বিশেষ করে চিংড়ি, রূপচাঁদা, লাইট্যা, কোরাল, টুনা ফিস, ছুরি মাছসহ মজাদার হরেক রকম শুটকি মাছের ভর্তার প্রতিই পর্যটকদের আকর্ষণ বেশি থাকে। শহরের সুগন্ধা বিচের পাশেই আছে তাজা সামুদ্রিক মাছের ভ্রাম্যমাণ দোকান। সন্ধ্যায় বসে দোকানে পছন্দমতো রকমারি সামুদ্রিক ভাজা মাছের স্বাদ নেওয়া যায়। দাম ঠিক করে পছন্দমত মাছ অর্ডারের কিছুক্ষণ পরেই মিলবে ধোঁয়া ওঠা গরম ভাজা মাছ। যেন লোভনীয় মজাদার খাবার। সামুদ্রিক মাছের মধ্যে আছে চিংড়ি, লবস্টার, টুনা, রূপসা, সুস্বাদু রূপচাঁদা, স্যামন, কোরাল, লইট্টা ও কাঁকড়াসহ হরেক রকম তাজা মাছ। এ ছাড়াও রাতে সমুদ্রের পাড়ে আড্ডার মাঝে বিভিন্ন ধরণের সামুদ্রিক বড়/মাঝারি মাছ মাছের বারবিউ খাওয়া যায়।

কক্সবাজারে রয়েছে আন্তর্জাতিকমানের বেশ কয়েকটি হোটেল, মোটেল ও রিসোর্ট। এছাড়া রয়েছে ছোট-বড় বিভিন্ন মানের অনেক রিসোর্ট, হোটেল ও বোর্ডিং হাউস। বর্তমানে কক্সবাজারে হোটেলগুলোতে প্রায় দুই লাখ পর্যটকের ধারণক্ষমতা আছে। তাই বুকিং না দিয়ে গেলেও হোটেল পাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। কক্সবাজারে ভ্রমণ করতে আসার জন্য ঢাকা থেকে সরাসরি গাড়ি চলে। এছাড়াও চট্টগ্রাম, খুলনা, সিলেট থেকে কক্সবাজারে সরাসরি বাস সার্ভিস আছে। ঢাকার ফকিরাপুল, আরামবাগ, মতিঝিলসহ বেশ কয়েকটি স্থানে সরাসরি কক্সবাজারের উদ্দেশে বাস ছেড়ে যায়। এছাড়া বিমানেও কক্সবাজারে যাওয়া যায়। কক্সবাজারের ভ্রমণের উৎকৃষ্ট সময় হলো অক্টোবর থেকে মার্চ মাস পর্যন্ত। এ সময়টায় বৃষ্টি কম হওয়ায় এবং গরম কম থাকায় পর্যটকদের ভিড় বেশি থাকে। এই সময়টাকে পিক সিজন বলে থাকে। তাই এ সময়ে ভ্রমণের পস্ন্যান করলে অবশ্যই আগে থেকে আপনার কাঙ্ক্ষিত হোটেলে বুকিং দিয়ে যেতে হয়।

কক্সবাজার টু্যরিস্ট পুলিশের এসপি জিলস্নুর রহমান বলেন, কক্সবাজারের প্রশাসন পর্যটকদের নিরাপত্তা নিয়ে বেশ সচেতন আছে। সমুদ্র সৈকতের লাবনী, সুগন্ধা, কলাতলী চত্বর থেকে শুরু করে প্রতিটি পয়েন্টে টু্যরিস্ট পুলিশ কাজ করছে। তাদের নিচ্ছিদ্র নিরাপত্তা দিতে সব ধরনের নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।

কক্সবাজারের বিদায়ী জেলা প্রশাসক মো. কামাল হোসেন বলেন, কক্সবাজার পর্যটন শিল্প সম্ভাবনাময়। শীত মৌসুমে পর্যটকের চাপ বাড়ায় সমুদ্র সৈকত ও পর্যটন স্পটগুলোতে সার্বক্ষণিক বাড়তি নিরাপত্তার ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। কক্সবাজারে করোনার সংক্রমণ রোধে পর্যটকদের মাস্ক ব্যবহার বাধ্যতামূলক করতে মাঠে নেমেছে জেলা প্রশাসন ও পুলিশ। করোনার দ্বিতীয় ঢেউ মোকাবিলায় সৈকতের সবকটি পয়েন্টে সবাইকে মাস্ক ব্যবহার করতে পরামর্শ দেওয়া হয়েছে বলে জানান তিনি।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে