ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ উপজেলার বারবাজার। উপজেলা শহর থেকে ১১ কিলোমিটার দক্ষিণে আর যশোর থেকে ১৭ মাইল উত্তরে অবস্থিত। ঢাকা-খুলনা মহাসড়কের দুই ধারে শ' শ' পুকুর ও দীঘির স্বচ্ছ পানির ক্ষুদ্র ঢেউ আর বুড়ি ভৈরব নদীর তীরে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যঘেরা ঐতিহাসিক ১৯ মসজিদ পরিবেষ্টিত এই বারবাজার। জানা যায়, বারজন আউলিয়ার নামানুসারে বারবাজার নামকরণ হয়। তারা হলেন-এনায়েত খাঁ, আবদাল খাঁ, দৌলত খাঁ, রহমত খাঁ, শমসের খাঁ, মুরাদ খাঁ, হৈবত খাঁ, নিয়ামত খাঁ, সৈয়দ খাঁ, বেলায়েত খাঁ ও শাহাবাজ খাঁ।
ইতিহাস থেকে জানা যায়, বঙ্গ বিজয়ী বীর ইখতিয়ার উদ্দিন মোহাম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজি নদীয়া দখলের পর নদীয়ার দক্ষিণ বা দক্ষিণ-পূর্বে বিস্তীর্ণ অঞ্চলের দিকে মনোযোগী না হয়ে উত্তর দিকে বেশি আকৃষ্ট হয়ে পড়েন। ফলে তার বিজিত রাজ্য উত্তর দিকে প্রশস্ত হতে থাকে। পরে সামছুদ্দিন ইলিয়াস শাহের পৌত্র নাসির উদ্দিন মাহমুদ শাহের শাসনামলে (১৪৪২-১৬৬৮) যশোর ও খুলনার কিছু কিছু অংশ তার রাজ্যভুক্ত হয়। এদিকে, ওই অঞ্চলে বিজয়ের গৌরব অর্জন করেন স্বনামধন্য আওলিয়া হজরত খান জাহান আলী। তিনি ১৪৫৯ সালে (৮৬৩ হিজরি) ২৩ অক্টোবর ইহধাম ত্যাগ করেন। তিনি এক সময় নিজের আত্মরক্ষার্থে একটি ক্ষুদ্র সেনাবাহিনীর অধিনায়ক হয়ে কুষ্টিয়া জেলার দৌলতগঞ্জ প্রবেশ করেন। সেখান থেকে বৃহত্তর যশোর জেলার কোটচাঁদপুর উপজেলার হাকিমপুর হয়ে বারবাজার অভিমুখে রওনা দেন। পথিমধ্যে জনসাধারণের পানীয় জলের তীব্র কষ্ট দেখে তিনি এ অঞ্চলে অগণিত দীঘি আর পুকুর খনন করেন। কথিত আছে, একই রাতে এসব জলাশয় খনন করা হয়েছিল। ফলে বারোবাজার অঞ্চলে ৮৪ একর পুকুর ও দীঘি এখনো বিদ্যমান।
বারবাজারে প্রত্নতত্ত্ব নিদর্শন : বারবাজারে সাতগাছিয়া মৌজায় আদিনা মসজিদ অবস্থিত। এটি ৩৫ গম্বুজবিশিষ্ট মসজিদ। এটি ১৯৯২ সালের মসজিদটি আংশিক সংস্কার করা হয়। সাতগাছিয়া মৌজায় কোটালী মসজিদ ও ঘোপপাড়া মৌজায় ঘোপ ও আড়পাড়া ঢিবি অবস্থিত। এটি রওজা শরীফ। সাদিকপুর মৌজায় চোরাগদানি মসজিদ এবং বারবাজার মৌজায় রয়েছে জোড় বাংলা মসিজদ। এটি পুনঃসংস্কার করা হয় ১৯৯২ সালে। এখন এখানে স্থানীয়রা নামাজ পড়েন। তবে পাশে একটি দীঘি আছে যা সংস্কার করা প্রয়োজন। সাদিকপুর মৌজায় মনোহর ১৬ গম্বুজ মসজিদ এবং বারবাজার মৌজায় ৬ গম্বুজবিশিষ্ট গলাকাটা মসজিদ অবস্থিত। বেলাট দৌলথপুর মৌজায় নামাজগাজ রওজা শরিফ অবস্থিত। একই মৌজায় ৪ গম্বুজবিশিষ্ট গোড়ার মসজিদ অবস্থিত। এখানেও স্থানীয়রা নামাজ পড়েন। অনেক সময় এখানে মনের বাসনা পূরণে মানত করে সাধারণ মানুষ। হাসিলবাগ এলাকায় দমদম জাহাজঘাটা ও সেনানিবাস ও নদীবন্দর ছিল। বেলাট দৌলতপুর মৌজায় ১৬ গম্বুজবিশিষ্ট পীর পুকুর মসজিদ অবস্থিত। মিঠাপুকুর এলাকায় নুনগোলা মসজিদ, হাসিলবাগ এলাকায় শুকুর আলী মসজিদ এবং বেলাট দৌলতপুর এলাকায় সওদাগর মসজিদ আবিষ্কৃত হয়। একই এলাকায় রয়েছে শাহী মহল, যা সেকেন্দার বাদশার বসতবাড়ি ছিল। একই এলাকায় পাঠাগার মসজিদ আবিষ্কৃৃত হয়। মিঠুপুরকুর এলাকায় মাতারানী রওজা শরিফ রয়েছে। বাদিডিহি এলাকায় আলোখা মসজিদটি ২০০২ সালে খনন করে প্রত্নতাত্ত্বিক বিভাগ। বারবাজার ইউনিয়নের বাদুরগাছা এলাকায় গাজী-কালু-চম্পাবতীর আস্তানা ও রওজা শরিফ রয়েছে। বাদুরগাছা এলাকায় শ্রী রাম রাজবাড়ি যা দীঘি পরিবেষ্টিত। মুরাদগড় এলাকায় মরাদগড় ৩টি ঢিবি রয়েছে। এর মধ্যে অনেক প্রত্নসম্পদ অবলুপ্তির পথে, যা বেশির ভাগই খনন বা পুনঃখনন করা প্রয়োজন।
এছাড়া বারবাজার ইউনিয়নের ১০ বর্গমাইল এলাকাজুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে প্রচুর দীঘি ও পুকুর। জনশ্রম্নতিমতে ছয় কুড়ি ছয়টা অর্থাৎ ১৩৬টি দীঘি ও পুকুর রয়েছে। এ অঞ্চলে ১৮টি উলেস্নখযোগ্য দীঘির
নাম জানা যায়, পীরপুকুর চার একর, গোড়ার পুকুর পাঁচ একর, সওদাগর দীঘি ১১ একর, সানাইদার পুকুর তিন একর, সাতপীরের পুকুর তিন একর, ভাইবোনের দীঘি চার একর, আনন্দ দুই একর, গলাকাটা দীঘি চার একর, জোড়াবাংলা দীঘি তিন একর, চোরাগদা দীঘি চার একর, মাতারানী দীঘি আট একর, নুনগোলা দীঘি তিন একর, কানাই দীঘি তিন একর, পাঁচ পীরের দীঘি তিন একর, মনোহর দীঘি তিন একর, আদিনা দীঘি তিন একর, শ্রীরাম রাজার দীঘি ১০ একর ও বেড় দীঘি আট একর।
পর্যটন এলাকা ঘোষণার দাবি : এদিকে, এই বারোবাজারকে পর্যটন এলাকা ঘোষণা ও প্রত্নতাত্ত্বিক জাদুঘর স্থাপনের দাবিতে সম্প্রতি স্থানীয়রা সামাজিক আন্দোলন শুরু করেছে। ইতোমধ্যে তারা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে 'বারোবাজার প্রাচীন ঐতিহ্য রক্ষা আন্দোলন কমিটি' নামে একটি গ্রম্নপের মাধ্যমে প্রচার-প্রচারণা চালাচ্ছেন।
গ্রম্নপের ভাষ্য, কালীগঞ্জ উপজেলার বারোবাজার এলাকায় রাজ্য ছিল, রাজ সিংহাসনও ছিল, ছিল সুপ্রশস্ত রাজপথ আর শান বাঁধানো ঘাট। যা কালের চক্রে বিলীন হওয়ার পথে। ১৯৯০-৯২ সালে স্থানীয়দের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে সরকারের প্রতত্ত্ব বিভাগ এখানে প্রত্ননিদর্শন উদ্ধারের জন্য খননকার্য পরিচালনা করে। সেই সময় বেশ কিছু মসজিদ, সেনাছাউনি, সিঁড়ি, কবরস্থান, নদীবন্দর বা জাহাজ ঘাট আবিষ্কৃত হয়।
আউলিয়াদের পুণ্যভূমি বারোবাজারে রয়েছে ইতিহাস প্রসিদ্ধ গাজি কালু চম্পাবতীর মাজার। রয়েছে সুলতানি শাসন আমলের ১৯টি মসজিদ, যা এতদিন মাটির নিচে ঢাকা ছিল। এখনো মাটির নিচে ঢাকা রয়েছে সাতটি মসজিদ। এছাড়া দীঘি রয়েছে ২০টি। কিন্তু ইতিহাস থেকে পাওয়া যায় ১২৬টি দীঘি ছিল কিন্তু কালের বিবর্তনে সব হারিয়ে গেছে। অনেক স্থান দখল হয়ে গেছে। প্রায় ১০ বর্গমাইল এলাকাজুড়ে রয়েছে বহু অজানা প্রত্ন সম্পদে ভরপুর।
স্থানীয় সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীম আনার ও উপজেলা চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর সিদ্দিক ঠান্ডু তাদের এই দাবির সঙ্গে একমত পোষণ করে সহযোগিতার আশ্বাসও দিয়েছেন।
আনোয়ারুল আজীম আনার জানান, বারোবাজার এলাকা প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনে ভরপুর। ১৯৯২ সালের দিকে প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ বেশ কিছু ঢিবি খুঁড়ে এই নিদর্শনগুলো উদ্ধার করে। এলাকাবাসীর জোর দাবি এখানে পর্যটন এলাকা ও জাদুঘর স্থাপনের। এই সংক্রান্ত তথ্যপ্রমাণাদি যদি আমার কাছে দেওয়া হয় তাহলে তিনি পর্যটন এলাকা ও জাদুঘর স্থাপনের জন্য সংসদে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী ও প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করবেন।
'বিলুপ্তি নগরী বারবাজার' বইয়ের লেখক ও গবেষক রবিউলি ইসলাম জানান, বারোবাজারে প্রতিদিন শ' শ' লোক আসে পঞ্চদশ শতাব্দীর নিদর্শন মসজিদসহ আবিষ্কৃত স্থাপনা দেখতে। এখানে পর্যটন এলাকা ঘোষণা ও প্রত্নতাত্ত্বিক জাদুঘর স্থাপনের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। বিশেষ করে দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মুসলিম আর্কিটেক্চারের শিক্ষার্থীরা এখানে আসে রিসার্চ করতে। তাদের প্রয়োজনে তারা এলাকার মানুষকে নিয়ে সামাজিক আন্দোলন করছেন।