বাঙালি সংস্কৃতির সোনালি অতীত ক্রমেই বিলুপ্ত হচ্ছে। কালচক্রে হারিয়ে যাচ্ছে বাঙালির কৃষ্টি-কালচার, সংস্কৃতি-উৎসব। একযুগ আগেও গ্রামীণ জনপদে নানা ধরনের উৎসবের আয়োজন করা হতো। জারি, সারি, মুর্শিদি, ভাওয়াইয়া গান, গাজীর গীত, বিয়ের গীত, বিচার গান, কবি গান, ভাব গান, পালা গান, ধোয়া গান, ভাটিয়ালি গান, যাত্রাপালা, পুতুল নাচ, কানামাছি ভোঁ ভোঁ, দাঁড়িয়াবান্ধা, বৌচি, গোলস্নাছুট, ইচিং-বিচিং-চিছিং-ছা, এক্কাদোক্কা, মোরগ লড়াই, ঘোড়দৌড়, নৌকাবাইচ, লাঠিখেলা এবং জাতীয় খেলা হাডুডুসহ নানা ধরনের আয়োজন করা হতো বিভিন্ন এলাকায়।
গ্রাম-বাংলার এসব ঐতিহ্য কালের বিবর্তনে হারিয়ে যাচ্ছে। শেকড় সন্ধানী জারি-সারি, কৃষ্টি-কালচার এখন আর আগেকার মতো চর্চা হয় না। আয়োজন করা হয় না-এসব উৎসব। অথচ একটা সময় ছিল যখন-বাঙালির আনন্দ-বিনোদনের অন্যতম উৎস্য ছিল আজকের হারিয়ে যাওয়ার উপক্রম তাবৎ অনুষঙ্গ।
বাঙালি সংস্কৃতির ওপর বিজাতীয় আগ্রাসন ও নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয়ের কারণে স্বদেশি সুসমৃদ্ধ সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের শেকড় আজ মুখ থুবড়ে পড়ছে। অথচ এসব দেশীয় বিভিন্ন ধরনের আয়োজন সাজানো হতো রূপসী বাংলার গ্রামে গ্রামে। বিশেষ কোনো দিবস উপলক্ষে কিছু সংস্কৃতি আজও অস্তিত্ব জানান দেয়। যেমন-লাঠিরখলা, নৌকাবাইচ, হাডুডু খেলা এবং ঘোড়দৌড়।
একযুগ আগেও নবান্নের উৎসবকে ঘিরে কৃষান-কৃষানির আঙিনায় ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনায় গ্রামীণ সংস্কৃতির হরেক রকম আসর বসত। আনন্দে মেতে উঠতেন ভর গ্রামের মানুষ। আমুদে লোকজনের উদ্যোগে মাঝেমধ্যেই কোনো না কোনো পাড়া-মহলস্নায় জারিগান, বিচার গান, কবি গান, ভাব গান, ধোয়া গান, ভাটিয়ালিসহ বিভিন্ন গানের আয়োজন করা হতো। পুতুল নাচ ও যাত্রাপালার দিকেও তাদের সমান ঝোঁক ছিল তখন। শিশু-কিশোরের দল পাড়াজুরে হইচই করে বেড়াত। কানামাছি, দাঁড়িয়াবান্ধা, বৌচি, গোলস্নাছুট, ইচিং-বিচিং-চিচিং-ছা, এক্কাদোক্কা, মোরগ লড়াইসহ বহু খেলা নিয়ে তারা মশগুল থাকত। এসব খেলায় উন্মত্ত্ব-আনন্দে মাতোয়ারা শিশু-কিশোরের মুখে
থাকত বাঁধভাঙা হাসি।
লাঠিখেলা এবং জাতীয় খেলা হাডুডু'র উন্মাদনাও ছিল গ্রামে গ্রামে। ঢাক-ঢোল পিটিয়ে হ পৃষ্ঠা ১৫ কলাম ৬
এবং কাশি-বাঁশি বাজিয়ে জাঁকজমকভাবেই আয়োজন করা হতো জাতীয় খেলা হাডুডু ও লাঠিখেলা।
বিভিন্ন এলাকায় বছরের একটি নির্দিষ্ট দিনে অনুষ্ঠিত হতো ঘোড়দৌড় ও নৌকাবাইচ প্রতিযোগিতা। উত্তেজনাপূর্ণ ও মনোমুগ্ধকর এ দু'টি প্রতিযোগিতা উপভোগে মানুষের ঢল নামত। এ উপলক্ষে বসত বিশাল মেলা।
বর্তমান প্রজন্মের শিশুরা ভুলতে বসেছে শৈশবের মানে। শৈশবের প্রাণবন্ত উচ্ছ্বাস-উলস্নাসে মাতামাতি আগের মতো চোখে পড়ে না। বিশেষ করে নগর ও শহরের যান্ত্রিকতায় শৈশব জীবনে পড়েছে বিরূপ প্রভাব। তারা বোধহয় ভুলেই যাচ্ছে শৈশব মানে দুরন্তপনা। শৈশব মানেই স্মৃতি ও স্বপ্ন জাগানিয়া সৃষ্টি সুখের উলস্নাসে কাটানো সময়। শৈশবের সেই দুরন্তপনা এবং প্রকৃতির আলিঙ্গন থেকে ক্রমে সরে যাচ্ছে শহুরে প্রজন্ম। তারা পাচ্ছে না সোনালি রোদের ঝলমলে আলো, রোদেলা দুপুর, বর্ণিল মেঘের ছায়া, রংধনুর অপূর্ব দৃশ্য, নির্মল উতলা বাতাসের দমকা! চার দেয়ালের ভেতরে যেন বন্দিত্বের সব আয়োজন! টেলিভিশন, কম্পিউটার, ইন্টারনেট, ফেসবুক, ভিডিও গেম এবং মোবাইল গেম রীতিমতো ভূতের বোঝা হয়ে চেপেছে শিশুদের মনে। তবে গ্রাম-গঞ্জে এখনো শৈশবে মেতে ওঠার নানা চিত্র চোখে পড়ে। ডাক দিয়ে যায় দুরন্ত শৈশব।
বিলুপ্তির কারণ : বিজ্ঞানের ক্রম: উৎকর্ষতা প্রধান একটি কারণ। এছাড়া উদ্যোক্তা ও পৃষ্ঠপোষকের অভাব, উপযোগী পরিবেশ, পর্যাপ্ত খেলার মাঠের সংকট, নদীর নাব্য হ্রাস, মাটির রাস্তার অপ্রতুলতাসহ বহুবিধ সমস্যার ফলে গ্রাম-বাংলার অতীত ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির ওই করুণদশা সৃষ্টি হয়েছে। আধুনিক প্রযুক্তির ফলে মানুষ-গোটা পৃথিবী, পৃথিবীর কৃষ্টি-কালচার, বিভিন্ন অনুষ্ঠানসহ নানা ধরনের বিনোদন ঘরে বসেই উপভোগের সুবিধা পাচ্ছেন। সে কারণে এই যান্ত্রিকতার যুগে মানুষও একঘেঁয়ে ছকে আটকে পড়ছেন।
গ্রাম-বাংলার এসব শিল্প-সংস্কৃতি তরুণ ও আগামী প্রজন্মের কাছে রূপকথার গল্পের মতোই মনে হবে। বিলুপ্তপ্রায় সংস্কৃতির অস্তিত্ব্ব রক্ষায় এবং সোনালি অতীত ও ঐতিহ্যের শেকড় পুনরুদ্ধারের লক্ষ্যে কার্যকরী উদ্যোগ দরকার বলে সচেতন মহল মনে করেন।
মাগুরার মহম্মদপুরের রাজাপুর গ্রামের ষাটোর্ধ্ব আজিজার মোল্যা বলেন, 'পুরনো সেইসব খেলাধুলা, ঐতিহ্য-সংস্কৃতি এখনতো আর চর্চা করা হয় না। পুলকওয়ালা লোকের বড়ই অভাব। ক্রমান্বয়ে মানুষ হয়ে যাচ্ছে যন্ত্র।'
এ প্রসঙ্গে 'মহম্মদপুর উপজেলার ইতিহাস' গ্রন্থের লেখক সালাহ্ উদ্দীন আহ্মেদ মিল্টন বলেন, 'আধুনিকতা এবং বিজ্ঞানের উৎকর্ষতার কারণে ক্রমেই হারিয়ে যাচ্ছে বাঙালির উৎসবমুখর সংস্কৃতি-উৎসব।'