বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

পাঁচ হাজারের বেশি মানুষকে হত্যা করে পাক হানাদাররা

মাসুম পারভেজ, কেরানীগঞ্জ (ঢাকা)
  ০২ এপ্রিল ২০২৩, ০০:০০
কেরানীগঞ্জ গণহত্যা দিবস আজ

আজ কেরানীগঞ্জ গণহত্যা দিবস। কেরানীগঞ্জবাসীর কাছে দুঃসহ স্মৃতিময় এক দিন। ১৯৭১ সালের এই দিনে কেরানীগঞ্জবাসীর ওপর নেমে এসেছিল পাকিস্তানি হায়েনাদের নির্মম হত্যাযজ্ঞ। কেরানীগঞ্জের জিঞ্জিরা, শুভাঢ্যা ও কালিন্দী ইউনিয়নজুড়ে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর পরিকল্পিত হত্যাকান্ডে পাঁচ হাজারের বেশি মানুষ নিহত হন। ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তান সেনাবাহিনী 'অপারেশন সার্চলাইট' নামে ঢাকায় গণহত্যা চালায়। পরদিন দেশের সাধারণ মানুষ ঘর ছেড়ে বের হতে পারেনি। ২৭ তারিখ সকালে কয়েক ঘণ্টার জন্য কারফিউ তুলে নেওয়া হলে পথে নেমে আসে মানুষ। ছুটতে থাকে যে যার গন্তব্যে, জীবন বাঁচাতে। প্রথমবারের

মতো বাংলার অসংখ্য মানুষ শরণার্থী হন। এ সময় কেরানীগঞ্জে আশ্রয় নেন

হাজার হাজার মানুষ। ঢাকা শহরের কাছে বুড়িগঙ্গা নদীর ওপারে এবং ধলেশ্বরী ও কালীগঙ্গা নদীঘেরা কেরানীগঞ্জ এলাকা ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ আশ্রয়স্থল। জাতীয় নেতা, রাজনৈতিক কর্মী ও ছাত্রনেতারা অনেকেই এখানে আশ্রয় নেন। মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি ও পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে আক্রমণ পরিচালনা, মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্র ও রসদ জোগানো, যুবকদের প্রশিক্ষণ দেওয়াসহ কৌশলগত দিক থেকে কেরানীগঞ্জ হয়ে ওঠে গুরুত্বপূর্ণ। বিষয়টি আঁচ করতে পেরে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী এখানে গণহত্যা চালায়।

একাত্তরের ১ এপ্রিল মধ্যরাতের পর অর্থাৎ ২ এপ্রিল ভোর থেকে জিঞ্জিরায় পাকিস্তানি সেনারা সমবেত হতে থাকে এবং সন্ধ্যার মধ্যে কেরানীগঞ্জকে চারপাশ থেকে ঘিরে ফেলে। ২ এপ্রিল ভোরে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী কেরানীগঞ্জে হামলা চালায়। নির্বিচারে গুলি ও বাড়িঘরে আগুন দিয়ে ঘুমন্ত মানুষ হত্যা করে। মাত্র কয়েক ঘণ্টার মধ্যে পাকিস্তানি সেনাদের সশস্ত্র আক্রমণে মারা যান হাজারো নিরীহ বাঙালি। তাদের দেওয়া আগুনে ভস্মীভূত হয় গ্রামের পর গ্রাম। বাড়িঘর ও দোকানপাট লুট হয়ে যায়, লুট হয়ে যায় গোটা কেরানীগঞ্জ। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী অনেক মা-বোনের সম্ভ্রমহানি করে। রক্তের বন্যা বয়ে যায় প্রতিটি গ্রামে। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে এই বর্বর ঘটনা 'কেরানীগঞ্জ গণহত্যা' নামে পরিচিত হয়ে আছে। অপারেশন সার্চলাইটের মধ্যে ঢাকার আশপাশের এলাকায় পাকিস্তানি সেনাবাহিনী যেসব পরিকল্পিত গণহত্যা চালিয়েছে, তার মধ্যে কেরানীগঞ্জের গণহত্যাই প্রথম। কেরানীগঞ্জকে লক্ষ্যবস্তু করার অন্যতম কারণ, এই এলাকার অধিকাংশ বাসিন্দা ছিল হিন্দু সম্প্রদায়ের। আওয়ামী লীগের শক্ত ঘাঁটি হিসেবেও পরিচিতি ছিল কেরানীগঞ্জ।

সেদিন সৌভাগ্যক্রমে বেঁচে যান সে সময়ের ছাত্রনেতা নুরে আলম সিদ্দিকী (সদ্য প্রয়াত), শাজাহান সিরাজ, মোস্তফা মহসিন মন্টুসহ অনেকে। পরে একই কবরে ১০ থেকে ১২টি করে লাশ দাফন করা হয়। কেরানীগঞ্জে আশ্রয় নিতে আসা নাম-না-জানা ৫৪ জনকে দাফন করা হয়। সেদিনের নির্মম হত্যাকান্ডে জিঞ্জিরা, মনু ব্যাপারীর ঢাল, নজরগঞ্জ, গোলজারবাগ, মান্দাইল, কুশিয়ারবাগ, বড়িশুর ও মাদারীপুর এলাকা লাশের স্তূপে পরিণত হয়।

সম্প্রতি কেরানীগঞ্জের মনু ব্যাপারীর ঢাল, নজরগঞ্জ, কসাইভিটা ও নেকরোজবাগ ঘুরে কয়েকটি গণকবর চোখে পড়ে। মনু ব্যাপারীর ঢালে ওই দিন একসঙ্গে প্রায় সাড়ে চারশ' মানুষকে হত্যা করা হয়। এখন সেখানে গড়ে উঠেছে একটি স্মৃতিসৌধ।

উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ শাহজাহান বলেন, '২ এপ্রিল ভোরে যখন পাকিস্তানি সেনারা কেরানীগঞ্জে হামলা চালায় স্থানীয় যুবকরা প্রথমে প্রতিরোধ গড়ে তোলার চেষ্টা করে। কিন্তু হানাদার বাহিনীর অত্যাধুনিক অস্ত্রের সামনে টিকতে না পেরে পিছু হটতে বাধ্য হয়। হানাদার বাহিনী নির্বিচারে গুলি করে হাজার হাজার নিরীহ বাঙালিকে হত্যা করে। হত্যাযজ্ঞ শেষে পাকিস্তানিরা চলে গেলে সন্ধ্যার পর শহীদদের মরদেহ কালিন্দি, নেকরোজবাগ, ইমামবাড়ি, কসাইভিটা, নজরগঞ্জ ও কালীগঞ্জ কবরস্থানসহ বিভিন্ন স্থানে গণকবর দেওয়া হয়। কোনো কোনো কবরে ১৫ থেকে ২০ জনকেও রাখা হয়েছিল। এমনকি ধানক্ষেতেও শহীদদের মাটি চাপা দেওয়া হয়।'

কেরানীগঞ্জের ভয়াবহ গণহত্যা খুব কাছ থেকে দেখেছেন কবি নির্মলেন্দু গুণ। তিনি স্মৃতিচারণ করে বলেন, 'একটি ডোবার ভেতরে মাথা গুঁজে বসে তখন আমি এমন একটি করুণ মৃতু্য প্রত্যক্ষ করি, যা আমি কোনো দিন ভুলতে পারব না, পারিনি। আমি দেখি শেলের আঘাতে একজন ধাবমান মানুষের দেহ থেকে তার মস্তকটি বিচ্ছিন্ন হয়ে ছিটকে পড়েছে আমি যে ডোবায় লুকিয়ে ছিলাম সেই ডোবার জলে, কিন্তু ওই মানুষটি তারপরও দৌড়াচ্ছে। শেলের আঘাতে তার মাথাটি যে দেহ থেকে উড়ে গেছে, সেদিকে তার খেয়ালই নেই। মস্তকছিন্ন দেহটিকে নিয়ে কিছুটা দূরত্ব অতিক্রম করার পর লোকটা আর পারল না, তার কবন্ধ দেহটা লুটিয়ে পড়ল মাটিতে। মস্তকহীন দেহ থেকে ফিনকি দিয়ে ছোটা রক্তস্রোতে ভিজে গেল শুভাড্যার মাটি।'

তিনি জানান, কালের বিবর্তনে অনেক ঘটনা মানুষের মন থেকে মুছে যায়। ইতিহাসের তলানিতে চাপা পড়তে যাওয়া এমন একটি ঘটনা 'জিঞ্জিরা জেনোসাইড' বা 'জিঞ্জিরা গণহত্যা'।

কেরানীগঞ্জের গণহত্যা নিয়ে নাট্যজন মামুনুর রশীদ বলেন, 'প্রথমে বুড়িগঙ্গার ওপারে মিটফোর্ড হাসপাতালের ছাদের ওপর থেকে মর্টার আর ফ্লেয়ার মারছিল পাকিস্তানি সেনারা। আমরা তখন পটকাজোর-নেকরোজবাগের খালপথ ধরে পাঁচ কিলোমিটার দূরে অবস্থান নিই। অপারেশনের পর সন্ধ্যায় ফিরে এসে দেখতে পাই কালিন্দী, মান্দাইল, নজরগঞ্জ, কসাইভিটা, ইমামবাড়ি, নেকরোজবাগসহ কেরানীগঞ্জের মাঠ-ঘাট-ডোবায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে শত শত লাশ। পরের দু'তিন দিন ধরে জায়গায় জায়গায় গর্ত করে এসব লাশ দাফনের ব্যবস্থা করা হয়। ওই দিন আড়াই থেকে তিন হাজার মানুষ নিহত হয়েছিল। বেশির ভাগই ছিল আশ্রিত। মান্দাইল ডাকের সড়কের সামনের পুকুরপাড়ে ৬০ জনকে দাঁড় করিয়ে হত্যা করে তারা। খোলামাঠ ও গ্রাম দিয়ে যখন গ্রামবাসী ছোটাছুটি করছিল, তখন খানসেনারা উপহাসভরে ব্রাশফায়ার করেছে। বহু অপরিচিত লাশ এখানে-ওখানে বিক্ষিপ্তভাবে পড়ে ছিল।'

তিনি বলেন, 'পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর জিঞ্জিরা অপারেশনের কোনো তুলনা নেই সমকালীন বিশ্বে। মিলিটারিরা সেদিন জিঞ্জিরা ও বড়িশুর বাজারটি জ্বালিয়ে দেয়। চুনকুটিয়া-শুভাঢ্যা ধরে বড়িশুর পর্যন্ত পাঁচ থেকে সাত মাইল এলাকা মিলিটারি ঘিরে ফেলে এবং নারী-শিশু নির্বিশেষে যাকে হাতের কাছে পায় তাকেই গুলি করে মারে। নারীদের চরমভাবে লাঞ্ছিত করে।'

গণহত্যার পরের দিন ৩ এপ্রিল পাকিস্তানি প্রচারযন্ত্র 'জিঞ্জিরা গণহত্যা'কে ধামাচাপা দিতে বহির্বিশ্বকে বিভ্রান্ত করার জন্য মিথ্যা খবর প্রচার করে। তৎকালীন পাকিস্তান সরকার সমর্থিত পত্রিকা মর্নিং নিউজের একটি সংবাদের শিরোনাম ছিল- 'জিঞ্জিরায় দুষ্কৃতকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ।' পাকিস্তান টেলিভিশন ওই দিন ২ এপ্রিল রাতে খবর প্রচার করে, 'বুড়িগঙ্গা নদীর অপর পাড়ে কেরানীগঞ্জের জিঞ্জিরায় আশ্রয়গ্রহণকারী বিচ্ছিন্নতাবাদী দুষ্কৃতকারীদের কঠোর হাতে নির্মূল করা হয়েছে'।

ঢাকা জেলা যুদ্ধকালীন কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা সাবেক সংসদ সদস্য মোস্তফা মহসিন মন্টু সেদিনের ভয়ার্ত স্মৃতির বর্ণনা দিয়ে বলেন, '২৭ মার্চ সকালে কয়েক ঘণ্টার জন্য কার্ফু শিথিল করলে ঢাকা শহরের আতঙ্কিত হাজার হাজার মানুষ কেরানীগঞ্জের জিনজিরা, শুভাঢ্যা, আগানগর, কালিন্দী ও কামরাঙ্গীরচর হয়ে বুড়িগঙ্গা নদী পার হয়। কেরানীগঞ্জের প্রতিটি মানুষ অসহায় শরণার্থীদের সাহায্যে তাদের সঞ্চিত টাকা পয়সা, খাবার-দাবার সবকিছু উজাড় করে আপন করে নেয়। একটানা চার থেকে পাঁচ দিন ধরে শরণার্থীদের সেবা করতে গিয়ে ১ এপ্রিল রাতে কেরানীগঞ্জবাসী যখন ক্লান্ত দেহে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন, ঠিক তখনই ২ এপ্রিল ভোরে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর মর্টার ও মেশিনগানের মুহুর্মুহু শব্দে তাদের ঘুম ভাঙে। ভোর ৬টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত বর্বর সেনারা নারকীয় তান্ডব চালায়। বর্বরোচিত তান্ডবে ওই দিন কেরানীগঞ্জে পাঁচ সহস্রাধিক নিরস্ত্র মানুষ প্রাণ হারান।'

তিনি জানান, ২৬ মার্চ কেরানীগঞ্জ থানা দখল করে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা ওড়ানো হয়। জাতীয় নেতাদের বড় অংশ এখানে আশ্রয় নেন এবং পরে নিরাপদ স্থানে চলে যান। এ পথ দিয়ে শেখ ফজলুল হক মনি, তাজউদ্দীন আহমদ, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী, কামরুজ্জামান, আবদুর রাজ্জাক, সিরাজুল আলম খান, আ স ম আব্দুর রব, আব্দুল মালেক উকিল, তোফায়েল আহমেদ ও শাহজাহান সিরাজ প্রমুখ ভারতে পাড়ি জমান। ২৫ মার্চ ঢাকায় হত্যাযজ্ঞ চলার ঘটনা ও জাতীয় নেতাদের কেরানীগঞ্জে আশ্রয়ের খবর বিবিসিতে প্রচার হলে পাকিস্তানি হায়েনার দল কেরানীগঞ্জে আক্রমণের পরিকল্পনা নেয়, এরই ধারাবাহিকতায় ২ এপ্রিলের এই হত্যাযজ্ঞ।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে