সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১

টাঙ্গাইলে রাত নামলেই শুরু হয় নিউ ধলেশ্বরীর তীর কাটার মচ্ছব

জোবায়েদ মলিস্নক বুলবুল, টাঙ্গাইল
  ১৮ মার্চ ২০২৪, ০০:০০
টাঙ্গাইলের নিউ ধলেশ্বরী নদীর তীর ও আশপাশের ফসলি জমি কেটে বিক্রি করছে মাটি-বালু ব্যবসায়ীরা। ছবিটি এলেঙ্গা পৌরসভার হায়াতপুর এলাকা থেকে তোলা -যাযাদি

টাঙ্গাইলের নিউ ধলেশ্বরী নদীর সাত কিলোমিটার এলাকার ছয়টি স্পটে তীর কেটে বিক্রির প্রতিযোগিতায় নেমেছে মাটিখেকোরা। প্রতিদিন রাত নামলেই শুরু হয় তীর কাটার মহোৎসব। দিনের আলোয় সুনসান নিরবতা থাকলেও প্রশাসনের চোখ ফাঁকি দিতে রাত ৯টার পর নদীতীর এলাকায় উৎসবের আমেজ তৈরি হয়। জনস্বার্থে নদীতীর ও জমির টপসয়েল কাটা বন্ধে পৌরসভার উদ্যোগে মাইকিং করা হলেও কেউ কর্ণপাত করছে না। কালিহাতী উপজেলা প্রশাসনের পক্ষে সহকারী কমিশনার (ভূমি) মোহাম্মদ সিফাত বিন সাদেকের নেতৃত্বে ভ্রাম্যমাণ আদালতের একাধিক অভিযান চালানো হচ্ছে। কিন্তু ব্যবসায়ীরা আদালতের অভিযান চলাকালে আত্মগোপনে থেকে অভিযানের পর পরই কৌশলে প্রতিযোগিতামূলক মাটি-বালু কেটে বিক্রিতে মেতে উঠছে।

জানা যায়, নিউ ধলেশ্বরী নদীর টাঙ্গাইল সদর উপজেলার বড় বাসালিয়া ও এলেঙ্গা পৌরসভার অংশে ছয়টি স্পটে দুই তীর কেটে মাটি ও বালু বিক্রি করছে এক শ্রেণির সংঘবদ্ধ ব্যবসায়ী। স্পটগুলো হচ্ছে- টাঙ্গাইল সদর উপজেলার মগড়া ইউনিয়নের বড় বাসালিয়ায় দুটি স্পট এবং এলেঙ্গা পৌরসভার চরভাবলা, হায়াতপুর, চরবাঁশি। এর মধ্যে বড় বাসালিয়ার দুটি স্পটে উজ্জ্বল, খোকন, সুমন, নাজমুল, আলামিন, জয় প্রমুখ; একই এলাকার অপর স্পটে ফেরদৌস, নাজু প্রমুখ; এলেঙ্গা পৌরসভার চরভাবলা স্পটে অসিম উদ্দিন, নজরুল ইসলাম, এসকে আলম প্রমুখ; হায়াতপুর স্পটে স্থানীয় হ পৃষ্ঠা ১৫ কলাম ৬

কাউন্সিলর মো. ছানোয়ার হোসেন, এরশাদ, বকুল তালুকদার, আরিফ, লাবু, জাহিদ প্রমুখ; চরবাঁশি দুটি স্পটে আওয়ামী লীগ নেতা মাজেদুর রহমান, আব্দুল হালিম; অপর স্পটে রফিক, শফিক প্রমুখ।

সরেজমিন দেখা যায়, এলেঙ্গা পৌরসভার চরভাবলা স্পটে নিউ ধলেশ্বরী নদীর বামতীরে প্রায় আটশ' মিটার এলাকার তীর কেটে মাটি-বালু বিক্রি করা হয়েছে। উজান ও ভাটিতে মাটি কাটার ফলে স্থানীয় মৃত সোলেমান মিয়ার প্রবাসী ছেলে শরীফদের বসতবাড়ি পুরোপুরিভাবে ভাঙনের ঝুঁকিতে পড়েছে। মৃত সোলেমান মিয়ার এক ছেলে দুই মেয়ের মধ্যে মেয়েদের অন্যত্র বিয়ে হয়েছে। শরীফ প্রবাসে থাকেন। বাড়িতে শুধু তার মা শাহিদা আক্তার বসবাস করেন।

শাহিদা আক্তার জানান, তাদের বাড়ির তিন দিকে মাটি কেটে স্থানীয় ব্যবসায়ী অসিম উদ্দিন, নজরুল ইসলাম ও এসকে আলমরা বিক্রি করেছে। তিনি বার বার নিষেধ করলেও তারা মানেনি। পৌরসভায় জানিয়েও কোনো সুফল হয়নি। বর্ষা মৌসুমে তার বাড়ি নদীগর্ভে হারিয়ে যাওয়ার সমূহ আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।

হায়াতপুর স্পটে দিন-রাত চারটি ভেকু মেশিন (খনন যন্ত্র) দিয়ে ২০-২৫ ফুট গভীর করে নদীতীর কেটে প্রতিদিন দেড় শতাধিক গাড়ি মাটি-বালু বিভিন্ন স্থানে সরবরাহ করা হয়। দিনের আলোয় কয়েক দফায় ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযান চালানোর কারণে এখন রাত ৯টার পর থেকে নদীতীরসহ আশপাশের তিন ফসলিজমি কেটে মাটি বিক্রি করা হচ্ছে। এ স্পটের মাটি ব্যবসায়ীরা নাম প্রকাশ না করে জানান, তারা প্রশাসনকে ম্যানেজ করেই নদীতীর কেটে মাটি-বালু বিক্রি করছেন। এজন্য তারা এখন দিনে মাটি কাটেন না বা পরিবহণও করেন না। তাছাড়া আগামী বর্ষা মৌসুমে যমুনার পলি জমে কেটে নেওয়া জমিগুলো ভরাট হয়ে যাবে।

চরবাঁশি স্পটে গিয়ে দেখা যায়, নিউ ধলেশ্বরী নদীর ডানতীরে তিনটি ভেকু বসিয়ে রাখা হয়েছে। চারদিকে সুনসান নিরবতা। রাত ৯টার পর সেখানে মাটি-বালু ব্যবসায়ীদের পদচারণায় মুখর হয়ে ওঠে। শ্রমিকরা মাটি কেটে ভেকু দিয়ে ট্রাক ভরে দেন। কেউ মাটি কাটা তদারকি করেন, কেউ পরিবহণের ট্রাকে স্স্নিপ দেন। এ লক্ষ্যে রাতে সেখানে অস্থায়ী দোকানও বসে। সে দোকান থেকে বালু ব্যবসায়ী ও তাদের সহযোগীরা পানাহার করে থাকেন।

টাঙ্গাইল সদর উপজেলার বড় বাসালিয়ার দুটি স্পটে তিনটি ভেকু দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। সেখানে দিনের আলোয় কোনো কাজ করা হয় না। রাত নামলেই পুরো এলাকা শ' শ' ছোট ছোট ট্রাক ও ভেকু মেশিনের আলোয় ঝলমলিয়ে ওঠে। নিউ ধলেশ্বরী নদীর বামতীরে জমে থাকা পলি কেটে বিক্রি করা হয়। সেখানকার স্পট দুটি টাঙ্গাইল সদর উপজেলা ও কালিহাতী উপজেলার এলেঙ্গা পৌরসভার সীমান্ত এলাকায় অবস্থিত। জমে থাকা পলিমাটি সদর উপজেলার বড় বাসালিয়া ও এলেঙ্গা পৌরসভার যৌথ অংশে হলেও তা কালিহাতীর এলেঙ্গা পৌরসভার সড়ক দিয়ে পরিবহণ করতে হয়। ফলে প্রায় দুই কোটি পঁয়ত্রিশ লাখ টাকা ব্যয়ে সদ্যনির্মিত পৌরসভার সড়কটি যে কোন সময় ধসে পড়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।

নদী তীরবর্তী স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, নিউ ধলেশ্বরী নদীর তীর কেটে মাটি-বালু বিক্রি করার ফলে বর্ষা মৌসুমে তীব্র ভাঙনে বাড়িঘর ও ফসলিজমি নদীগর্ভে বিলীন হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিচ্ছে। তীরবর্তীসহ আশপাশের তিন ফসলি জমিগুলো অনাবাদি থাকার আশঙ্কা রয়েছে। রাতের আঁধার ভেদ করে উচ্চশব্দে হর্ন বাজিয়ে ট্রাক চলাচল করায় শিক্ষার্থীদের লেখাপড়ায় বিঘ্ন ঘটছে- গ্রামীণ সড়ক মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। ধুলাবালির কারণে আশপাশের বাড়িঘরে রাখা খাবারগুলোয় বালুর স্তর পড়ে নষ্ট হচ্ছে। নারী-শিশু ও বয়স্করা শ্বাসকষ্টসহ বালু ও বায়ুবাহিত নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছে।

স্থানীয়রা নাম প্রকাশ না করে জানায়, মাটি-বালু ব্যবসায়ীরা এলাকায় খুবই প্রভাবশালী। কেউ কেউ সরকারদলীয় রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। তাদের অবৈধ মাটিকাটা ও বালু উত্তোলন বন্ধে বার বার অনুরোধ করলেও কেউ শোনেনি। এলাকার কেউ প্রতিবাদমুখর হয়ে উঠলে তার বিরুদ্ধে মাটি-বালু ব্যবসায়ীরা ভিন্ন অজুহাতে মামলা দিয়ে হয়রানি করে থাকে। এ কারণে ভয়ে কেউ প্রতিবাদ করে না।

এলেঙ্গা পৌরসভার কাউন্সিলর সুকুমার ঘোষ জানান, নিউ ধলেশ্বরী নদীতীর কেটে মাটি-বালু বিক্রি বন্ধে প্রশাসনের পাশাপাশি তারা এলাকার মানুষকে এ বিষয়ে সচেতন করতে কাজ করছেন। তিনি মাটি-বালু ব্যবসায়ীদের সঙ্গে সমঝোতা করছেন না বলে তাকে নিয়ে নানা ধরনের অপপ্রচার চালানোর অপচেষ্টা করছে।

এলেঙ্গা পৌরসভার মেয়র নুর-এ-আলম সিদ্দিকী জানান, পৌরসভার যে কোনো এলাকায় মাটি-বালু বা নদীতীর কিংবা নদী খনন করে বালু উত্তোলন বন্ধে জনসচেতনতা তৈরি করতে ৩-৪ দিন ধরে মাইকিং করা হচ্ছে। এ ছাড়া 'টাঙ্গাইল জেলার ১০টি পৌরসভার অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্পের' রাস্তা ক্ষতিগ্রস্তের আশঙ্কায় চলাচলরত বালুবাহী ট্রাক বন্ধ করার জন্য বৃহস্পতিবার (১৪ মার্চ) এলেন/পৌঃ/প্রকৌঃ/২০২৪/১৯৫২ নং স্মারকমূলে টাঙ্গাইলের জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার ও কালিহাতী উপজেলা নির্বাহী অফিসারসহ সংশ্লিষ্ট দপ্তরে যথানিয়মে পত্র দিয়েছেন।

টাঙ্গাইল পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী সাজ্জাদ হোসেন জানান, নদী থেকে অবৈধভাবে বালু বা মাটি উত্তোলনের অধিকার কারও নেই। ইতোপূর্বে খননকৃত ড্রেজড ম্যাটারিয়াল সংশ্লিষ্ট কমিটি টেন্ডারের মাধ্যমে বিক্রি করেছে এবং সেগুলো অপসারণও করা হয়েছে। নতুন করে নদী খনন করার কোনো প্রকল্প নিউ ধলেশ্বরী নদীতে নেই।

টাঙ্গাইলের জেলা প্রশাসক ও জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মো. কায়ছারুল ইসলাম জানান, শুধু নদীতীর নয় যে কোনো এলাকার মাটি-বালু উত্তোলন বা কেটে বিক্রি করার অনুমতি কাউকে দেওয়া হয়নি। নিউ ধলেশ্বরী নদীর পৌলি এলাকায় মহাসড়কের আশপাশে তীর কেটে বিক্রি করার খবরে প্রায় প্রতিদিন প্রশাসনের পক্ষ থেকে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা হচ্ছে। এ বিষয়ে কাউকে কোনো প্রকার ছাড় দেওয়ার সুযোগ নেই- অবৈধ বালু ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে