অবকাঠামো থেকে সেবা, সৌন্দর্য ও উন্নয়নে আমূল বদলে যাওয়া এক স্বপ্নীল নগরীর নাম রাজশাহী। কেন্দ্রের চাওয়া আর প্রান্তের সঠিক বাস্তবায়নে পদ্মাপাড়ের এই জনপদ এখন আধুনিক নগরের প্রতিচ্ছবি। দেশের উত্তরাঞ্চলের প্রাচীন শিক্ষা নগরী রাজশাহী। এখন আধুনিক এক সিটি করপোরেশন। প্রায় ৯৭ বর্গকিলোমিটারের এই জনপদে ১০ লাখের বেশি মানুষের বসবাস।
আওয়ামী লীগ সরকারের ২০০৯ থেকে টানা ১৫ বছরে দীর্ঘ, মধ্য ও স্বল্পমেয়াদি বিভিন্ন প্রকল্পে বদলে গেছে রাজশাহী নগরীর চিত্র। প্রশস্ত সড়ক, নির্মল বাতাস, নান্দনিক সড়কবাতি আর অবকাঠামোগত উন্নয়নের পরিকল্পিত বাস্তবায়নে পরতে-পরতে যেন শোভা মেলে ধরছে।
আর দিন পেরিয়ে রাত নামলেই যেন রূপের নতুন জানালা খোলে এই মহানগর। কারুকার্যময় আলোকায়ন ছড়াচ্ছে সৌন্দর্য। দৃষ্টিনন্দন এই শহরটির রাস্তার ল্যাম্প পোস্টে লাগানো বিভিন্ন ধরনের লাইট। রাতে এই লাইটিংয়ের আলোর ঝলকে বিমোহিত হবেন যে কেউ। শিক্ষা নগরীর এই আলো পরিচ্ছন্নতা আর রুচিশীলতায় নতুন বার্তা দিচ্ছে বদলে যাবার, বদলে দেয়ার।
পদ্মা নদীর তীর ঘেঁষে গড়ে উঠা সবুজেঘেরা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন নগরী হিসেবে ইতোমধ্যেই দেশ বিদেশে খ্যাতি পেয়েছে রাজশাহী। বাতাসে ভাসমান মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর কণা দ্রম্নত কমিয়ে আনার ক্ষেত্রে বিশ্বে পরিচিতি অর্জন করেছে রাজশাহী শহর। এখন উন্নয়নের স্রোতধারায় বদলে যাওয়া নগরী রাজশাহী সিটি করপোরেশন। ফলে অনেকেই এই নগরীকে এখন গ্রিন সিটি, ক্লিন সিটি ও আলোকিত নগরী হিসেবে দেখতে আসেন।
সর্বশেষ সিটি নির্বাচনে মেয়রদের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানের (৩ জুলাই ২০২৩) বক্তব্যে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সিলেটের মেয়রকে রাজশাহী শহর দেখার আহ্বান করেন। গত ১৭ ফেব্রম্নয়ারি সিলেট সিটি করপোরেশনের মেয়র আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী রাজশাহী শহর দেখতে আসেন। যাওয়ার সময় তিনি সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময়কালে সিলেট নগরীকে রাজশাহীর মতো করে সাজানোর কথা বলেন।
সময়ের ব্যবধানে উন্নয়নযজ্ঞে পাল্টে যাওয়া দেশের সবচেয়ে বসবাস উপযোগী পরিচ্ছন্ন শহর হিসেবে খ্যাতি পেয়েছে রাজশাহী। নির্মল বায়ুর নগরী হিসেবেও স্বীকৃত এ শহর। নগর উন্নয়নে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা ও জিরো সয়েল প্রকল্প গ্রহণের কারণেই স্বাস্থ্যকর ও পরিচ্ছন্ন শহর হিসেবে দেশের সব শহরের চেয়ে এগিয়ে রয়েছে রাজশাহী।
২০০৮ সালে রাজশাহী সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে মেয়র এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটনকে নির্বাচিত করে রাজশাহী
মহানগরবাসীর সেবার দায়িত্ব অর্পণ করেছিলেন। তিনি রাজশাহী মহানগরীকে একটি উন্নত, পরিচ্ছন্ন, শান্তি ও স্বস্তির আবাসভূমি হিসেবে গড়ে তোলার জন্য প্রচেষ্টা চালিয়েছে। এর ফলে রাজশাহী দেশের একটি পরিচ্ছন্ন মডেল সিটি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এবার রাজশাহীকে মেগাসিটি হিসেবে গড়ে তোলার লক্ষ্যে পরিকল্পনা গ্রহণসহ মাস্টার পস্ন্যান তৈরির কাজ করছেন এই নগরপিতা।
সিটি করপোরেশনের তথ্য বলছে, ২ হাজার ৯৩১ কোটির টাকা ব্যয়ে 'রাজশাহী মহানগরের সমন্বিত নগর অবকাঠামোর উন্নয়ন' শীর্ষক প্রকল্প বাস্তবায়ন হচ্ছে। প্রকল্পের অগ্রগতি ৬০ শতাংশের বেশি। নাগরিকদের চলাচল ও দুর্ঘটনা রোধে ১০টি পথচারী সেতু নির্মাণ করা হচ্ছে। ইতোমধ্যে ২৩৮ দশমিক ৭৫ কিলোমিটার সড়ক কার্পেটিং, ২৬০ দশমিক ৩০ কিলোমিটার সিমেন্ট-কংক্রিট সড়ক, ৩৫০ দশমিক ৫ কিলোমিটার নর্দমা, ৪০ দশমিক ২২ কিলোমিটার ফুটপাত ও ২৪ হাজার ৯৯ দশমিক ৫০ মিটার সীমানাপ্রাচীর নির্মাণ করা হয়েছে। ১৬টি জলাশয়ের (পুকুর) উন্নয়ন ও সৌন্দর্যবর্ধনের কাজ শেষ হয়েছে। ২৯টি ঈদগাহ, ৫২টি গোরস্থান ও একটি শ্মশান ঘাটের উন্নয়ন কাজ বাস্তবায়ন করা হয়েছে।
এছাড়াও চীন, ভারত, কানাডা, নরওয়ে এবং ইন্দোনেশিয়া সরকারের আর্থিক সহযোগিতায় রাজশাহীর যোগাযোগ ব্যবস্থা, নদী খনন, শিক্ষা, সংস্কৃতি, নগরায়ন, কৃষিজ এবং ফলজ দ্রব্যাদি প্রক্রিয়াজাতকরণ ইত্যাদি উন্নয়ন সাধন করার পরিকল্পনা রয়েছে রাজশাহী সিটি করপোরেশনের। এসব ক্ষেত্রে প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকার উন্নয়ন হবে রাজশাহীতে।
গত ১৫ বছরে রাজশাহীতে কর্মসংস্থান সৃষ্টি থেকে শুরু করে প্রসার ঘটেছে ব্যবসা-বাণিজ্যেও। পর্যটন ক্ষেত্রেও বাস্তবায়ন হয়েছে নানা উদ্যোগ। কয়েকটি মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নের কর্মযজ্ঞে মাথাচাড়া দিয়েছে পদ্মাপাড়ে বিশাল বিশাল অবকাঠামো। যুক্তরাষ্ট্রের সিলিকন ভ্যালির আদলে নির্মাণ করা হয়েছে হাই-টেক পার্ক। শহীদ এএইচএম কামারুজ্জামান কেন্দ্রীয় বোটানিক্যাল গার্ডেন ও চিড়িয়াখানায় নির্মিত হয়েছে দেশের দ্বিতীয় বঙ্গবন্ধু নভোথিয়েটার। সড়ক অবকাঠামো সম্প্রসারিত হয়ে প্রতিটি প্রধান সড়ক উন্নীত হয়েছে চার লেনে। যানজট নিয়ন্ত্রণে নেওয়া হয়েছে মূল নগরীতে আরও পাঁচটি ফ্লাইওভার নির্মাণ প্রকল্প। ইতোমধ্যেই দুটি ফ্লাইওভার চালু হয়েছে।
শুধু অবকাঠামো উন্নয়ন নয়, কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও শিল্পায়নে প্রচেষ্টা অব্যাহত আছে রাজশাহীতে। বিসিক শিল্পনগরী-২ ও চামড়াশিল্প পার্ক প্রতিষ্ঠার কাজ চলমান। পদ্মা নদী-তীরবর্তী এলাকা সংস্কার ও সৌন্দর্যবর্ধনের কাজ শেষ হয়েছে। পদ্মাপাড় এখন অন্যতম উন্মুক্ত বিনোদন কেন্দ্র। পদ্মাপাড়-সংলগ্ন দরগাপাড়ায় অবস্থিত হযরত শাহ মখদুম (রহ.)-এর মাজার শরিফ। পদ্মাপাড়ে সিটি করপোরেশনের উদ্যোগে গড়ে তোলা হয়েছে লালন শাহ পার্ক। শাহ মখদুম (রহ.) মাজার, শাহ মখদুম (রহ) কেন্দ্রীয় ঈদগাহ্ ও পদ্মাপাড়ের সৌন্দর্য দেখতে প্রতিদিন ছুটে আসেন অসংখ্য দর্শনার্থী।
জনসাধারণের বহুমুখী চাহিদা অনুযায়ী মহানগরীর বিভিন্ন অবকাঠামো উন্নয়নের মাধ্যমে সময়োপযোগী নাগরিক সেবা পাচ্ছে নগরবাসী। প্রতিদিনই রাজশাহী সিটি করপোরেশনের পরিচ্ছন্নতাকর্মীরা বাসা-বাড়িতে গিয়ে বাঁশিতে ফুঁক দেন। বাঁশির শব্দে গৃহস্থালি বর্জ্য নিয়ে বাইরে আসেন লোকজন। এরপর এসব বর্জ্য নগরীর সেকেন্ডারি ট্রান্সফার স্টেশনে (এসটিএস) রাখেন তারা। সেখান থেকে আরেক দল কর্মী তা ময়লা ফেলার স্থানে নিয়ে যান। যেসব এলাকায় এখনো এসটিএস নির্মাণ হয়নি, সেগুলোতে নির্দিষ্ট একটি জায়গায় বর্জ্য রাখা হয়। সেখান থেকে ভাগাড়ে নেওয়া হয়। নগরীর বর্জ্য অপসারণে আছেন ১ হাজার ৪০০ কর্মী। শহরে বর্তমানে ১২টি এসটিএস আছে।
সব মিলিয়ে বলা যায়, রাজশাহী সিটিতে মানুষের চাওয়া পাওয়ার প্রত্যাশার জায়গা পূরণ হয়েছে। এই নগর বদলে দেয়ার মূল কারিগর নগরপিতা এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটন। তিনি জাতীয় চার নেতার অন্যতম এএইচএম কামারুজ্জামান হেনার সন্তান। খায়রুজ্জামান লিটন বর্তমানে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য।
স্বপ্নের ফেরিওয়ালা খ্যাত এই নগরপিতার লক্ষ্য এখন সিটি করপোরেশনের সেবা আরও সম্প্রসারিত করার। সীমানা বৃদ্ধির বিষয়টি প্রক্রিয়াও চলমান রয়েছে। সীমানা বৃদ্ধির আবেদন অনুমোদন হলে বর্তমান সীমানার সঙ্গে যোগ হবে পবা উপজেলার নওহাটা ও কাটাখালী পৌরসভা এবং কাটাখারি, দামকুড়া ও কর্ণহার থানা। আর ৯৬ দশমিক ৭২ বর্গকিলোমিটার থেকে বেড়ে মহানগরীর আয়তন বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়াবে ৩৫০ বর্গকিলোমিটারে।