শুক্রবার, ০১ নভেম্বর ২০২৪, ১৬ কার্তিক ১৪৩১

মিথ্যা তথ্য দিয়ে এনআরবি ইসলামিক লাইফের মুখ্য নির্বাহী শাহ জামাল

যাযাদি রিপোর্ট
  ১৫ মে ২০২৪, ০০:০০
মিথ্যা তথ্য দিয়ে এনআরবি ইসলামিক লাইফের মুখ্য নির্বাহী শাহ জামাল

অর্থ আত্মসাতের সুনির্দিষ্ট অভিযোগ গোপন করে এবং অভিজ্ঞতার মিথ্যা তথ্য দিয়ে এনআরবি ইসলামিক লাইফ ইন্সু্যরেন্সের মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ অনুমোদন নিয়েছেন শাহ জামাল হাওলাদার। এছাড়াও শিক্ষাগত যোগ্যতা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।

জানা গেছে, ২০২১ সালে বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ) থেকে এনআরবি ইসলামিক লাইফের মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ অনুমোদন নেন শাহ জামাল হাওলাদার। নিয়োগ অনুমোদনে সর্বসাকুল্যে বেতন-ভাতা নির্ধারণ করা হয় আড়াই লাখ টাকা। নিয়োগ অনুমোদনের শর্ত ভঙ্গ করে তিনি প্রায় দ্বিগুণ বেতন-ভাতা নিয়েছেন।

এদিকে গত ৩ বছরে ব্যবসায়িক পারফর্ম্যান্স ভালো করতে না পারলেও দ্বিগুণ বেতন-ভাতা নির্ধারণ করে পুনরায় শাহ জামাল হাওলাদারের নিয়োগ নবায়নের আবেদন করেছে এনআরবি ইসলামিক লাইফ। কোম্পানিটির ভাইস চেয়ারম্যান এম মাহফুজুর রহমান গত ১৮ এপ্রিল এই আবেদন পাঠান। সর্বশেষ ১৬তম বোর্ড সভায় তার নিয়োগ নবায়নের অনুমোদন দেওয়া হয়। তবে তার নিয়োগ নবায়ন ও বেতন-ভাতা বৃদ্ধির বিষয়ে পরিচালকদের অধিকাংশই একমত ছিলেন না বলে জানা গেছে।

তথ্য অনুসারে শাহ জামাল হাওলাদার সর্বশেষ বেস্ট লাইফ ইন্সু্যরেন্সের উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক (ডিএমডি) ছিলেন। ২০২০ সালের ১ জুলাই থেকে ২০২১ সালের ১৬ মার্চ পদত্যাগের পূর্ব পর্যন্ত তিনি কোম্পানিটির এ পদে কাজ করেছেন।

উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক (ডিএমডি) বেস্ট লাইফের মুখ্য নির্বাহীর অব্যবহিত নিম্নপদ নয়। কোম্পানিটির দ্বিতীয় সর্বোচ্চ পদ তথা মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তার অব্যবহিত নিম্নপদ 'অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এডি.এমডি)'।

২০১৩ সালে অনুমোদন লাভের পর থেকে বেস্ট লাইফের অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক পদ ছিল এবং ২০২১ সালের ১৬ মার্চ পদত্যাগের আগ পর্যন্ত কোম্পানিটির অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক ছিলেন মো. খোরশেদ আলম।

শাহ জামাল হাওলাদার এর আগে প্রোটেক্টিভ ইসলামি লাইফের ঊর্ধ্বতন উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক ছিলেন। ২০১৯ সালের ১ জুলাই থেকে ২০২০ সালের ১৭ জুন পর্যন্ত তিনি এ পদে ছিলেন। কোম্পানিটিতে তিনি যোগদান করেন ২০১৪ সালের ৩০ এপ্রিল, উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে।

প্রোটেক্টিভ ইসলামি লাইফেরও দ্বিতীয় সর্বোচ্চ পদ 'অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এডি.এমডি)'। উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক (ডিএমডি) কোম্পানিটির মুখ্য নির্বাহীর অব্যবহিত নিম্নপদ নয়, তৃতীয় সর্বোচ্চ পদ।

২০২০ সালে প্রোটেক্টিভ ইসলামি লাইফের অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক ছিলেন কোম্পানিটির বর্তমান মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা ডা. কিশোর বিশ্বাস। এর আগে কোম্পানিটির অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক পদে ছিলেন আলহাজ জাহাঙ্গীর আলম।

অভিযোগ রয়েছে, পেশাজীবনে মুখ্য নির্বাহীর অব্যবহিত নিম্নপদে কোনো বীমা কোম্পানিতেই চাকরি করেননি, অথচ মুখ্য নির্বাহীর অব্যবহিত নিম্নপদে চাকরির একাধিক সনদ দাখিল করেছেন শাহ জামাল হাওলাদার।

তথ্য অনুসন্ধানে দেখা গেছে, প্রোটেক্টিভ ইসলামি লাইফে মুখ্য নির্বাহীর অব্যবহিত নিম্নপদে চাকরির অভিজ্ঞতার বিষয়ে দু'টি সনদ দাখিল করেছেন শাহ জামাল হাওলাদার। সনদ দু'টি ইসু্য করা হয়েছে ২০২০ সালে ১ ফেব্রম্নয়ারি এবং একই বছরের ১৬ জুন। দু'টি সনদেই স্বাক্ষর রয়েছে কোম্পানিটির তৎকালীন মুখ্য নির্বাহী মো. ইউসুফ আলী মৃধা'র।

২০২০ সালের ১ ফেব্রম্নয়ারি ইসু্য করা চিঠিতে বলা হয়েছে, শাহ জামাল হাওলাদার ২০১৪ সালের ৩০ এপ্রিল ডেপুটি ম্যানেজিং ডাইরেক্টর (উন্নয়ন প্রশাসন ও মার্কেটিং) পদে যোগদান করেন, যা কোম্পানির মুখ্য নির্বাহীর অব্যবহিত দ্বিতীয় পদ।

এতে আরও বলা হয়, প্রোটেক্টিভ ইসলামি লাইফে শাহ জামালের মোট কর্ম অভিজ্ঞতা ৫ বছর ৯ মাস এবং কোম্পানিতে তার ক্যারিয়ারের পুরো সময়টি মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তার অব্যবহিত দ্বিতীয় পদে কর্মরত ছিলেন। অপরদিকে ২০২০ সালের ১৬ জুন ইসু্য করা আরেক চিঠিতে বলা হয়, শাহ জামাল হাওলাদার সিনিয়র ডেপুটি ম্যানেজিং ডাইরেক্টর (উন্নয়ন প্রশাসন ও মার্কেটিং) পদে ২০১৪ সালের ৩০ এপ্রিল প্রোটেক্টিভ ইসলামি লাইফে যোগদান করেন, যা কোম্পানির দ্বিতীয় সর্বোচ্চ তথা মুখ্য নির্বাহীর অব্যবহিত নিম্নপদ। প্রোটেক্টিভ ইসলামি লাইফে মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তার অব্যবহিত নিম্নপদ অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক। প্রোটেক্টিভ ইসলামি লাইফের ঊর্ধ্বতন একজন কর্মকর্তা জানান, কোম্পানির মুখ্য নির্বাহীর অব্যবহিত পরের পদ 'অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক'।

আইডিআরএ'র মূলধন সংক্রান্ত তদন্ত প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, এনআরবি ইসলামিক লাইফ অনুমোদন পায় ২০২১ সালের ৬ মে। অনুমোদনের পর থেকে ২০২৩ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত ৩ বছরে সর্বমোট প্রিমিয়াম আয় করে ৭৮ কোটি ৭৯ লাখ টাকা। এর মধ্যে ব্যয় করে ৬১ কোটি ৭১ লাখ টাকা। এই হিসাবে ব্যবসার আয় থেকে ব্যয় বাদ দিলে কোম্পানিটিতে উদ্বৃত টাকা থাকে ১৭ কোটি ৮ লাখ টাকা। হিসাব অনুসারে এই উদ্বৃত ১৭ কোটি ৮ লাখ টাকা বিনিয়োগ থাকার কথা।

অথচ আইডিআরএর মূলধন সংক্রান্ত তদন্ত প্রতিবেদন অনুসারে ৩১ ডিসেম্বরে ২০২৩ সাল পর্যন্ত কোম্পানিটির প্রিমিয়াম আয় থেকে বিনিয়োগ রয়েছে ২ কোটি ৫০ লাখ টাকা। আর মোট বিনিয়োগ রয়েছে ১৬ কোটি ৬৯ লাখ টাকা। যার মধ্যে মূলধন থেকে বিনিয়োগ আছে ১২ কোটি ৬৯ লাখ টাকা। আর সিকিউরিটিজ বন্ডে বিনিয়োগ আছে ১ কোটি ৫০ লাখ টাকা।

অপরদিকে কোম্পানির পেইড-আপ ক্যাপিটাল ১৮ কোটি টাকা। এই হিসাবে পেইড-আপ ক্যাপিটালের চেয়ে বিনিয়োগ কম আছে ২ কোটি ৮৯ লাখ টাকা। অর্থাৎ গ্রাহকের কাছ থেকে প্রিমিয়াম আয়ের প্রায় সব টাকাই খরচ করে ফেলেছে।

মূলধন সংক্রান্ত আইডিআরএর তদন্ত অনুসারে প্রতিষ্ঠার পর কোম্পানি পরিচালনার জন্য মূলধন থেকে তোলা হয় ৪ কোটি টাকা। এই টাকা অদ্যবধি পুনর্ভরণ করতে পারেনি। অপরদিকে ২০২১ সালে বিদেশে অফিস স্থাপন ও ব্যবসা পরিচালনার জন্য মূলধন থেকে তোলা হয় আরও ৩ কোটি টাকা। এনআরবি ইসলামিক লাইফের মূলধন সংক্রান্ত এই তদন্তটি করা হয় গত ডিসেম্বরে।

আইডিআরএ দাখিল করা ব্যবসা সংক্রান্ত প্রতিবেদনগুলোর তথ্য অনুসারে এনআরবি ইসলামিক লাইফ প্রতিষ্ঠার পর ৩ বছরেই অতিরিক্ত ব্যয় ৯ কোটি ৮২ লাখ টাকা। তবে এমন দুর্বল আর্থিক ভিতের মধ্যেও মুখ্য নির্বাহী নিয়োগ নবায়নে বেতন-ভাতা দিগুণ করেছে কোম্পানিটি।

এদিকে কর্মজীবনে অন্তত ৬টি বীমা কোম্পানিতে চাকরি করেছেন শাহ জামাল হাওলাদার। তবে একটি প্রতিষ্ঠানও তাকে ছাড়াপত্র দেয়নি। ছাড়পত্র ছাড়াই তিনি এক কোম্পানি থেকে অপর কোম্পানিতে নিয়োগ নিয়েছেন।

প্রসঙ্গত, প্রোটেক্টিভ ইসলামি লাইফ ইন্সু্যরেন্সের ১৩ লাখ টাকা প্রিমিয়াম আত্মসাতের অভিযোগে ২০২০ সালের ১৭ জুন তাকে শোকজ করা হয়। ওইদিনই তিনি কোম্পানি থেকে পদত্যাগের জন্য পত্র জমা দেন। তবে পদত্যাগ কার্যকরের আবেদন করেন ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২০ থেকে। প্রোটেক্টিভ ইসলামি লাইফ থেকে শাহ জামালের বিরুদ্ধে ৫টি অভিযোগ আনা হয়।

এ বিষয়ে এনআরবি ইসলামিক লাইফ ইন্সু্যরেন্সের মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা শাহ জামাল হাওলাদার যায়যায়দিনকে বলেন, 'আমার বিরুদ্ধে আনা সব অভিযোগ মিথ্যা। যেমন- আমি প্রোটেকক্টিভ লাইফ ইন্সু্যরেন্সের অর্থ আত্মসাতের প্রশ্নই ওঠে না। আমি সেখানে সিনিয়র ডিএমডি উন্নয়ন ও প্রশাসন ছিলাম। সেখানে প্রিমিয়াম আদায়ের সঙ্গে আমার কোনো সম্পর্কই ছিল না। আর ওই প্রতিষ্ঠান থেকে আমি ছাড়পত্র নিয়ে এসেছি। সুতরাং এখন আর এ বিষয়ে প্রশ্ন তোলার সুযোগ নেই।' এর বেশি কিছু তিনি বলতে চাননি। অফিসে এসে সাক্ষাতের কথা বলেন।

এনআরবি ইসলামিক লাইফ ইন্সু্যরেন্সের প্রিমিয়ামের অধিকাংশ অর্থ খরচের বিষয়ে শাহ জামাল বলেন, 'আমাদের প্রতিষ্ঠান নতুন কোম্পানি। তাই অফিস নেওয়া হয়েছে। ফার্নিচার, গাড়ি ও অন্যান্য সামগ্রী কেনা হয়েছে। তাই অধিকাংশ অর্থ খরচ হয়েছে।'

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে