টাঙ্গাইলে সরকারি নির্দেশ অমান্য করে জনবসতি ঘেঁষে ফসলি জমিতে গড়ে উঠছে চালকল বা অটোরাইস মিল। চালকলে মাড়াইকৃত একই মানের চাল মোড়ক পাল্টে হয়ে যায় উন্নতমানের চাল- বিক্রিও হয় বেশি দামে। চালের বস্তায় ধানের জাত, উৎপাদনের তারিখ ও দাম উলেস্নখ করার সরকারি নির্দেশনা থাকলেও তা মানছেন না টাঙ্গাইলের চালকল মালিকরা। ফলে খুচরা পর্যায়ের ভোক্তারা নিয়মিত ঠকছেন। এতে খুচরা বিক্রেতাদের সঙ্গে চাল ব্যবসায়ীদের বিবাদ নিত্যদিনের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
জেলা শহরের বেশ কয়েকটি খুচরা ও পাইকারি চালের দোকানে গিয়ে দেখা যায়, সরকারি নির্দেশনা উপেক্ষা করে পস্নাস্টিকের বস্তায় চাল বিক্রি করা হচ্ছে। কয়েকটি দোকানে পাটের তৈরি বস্তা ব্যবহার করা হলেও বস্তায় চালের জাত, প্রক্রিয়াজাতকরণের তারিখ ও মিলগেটের মূল্য দেওয়া নেই। ফলে বিভিন্ন জাতের চাল কিনে প্রতারিত হচ্ছেন অনেক ক্রেতা। তাদের নির্দিষ্ট জাতের বদলে দেওয়া হচ্ছে অন্য জাতের চাল। দামের ব্যাপারেও খুশি হতে পারছেন না ক্রেতারা। এক দোকানে ২৫ কেজি ওজনের বস্তার যে দাম রাখা হচ্ছে, অন্য দোকানে তার চেয়ে বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে।
উৎপাদক পর্যায়ের কয়েকজন চালকল মালিক জানান, তারা পাটের বস্তায়ই চাল প্যাকেটজাত করতে চান। কিন্তু বাজারের খুচরা ও মাঝারি শ্রেণির ব্যবসায়ীরা পস্নাস্টিকের বস্তায় চাল নিতে বেশি স্বাচ্ছ্বন্দ্য বোধ করেন। পাটের বস্তার চেয়ে পস্নাস্টিকের বস্তার চালের দাম ২৫ কেজিতে ১১-১২ টাকা বেশি লাগে। পাটের প্রতিটি ২৫ কেজির বস্তার দাম ৩৫-৩৬ টাকা, পক্ষান্তরে পস্নাস্টিকের বস্তার দাম ২৪-২৫ টাকা। ক্রেতারা সাধারণত ভালো চাল কমদামে পেতে চান। সেক্ষেত্রে ২৫ কেজির বস্তায় ১১-১২ টাকা সাশ্রয় করতে ক্রেতারা পস্নাস্টিকের বস্তাই নিতে আগ্রহী হন।
এ ছাড়া কতিপয় ব্যবসায়ী একই জাতের চাল শুধু মোড়ক (বস্তা) পাল্টে উন্নতমানের চাল বলে বেশি দামে বিক্রি করে থাকে। বেশি লাভের আশায় অনেক ব্যবসায়ী একই জাতের চাল বিভিন্ন মোড়কে বস্তাবন্দি করে সরবরাহের অনুরোধ করেন। তারা খোলা বাজারে বস্তার প্রকারভেদে দাম কম বা বেশি বলে বিক্রি করেন। ফলে একই জাতের চাল মোড়ক পাল্টে হয়ে যায় উন্নমানগুণ সম্পন্ন। এতে ভোক্তারা প্রতিনিয়ত প্রতারিত হচ্ছেন।
জেলা শহরের কয়েকজন চাল ব্যবসায়ী জানান, মিল মালিকরা যখন যেভাবে ইচ্ছা তখন সেভাবে দাম বাড়ায়। তাদের সিন্ডিকেট রয়েছে। ফলে সরকারি নির্দেশনা তো দূরের কথা, তারা নিজেদের মতো করে চালের দাম বাড়িয়ে দেয়।
জেলা অটোরাইস মিল মালিক সমিতি জানায়, সরকারি নির্দেশনা মেনে পাটের বস্তায়ই তারা চাল বিক্রি করতে চান। এ বিষয়ে প্রশাসনের সঙ্গে চালকল মালিকদের একাধিকবার বৈঠক হয়েছে। কিন্তু দেশের বড় বড় রাইস মিল মালিকরা পাটের বস্তার পাশাপাশি পস্নাস্টিকের বস্তায়ও চাল বিক্রি করেন। তাদের থামানো গেলে টাঙ্গাইলের চালকল মালিকরা অবশ্যই পাটের বস্তায় চাল বিক্রি করবেন।
টাঙ্গাইল শহরের চালের বাজারের খুচরা ব্যবসায়ী গোবিন্দ চন্দ্র শীল, জিন্নাহ মিয়া, হাসান, ইব্রাহিম মিয়া ও আবুল হোসেনসহ অনেকেই জানান, তারা পাইকারি বাজার থেকে কেনা দামের চেয়ে ২০-৩০ টাকা বেশি দামে ভোক্তা পর্যায়ে বিক্রি করেন। ভোক্তা পর্যায়ে গত এক মাসের ব্যবধানে ২৫ কেজির এক বস্তা চালের দাম ১৫০ থেকে ২০০ টাকা বেড়েছে। সব পণ্যের দামই বেড়েছে- বেশি দামের যন্ত্রণার ভুক্তভোগী তারাও।
তারা আরও জানান, পাটের বস্তার চেয়ে পস্নাস্টিকের বস্তার চালের দাম ১৫-২৫ টাকা কম-বেশি হয়ে থাকে। কিছুটা কমদামে পাওয়ায় পস্নাস্টিকের বস্তার চাল কিনতেই ভোক্তারা স্বাচ্ছ্বন্দ্যবোধ করেন। পাট ও পস্নাস্টিকের বস্তার কারণে চালের মান নিয়ে গ্রাহকদের সঙ্গে তারা কোনো কথা বলেন না। এ ছাড়া পাটের বস্তার চাল উন্নতমানের আর পস্নাস্টিকের বস্তার চাল নিম্নমানের- বিষয়টা আসলে এ রকম নয়। পাটের বস্তার দাম কিছুটা বেশি থাকায় দামও তুলনামূলকভাবে কিছুটা বেশি হয়। ধানের জাতভেদে চালের মান নির্ভর করে- এটা চালকল কারখানার মালিকরা ভালো বলতে পারবে।
টাঙ্গাইল শহরের পাইকারি চালের ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান মেসার্স বাবুল রাইস এজেন্সির মালিক মো. ছানোয়ার হোসেন, মেসার্স লোকনাথ খাদ্য ভান্ডারের মালিক রণজিৎ কুমার শীলসহ অনেকেই জানান, চালের দাম মূলত চালকল কারখানার মালিকরা নির্ধারণ করে থাকেন। তারা চালের মানভেদে খুচরা বিক্রির যে দাম বেধে দেন-সেই দামেই বাজারের খুচরা ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করেন। চালের বস্তায় উৎপাদনের তারিখ বা মেয়াদোত্তীর্ণের তারিখ, চালের নাম, বিক্রিমূল্য সবই মিল কর্তৃপক্ষ বস্তায় মূদ্রণ করে দেয়। তবে ধানের জাত মূদ্রণের কথা থাকলেও এখনো তা কার্যকর হয়নি।
তারা জানায়, পাট বা পস্নাস্টিকের বস্তার কারণে মানভেদে চালের দাম কিছুটা কম বা বেশি হয়ে থাকে। অনেক সময় ভালো মানের চাল বেশিদিন সংরক্ষণের জন্য পাটের বস্তায় প্যাকেটজাত করা হয়। একই জাতের পস্নাস্টিকের বস্তার চালের দাম কম আর পাটের বস্তার চালের দাম বেশি বিষয়টা এমন নয়। এ কাজটাও অটোরাইস মিল মালিকরা করে থাকেন। তারা মূলত কিছুই করেন না- মিল থেকে বস্তা বস্তা চাল কিনে এনে খুচরা বাজারে বিক্রি করে যৎসামান্য কমিশন পান।
টাঙ্গাইল জেলা অটোরাইস মিল মালিক সমিতির সহ-সভাপতি ও কালিহাতী উপজেলা অটোরাইস মিল মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. হানিফ উদ্দিন মিয়া জানান, তারা সব সময়ই পাটের বস্তা ব্যবহারে আগ্রহী। এ লক্ষ্যে জেলা-উপজেলা প্রশাসনের সঙ্গে একাধিক বৈঠকে সিদ্ধান্তও হয়েছে। কিন্তু দেশের বড় বড় চালকল মিল মালিকরা পাটের বস্তার পাশাপাশি পস্নাস্টিকের বস্তায় চাল প্যাকেটজাত করে কিছুটা কমমূল্যে বিক্রি করছে। এ ছাড়া বাজারের পাইকারি ক্রেতাদের একটি বড় অংশ পস্নাস্টিকের বস্তায় চাল নিতে আগ্রহী। বাজারে টিকে থাকতে বাধ্য হয়ে তারাও পাটের বস্তার পাশাপাশি পস্নাস্টিকের বস্তায় চাল বাজারে সরবরাহ করছেন।
জেলা ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক শিকদার শাহীনুর আলম জানান, চালকলের বিষয়টি খাদ্য অধিদপ্তরের দেখভাল করার কথা। পলিথিন বা পস্নাস্টিকের বস্তার বিষয়ে খাদ্য নিয়ন্ত্রকের কার্যালয় থেকে সহযোগিতা চাইলে তারা অভিযান চালাবেন।
টাঙ্গাইল জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক মোহাম্মদ তানভীর হোসেন জানান, চালকল স্থাপনে প্রয়োজনীয় কাগজপত্রসহ যথানিয়মে খাদ্য অধিদপ্তরের নির্ধারিত প্রকৌশলীর কাছে আবেদন করতে হয়। এরপর বয়লার পরিদর্শকের সনদ পেলে সংশ্লিষ্ট অধিদপ্তর থেকে চালকলের লাইসেন্স ইসু্য করা হয়। এক্ষেত্রে তাদের করার তেমন কিছু নেই। তবে চালকলের বিভিন্ন বিষয় সংশ্লিষ্ট দপ্তরের সঙ্গে যোগাযোগ করে ব্যত্যয় পেলে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। ইতোপূর্বে পস্নাস্টিকের বস্তায় চাল সরবরাহ করায় কয়েকটি চালকলে অভিযান চালিয়ে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণের মাধ্যমে জরিমানা করা হয়েছে।
টাঙ্গাইলের জেলা প্রশাসক শরীফা হক জানান, এ বিষয়ে তিনি লিখিত কোনো অভিযোগ পাননি। অভিযোগ পেলে তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন।