রোববার, ২৫ মে ২০২৫, ১১ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২
ফিরে দেখা ২০২৪

বছরজুড়েই শ্রমিক অসন্তোষে ধুঁকেছে পোশাক খাত

বীরেন মুখার্জী
  ২৮ ডিসেম্বর ২০২৪, ০০:০০
বছরজুড়েই শ্রমিক অসন্তোষে ধুঁকেছে পোশাক খাত
বছরজুড়েই শ্রমিক অসন্তোষে ধুঁকেছে পোশাক খাত

তৈরি পোশাক খাতে অস্থিরতা নিয়েই শুরু হয়েছিল চলতি বছর। বেতন বৃদ্ধির দাবিতে শ্রমিকদেও অসন্তোষ চলাকালে জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার ব্যাপক আন্দোলনে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর এ খাতে ফের অসন্তোষ দানা বাঁধে। দেশের পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে পোশাকখাত সংশ্লিষ্ট ঝুট ব্যবসার দখল, কারখানাগুলোতে অগ্নিসংযোগ ও ভাঙচুরের ঘটনায় নিরাপত্তার অভাবে বন্ধ হয়ে যায় কয়েকশ' কারখানা। সব মিলিয়ে পোশাকশিল্পে স্থবিরতা নেমে আসে। অন্তর্বর্তী সরকারের নানামুখী পদক্ষেপে মালিকপক্ষ শ্রমিকদের দাবি মেনে নিলে সাময়িকভাবে এ খাতের পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে শুরু করে। কারখানাগুলোতে কাজের পরিবেশ ফিরে আসে। তবে বছরের শেষভাগে এসে বন্ধ হয়ে যায় বেক্সিমকোর ১৫টি কারখানা।

এদিকে, চলতি বছর পোশাক রপ্তানি বাড়লেও ইউরোপীয় ইউনিয়নের ক্রেতারা রপ্তানি হওয়া বাংলাদেশের পোশাকের দাম কমিয়েছেন প্রায় ৫ শতাংশ। আর যুক্তরাষ্ট্রের ক্রেতা প্রতিষ্ঠানগুলো প্রায় ৮ শতাংশ পর্যন্ত কমিয়েছে। এতে করে তৈরি পোশাক খাতের উদ্যোক্তারা উদ্বেগের মধ্য দিয়েই পার করছেন চলতি বছর। এ বছর বিদেশে পোশাক রপ্তানি ও আয় বাড়লেও সব মিলিয়ে পোশাক খাত এক অস্থিরতাপূর্ণ বছর পার করছে।

1

বাংলাদেশ রপ্তানি উন্নয়ন বু্যরোর তথ্য মতে, গত পাঁচ মাসে (জুলাই-নভেম্বর) সামগ্রিক পণ্য রপ্তানির ৮১ শতাংশ তৈরি পোশাক খাত থেকে এসেছে। এ সময়ে ১ হাজার ৬১২ কোটি ডলারের তৈরি পোশাক রপ্তানি হয়েছে, যা গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ১২ শতাংশ বেশি। এর মধ্যে গত মাসেই ১৭৪ কোটি ডলারের নিট পোশাক রপ্তানি হয়, প্রবৃদ্ধি প্রায় ১৩ শতাংশ। অন্যদিকে গত ১০ মাসে ওভেন পোশাক রপ্তানি হয়েছে ১৫৭ কোটি ডলারের, প্রবৃদ্ধি ২০ শতাংশ।

খাত সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, করোনা-পরবর্তী ইউরোপে তৈরি পোশাক রপ্তানি বেড়েছিল। কিন্তু এক বছর না যেতেই ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধের প্রভাবে পুরো ইউরোপ উচ্চ মূল্যস্ফীতির কবলে পড়ে। এতে মানুষ পোশাক কেনা কমিয়ে দেয়। বর্তমানে ইউরোপে মূল্যস্ফীতি স্বাভাবিক হচ্ছে। এ কারণে পোশাকের বিক্রি বাড়ছে।

অন্যদিকে বিদেশি ক্রেতারা পোশাকের দাম কমানোয় উদ্বিগ্ন হওয়ার একাধিক কারণ উলেস্নখ করে বেশ কয়েকজন ব্যবসায়ী জানিয়েছেন, পোশাকের দাম বাড়ানো না হলে বাংলাদেশের গার্মেন্টস খাতে বিপর্যয় নেমে আসবে। নাম প্রকাশ না করে একজন গার্মেন্টস মালিক বলেন, 'খরচ বেড়ে যাওয়ায় নতুন মজুরি কাঠামো বাস্তবায়ন এবং ৯ শতাংশ ইনক্রিমেন্ট দেওয়া তার জন্য অত্যন্ত কঠিন হয়ে পড়েছে। শ্রমিকদের বেতন দিতে গিয়েই তিনি হিমশিম খাচ্ছেন।'

খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আর্থিক সংকটে পড়েছে বেশিরভাগ গার্মেন্টস কারখানা এবং কিছু কারখানা ইতোমধ্যে বন্ধ হওয়ার আশঙ্কাও রয়েছে। বিশেষ করে অতীতে ভালো অবস্থানে থাকা কারখানাগুলোও এখন সংকটে পড়েছে। এই খাতের উদ্যোক্তাদের কয়েকজন বলছেন, বায়াররা বাংলাদেশ ছেড়ে ভারত, পাকিস্তানসহ অন্য দেশে চলে যাচ্ছে। শিল্প মালিকদের মন্তব্য- জ্বালানি সংকট, শ্রমিক অসন্তোষ ও ব্যাংক খাতের অস্থিতিশীলতা, উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি, গ্যাস-বিদু্যতের ঘাটতি, বিশ্বব্যাপী উচ্চ মূল্যস্ফীতিসহ বেশ কয়েকটি কারণে তৈরি পোশাক রফতানিতে ঝুঁকি বাড়ছে।

গার্মেন্টস ব্যবসায়ীরা জানান, বিশ্ববাজারে সবচেয়ে বড় পোশাক রপ্তানির গন্তব্য দেশ যুক্তরাষ্ট্র। পোশাক রপ্তানি আয়ের ২০ থেকে ২২ শতাংশই আসে যুক্তরাষ্ট্র থেকে। কিন্তু বর্তমানে এই মার্কেটে বাংলাদেশ সবচেয়ে বেশি চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) তথ্য অনুযায়ী, গত ৬ মাসে পোশাক খাতে ১০০ কারখানা বন্ধ হয়েছে। বেকার হয়েছে প্রায় ৫০ থেকে ৬০ হাজার শ্রমিক। শ্রমিকদের ঠিকমতো বেতন দিতে পারছে না অন্তত ১৫৮টি কারখানা।

ইউরোপীয় পরিসংখ্যান সংস্থা ইউরোস্ট্যাটের প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে অক্টোবর- এই ১০ মাসে বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের দাম কমিয়েছে ৪ দশমিক ৯২ শতাংশ।

বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম সম্প্রতি একটি সংবাদমাধ্যমে বলেন, 'বাংলাদেশের পোশাকের দাম কমানোর পর আমাদের উৎপাদন খরচ আরও বেড়েছে। এটি দেশের পোশাকশিল্পের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তিনি বলেন, খরচ বেড়ে যাওয়ায় অনেক কারখানা মজুরি কাঠামো বাস্তবায়ন করতে পারেনি। পোশাকের দাম না বাড়ানো হলে অনেক কারখানাই ৯ শতাংশ ইনক্রিমেন্ট বাস্তবায়ন করতে পারবে না।'

এখনো পোশাকের দাম নিয়ে চ্যালেঞ্জের মধ্যে পড়তে হচ্ছে উলেস্নখ করে তিনি বলেন, 'কম মূল্যের কারণে অনেক ক্রয়াদেশই নেওয়া যাচ্ছে না। পাশাপাশি গ্যাস সংকটের কারণে উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। গ্যাস সরবরাহ বাড়ানো না গেলে ক্রয়াদেশ থাকলেও রপ্তানি বৃদ্ধি করা সম্ভব নয়। তাছাড়া ১৬ থেকে ১৭ শতাংশ সুদে ঋণ নিয়ে ব্যবসা করে বেশি দিন টিকে থাকা যাবে না।'

পর্যবেক্ষকরা বলছেন, এসব কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার ক্ষেত্রে পোশাকশিল্প মালিকদের সক্ষমতা অনেক কমে গেছে। বড় লোকসান থেকে বাঁচতে বেশিরভাগ কারখানার মালিক কম দামে পোশাক বিক্রি করছেন। আগে যে পোশাক বিক্রি করে ১০০ টাকা পাওয়া যেত, এখন সেই একই পোশাক বিক্রি করে ৯৫ টাকা পাওয়া যাচ্ছে। অথচ আগে যে পোশাক তৈরি করতে আমাদের খরচ হতো ১০০ টাকা, এখন সেই একই পোশাক তৈরিতে খরচ করতে হচ্ছে ১৫০ টাকা।

খাত সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, পোশাকশিল্পে অভ্যন্তরীণ বেশ কিছু সমস্যা রয়েছে। এর মধ্যে গ্যাস-বিদু্যতের সংকট, ব্যাংকিং খাতে অস্থিরতা, এনবিআরের পলিসিগত সমস্যা অন্যতম। এরই মধ্যে গত ১৫ ডিসেম্বর জারি করা বিজ্ঞপ্তিতে বেক্সিমকো গ্রম্নপের ১৫টি পোশাক কারখানা বন্ধ ঘোষণা করে। এতে প্রায় ৪০ হাজার কর্মী কর্মহীন হয়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। আর নতুন করে এই অস্থিরতা নিয়েই বছর পার করছে তৈরি পোশাকখাত।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে