পাবনা সদর উপজেলার ভাড়ারা ইউনিয়নের ভাড়ারা পশ্চিম জামুয়া গুচ্ছগ্রামে নির্মিত আশ্রয়ণ প্রকল্পের ৬০টি ঘর গুড়িয়ে দিয়ে জমি দখলের অভিযোগ উঠেছে স্থানীয় একটি প্রভাবশালী চক্রের বিরুদ্ধে। শুধু ঘর ভাঙচুরই নয়, লুট করা হয়েছে ঘরের দরজা, জানালা, টিনের চালসহ প্রায় সবকিছু।
অভিযোগ উঠেছে, স্থানীয় জামায়াত-বিএনপি সমর্থক কিছু লোক ঘর স্থাপন করা ওই জমিকে নিজেদের দাবি করে পরিবারগুলোকে জোরপূর্বক তুলে দিয়েছে। একইসঙ্গে ঘর ভেঙে সবকিছু লুট করে নিয়ে গেছে। অথচ ঘর ভেঙে ফেলা ঘটনার পাঁচ মাসেও টনক নড়েনি প্রশাসনের।
ওই আশ্রয়ণ প্রকল্পের জমি নিজেদের দাবি করে আদালতে মামলা চলমান উলেস্নখ করে সেখানে সাতজনের নামসংবলিত একটি সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে দিয়েছে চক্রটি। ভাঙচুর লুটপাটের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগ অস্বীকার করেছে তারা। তাদের দাবি, আওয়ামী লীগ সরকারের সময় আদালতে মামলা চলমান থাকা অবস্থায় জোরপূর্বক তাদের জমি দখল করে সেখানে আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘর নির্মাণ করা হয়।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দেশব্যাপী ভূমিহীনদের জমিসহ ঘর দেওয়ার উদ্যোগ নেয় পতিত আওয়ামী লীগ সরকার। তারই অংশ হিসেবে ২০২০ সালে পাবনা সদর উপজেলার ভাড়ারা ইউনিয়নের পশ্চিম জামুয়া গ্রামে ভূমিহীন ৬০টি পরিবারকে দলিলসহ ঘর বুঝিয়ে দেয় স্থানীয় প্রশাসন।
পরবর্তীতে ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার আন্দোলনে আওয়ামী সরকারের পতনের পর ওইদিনই সন্ধ্যায় ও রাতে সেই জমি নিজেদের দাবি করে বসবাস করা ভূমিহীন পরিবারগুলোকে ঘর ছেড়ে চলে যেতে নির্দেশ দেয় জমির স্থানীয় প্রভাবশালী একটি চক্র। আশ্রয়ণ প্রকল্পের বাসিন্দাদের অভিযোগ, তাদের অস্ত্রের মুখে ঘর ছাড়তে বাধ্য করে তারা। গুড়িয়ে দেওয়া হয় আশ্রয়ণ প্রকল্পের সবগুলো ঘর। লুট করা হয় ঘরের দরজা, জানালা, টিনের চালসহ সবকিছু। স্থানীয়রা জানায় সেখানে ৬০টি ঘর থাকলেও বসবাস করতেন ৪০টি পরিবার।
আশ্রয়ণ প্রকল্পের বাসিন্দারা নিজের প্রাণ বাঁচাতে অন্যত্র আশ্রয় নিলে ওই জমি নিজেদের দাবি করে সদর সিনিয়র সহকারী জজ আদালতে মামলা চলমান আছে উলেস্নখ করে একটি সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে দেয় চক্রটি। জমির মালিক দাবিদার সাতজন হলেন, ভাড়ারা পশ্চিম জামুয়া গ্রামের আকরাম প্রামাণিক, উম্মত প্রামাণিক, আক্কাস প্রামাণিক, ইব্রাহিম প্রামাণিক, ইসমাইল প্রামাণিক, নায়েব আলী ও নবাব আলী। এদের বেশিরভাগই জামায়াত ও দু-একজন বিএনপি সমর্থক বলে নিশ্চিত করেছে একাধিক সূত্র। সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিষয়টি প্রকাশ হলে নজরে আসে সবার।
গত সোমবার দুপুরে সরজমিনে ভাড়ারা পশ্চিম জামুয়া গ্রামের আশ্রয়ণ প্রকল্পে গিয়ে দেখা যায়, সেখানে যেন সাইক্লোন বা টর্নেডো বয়ে গেছে। ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে প্রকল্পটি। সুনশান নীরবতা। কেউ নেই। প্রকল্পের ৬০টি ঘরের সবই ভাঙাচোরা। দরজা, জানালা, টিন, ইটের দেয়াল কোনো কিছুই অবশিষ্ট নেই। ভেঙে ফেলা ইট-সুরকি চারদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। কোনো ঘর সবটুকুই ভাঙা, কোনোটি আবার অর্ধেক। ভেঙে ফেলা ঘরে লোহার রড বেরিয়ে রয়েছে। প্রায় প্রতিটি ঘরের সামনে ও আশপাশে শাকসবজি আবাদ দেখা যায়।
প্রকল্পের প্রবেশমুখেই একটি সাইনবোর্ড চোখে পড়ে। যেখানে লেখা 'নিম্নবর্ণিত সম্পত্তি লইয়া পাবনা সদর সিনিয়র সহকারী জজ আদালতে মামলা চলমান আছে। বাদী সাতজনের নাম, বিবাদী সরকার। জমির পরিমাণ ১ দশমিক ৩৮ একর।'
সাংবাদিক এসেছে শুনে প্রকল্প এলাকায় উপস্থিত হন জমির মালিক দাবিদার পশ্চিম জামুয়া গ্রামের নায়েব আলী ও আক্কাস প্রামাণিকের ছেলে আতিক প্রামাণিক। তারা বলেন, 'এই জমি আমাদের। কিন্তু পতিত সরকারের সন্ত্রাসী আবু সাইদ খান চেয়ারম্যান সন্ত্রাসী বাহিনী দিয়ে এই জমি জোর করে দখল নিয়ে প্রশাসনকে দিয়ে আশ্রয়ণ প্রকল্প করেছিল।'
তারা আরও বলেন, 'এই জমি নিয়ে ২০১০ সালে ও ২০২০ সালে আদালতে মামলাও করেছি আমরা। সেই মামলা চলমান থাকা অবস্থায় প্রশাসনের লোকজন নিজেদের ইচ্ছামতো আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘর করেছে। আমরা অসহায় ছিলাম, কিছু করতে পারিনি। আমাদের জমি দাবি করে তাদের চলে যেতে বলেছিলাম, তবে ঘর ভাঙচুরের সঙ্গে আমরা জড়িত না। তারা নিজেরাই ঘরের সবকিছু ভেঙে নিয়ে চলে গেছে। এখানে আমাদের ওপর মিথ্যা দোষারোপ করা হচ্ছে। তবে তাদের জমির স্বপক্ষে কোনো দলিল বা কাগজপত্র দেখাতে পারেননি তারা।'
আশ্রয়ণ প্রকল্পে বসবাস করা ভূমিহীনদের খোঁজ করে জানা গেল তারা পার্শ্ববর্তী বাঁধে বসবাস করছেন। সেখানে গিয়ে দেখা যায়, ফুলমালা বেগম বাঁধের নিচে ছোট্ট একটা টিনের চাল ও পাটকাঠির বেড়া দিয়ে একটি ঘর তুলে একমাত্র ছেলেকে নিয়ে বসবাস করছেন। তার আশপাশে এ রকম ভুক্তভোগী পাওয়া গেল আরও কয়েকজনকে।
সেদিনের কথা জানতে চাইলে কান্নাজড়িত কণ্ঠে ফুলমালা বেগম বলেন, 'শেখ হাসিনা পালায়ে যাবার পর সন্ধ্যার সময় কিছু লোকজন এসে আমাগারে এক ঘণ্টার মধ্যি ঘর ছাইড়ে দিয়ার জন্যি নির্দেশ দেয়। তখন রান্না করতেছিলাম। তাগারে অনুরোধ কইরেও কাম হয় নাই। সারারাত না-খায়ে ঘরের বাইরে বসে কাঁদিছিলাম। সকালে কাপড় চুপুর লিয়ে বাপের বাড়িতে যাই। সেহেন থেনে এই বাঁধে আইসে কোনোরহমে এই ঘরডা তুইলে আছি। আমরা সরকারের কাছে মাথা গুজার ঠাঁই চাই।'
বাচ্চু প্রামাণিকের স্ত্রী ফাতেমা খাতুন বলেন, 'ওইদিন পরথম কয়েকজন আইছিল। ঘণ্টাখানেক পর পিরায় ৩/৪শ' লোক আইসে আমাগারে ওপর সেই হম্বিতম্বি। এক ঘণ্টা সুময় দিয়ে কইলো যার যা আছে টুপলা বাইধে চইলি যা। না হলি বিপদ হবি। এই কয়া ভাঙচুর শুরু করে। পরে কি করবো, দিশা মিশা না পায়া যা ছিল কাপড়-চোপড় একটা ছাগল ছিল লিয়ে চইলে আসি। পরে সেই ছাগলডা বেইচে এই বাঁধে কুনুরহম ঘরডা তুইলে আছি বলে কান্নায় ভেঙে পড়েন।'
মৃত আবেদ শেখের স্ত্রী বৃদ্ধা ফাতেমা বেগমের (৭০) ছেলে আলম শেখ বলেন, 'ভাঙচুর শুরু হলি আমার বৃদ্ধা মাকে নিয়ে পাগলের মতো হয়ে গেছিলাম। কোনো যাবো কি করবো দিশেহারা অবস্থা তখন। পরে অন্যের বাড়িতে আশ্রয় লেই। আর দিনমজুরী কইরে বাঁধের এহেনে আইসে ছাপড়া তুইলে মাকে লিয়ে আছি।'
ঘটনার পর প্রশাসনকে বারবার জানানো হলেও কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি বলে অভিযোগ করেন ভাড়ারা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সুলতান মাহমুদ খান। তিনি বলেন, 'ভুক্তভোগীরা এখন বাঁধের ওপর মানবেতর জীবন-যাপন করছে। তাদের টয়লেট, পানির ব্যবস্থা নাই। দুর্বিষহ দিন কাটাচ্ছেন তারা। সরকারের সঙ্গে দখলদারদের জমি নিয়ে ঝামেলা থাকুক সমস্যা নাই। কিন্তু এই গরিব মানুষগুলোর তো কোনো দোষ নাই। তারা কোথায় যাবে এখন।'
তাদের দ্রম্নত পুনর্বাসনের দাবি জানান তিনি।
এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে পাবনা জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মফিজুল ইসলাম বলেন, 'বাড়িগুলো ভেঙে ফেলা হয়েছে, সে বিষয়টি জানা ছিল না। তবে নজরে আসার পর আমি সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে সরজমিন পরিদর্শন করে প্রতিবেদন দিতে বলেছি। পুরো বিষয়টি জানার পর পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়া হবে। যদি কেউ ভেঙে থাকে তদন্ত করে দোষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানান তিনি।'
জমি নিয়ে মামলা আছে কি না জানা নেই উলেস্নখ করে জেলা প্রশাসক বলেন, 'মামলার কাগজপত্র না দেখে বিষয়টি নিয়ে কিছু বলা সম্ভব নয়।'
পাবনা সদর উপজেলা প্রশাসনের তথ্য অনুযায়ী, ওই আশ্রয়ণ প্রকল্পের প্রতিটি ঘর নির্মাণে খরচ হয় ১ লাখ ৭১ হাজার টাকা। সে হিসেবে ৬০টি ঘর নির্মাণে সরকারের খরচ হয়েছে এক কোটি দুই লাখ ষাট হাজার টাকা।