শনিবার, ১০ মে ২০২৫, ২৭ বৈশাখ ১৪৩২
ঝিনাইদহে গুলিতে নিহত ৩

মামলা হয়নি, আটকও নেই, স্থানীয়রা আতঙ্কে

রোববার সকালে ঘটনাস্থলে গিয়ে স্থানীয় বাসিন্দাদের সাথে কথা বলতে চাইলে তারা অপরাগতা প্রকাশ করেন। তাদের সবার মধ্যে আতঙ্কের ছাপ দেখা যায়
ঝিনাইদহ প্রতিনিধি
  ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০০:০০
মামলা হয়নি, আটকও নেই, স্থানীয়রা আতঙ্কে

ঝিনাইদহের শৈলকুপায় পূর্ববাংলার কমিউনিস্ট পার্টির সামরিক কমান্ডর হানিফ আলীসহ তিনজনকে গুলি করে হত্যার ঘটনায় এখনো কোনো মামলা হয়নি। হত্যার দুইদিন পার হলে পুলিশ এখনো কাউকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি। এদিকে চাঞ্চল্যকর তিনজনকে হত্যার পর এক সময়ের চরমপন্থী অধু্যষিত এ জেলার মানুষের মধ্যে নতুন করে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। এলাকায় এখনো থমথমে অবস্থা বিরাজ করছে। রোববার সকালে ঘটনাস্থলে গিয়ে স্থানীয় বাসিন্দাদের সাথে কথা বলতে চাইলে তারা অপরাগতা প্রকাশ করেন। তাদের সবার মধ্যে আতঙ্কের ছাপ দেখা যায়।

শুক্রবার রাত ৯টার দিকে ঝিনাইদহের হরিণাকুন্ডু, শৈলকুপা ও কুষ্টিয়ার ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় থানার সীমান্তবর্তী শৈলকুপা উপজেলার রামচন্দ্রপুর ত্রিবেণি শ্মশান খাল এলাকায় হানিফের সাথে তার দুই সহযোগী লিটন হোসেন (৩৬) ও রাইসুল ইসলাম (২৮) কে গুলি করে হত্যা করে সন্ত্রাসীরা। এদিকে ওই রাতেই হত্যার দায় স্বীকার করে চরমপন্থী সংগঠন জাসদ গণবাহিনীর নেতা কালু পরিচয়ে গণমাধ্যমকর্মীদের কাছে খুদে বার্তা পাঠায়। যদিও ওই বার্তা নিয়ে পুলিশ ও স্থানীয়দের মধ্যে ধোয়াশা ও সন্দেহর সৃষ্টি হয়েছে।

এদিকে নিহত হানিফের স্ত্রী শান্তি খাতুন অসুস্থ্য হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। রোববার তার সাথে দেখা করতে গেলে তার স্ত্রী কান্নাজড়িত কন্ঠে বলেন ওরা আমার সবকিছু শেষ করে দিযেছে। এসময় তার স্বজনরা রুমে প্রবেশ করেন। এরপর সাংবাদিক পরিচয় পেয়ে রুম থেকে বের হয়ে যাওয়ার অনুরোধ করেন।

রোববার ঘটনাস্থলে গিয়ে স্থানীয়দের সাথে কথা বলে জানা যায়, ঝিনাইদহ, চুয়াডাঙ্গা, কুষ্টিয়া অঞ্চলের চরমপন্থীদল পূর্ব-বাংলা কমিউনিষ্ট পার্টির নেতা হানেফ আলী দীর্ঘ ১৪ বছর কারাভোগের পর রাষ্ট্রপতির ক্ষমায় বাইরে এসে আবারো বেপরোয়া হয়ে উঠেছিল। মৎস্যজীবী লীগে নাম লিখিয়ে প্রকাশ্য রাজনীতিতে নেতা হয়ে যান। গোপনে যুক্ত থেকে নেতৃত্ব দিতেন চরমপন্থীদের। প্রভাব খাটিয়ে বাওড় দখল, এলাকায় প্রভাব বিস্তার

করে দখল বানিজ্য শুরু করেন। গেল জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামীলীগের গয়ে প্রভাব বিস্তারের অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে।

শুক্রবার দিবাগত রাতে ঝিনাইদহের শৈলকুপা উপজেলার রামচন্দ্রপুর গ্রামের মাঠে তাকে প্রতিপক্ষরা গুলি করে হত্যা করেছে। এ সময় তার সঙ্গে আরো দুই সহযোগিকে হত্যা করে সন্ত্রাসীরা। হানেফ আলী (৫৬) ঝিনাইদহের হরিনাকুন্ডু উপজেলার আহাদনগর গ্রামের রাহাজ উদ্দিনের ছেলে। তার সঙ্গে খুন হন তারই শ্যালক একই উপজেলার শ্রীরামপুর গ্রামের উম্মাদ হোসেনের ছেলে লিটন হোসেন (৩৫) ও কুষ্টিয়া ইবি থানার পিয়ারপুর গ্রামের আরজান আলীর ছেলে রাইসুল ইসলাম রাজু (২৬)। তাদের সবাইকে মাথায় গুলি করে মারা হয়েছে।

রোববার সকাল পর্যন্ত এই তিন খুনের বিষয়ে থানায় কোনো মামলা হয়নি। শৈলকুপা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মাছুম খাঁন সকাল ১১টার দিকে জানান, এখনও মামলা হয়নি তবে আজ হবে। মামলার প্রস্তুতি চলছে। এখন পর্যন্ত তারা কাউকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি বলেও জানান।

এলাকাবাসি জানান, হানেফ আলী ৯০ দশকে চরমপন্থী দলের সঙ্গে যুক্ত হন। জনযুদ্ধের (লাল পতাকা) আঞ্চলিক নেতা হিসেবে ঝিনাইদহের হরিনাকুন্ডু, চুয়াডাঙ্গার আলমডাঙ্গ, কুষ্টিয়ার কিছু অংশে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেন। তার চলার পথে কোনো বাধা রাখতেন না। একে একে ১৪ টি হত্যা মামলায় আসামী হয়ে যান। এছাড়াও তার বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি, বোমা হামলার একাধিক মামলা রুজু হয়। ১৯৯৯ সালের মে মাসে হানেফ পুলিশের হাতে ধরা পড়েন। তার বিরুদ্ধে একটি হত্যা মামলায় ফাঁসির আদেশ হয়। দীর্ঘ ১৪ বছর কারাভোগের পর ২০১৬ সালের দিকে রাষ্ট্রপতির সাধারণ ক্ষমায় তিনি কারাগার থেকে মুক্তি পান। হানেফ আলীর পরিবারের সদস্যরা জানান, হানেফ কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে প্রথম ৬ বছর কখনও ঢাকায় কখনও এলাকায় থেকেছেন। গত তিন বছর হলো এলাকায় বসবাস করছেন।

স্থানীয়রা আরো জানান, হানেফ আলী ২০১৬ সালে ছাড়া পান, এর পরের বছর ২০১৭ সালে স্থানীয় নারানকান্দি বাওড়ে খুনের ঘটনা ঘটে। বাওড় মৎস্যজীবী সমিতির সভাপতি জিয়াউল হক সন্ত্রাসীদের গুলিতে খুন হন। পরবর্তীতে এই বাওড়ের কতৃত্ব নেন হানেফ আলী। শুরু করেন মাছের চাষ, নাম লেখান প্রকাশ্য রাজনীতিতে। যোগদান করেন হরিনাকুন্ডু উপজেলা মৎস্যজীবী লীগে। অল্পদিনে পেয়ে যান উপজেলা শাখার সহ-সভাপতির দায়িত্ব।

আলফাজ উদ্দিনের শ্যালক শহিদুল ইসলাম জানান, আওয়ামীলীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পরপরই তার দুলাভাই হত্যার স্বীকার হন। কুলবাড়িয়া গ্রামে আদালত মন্ডলের বাড়িতে রাতে বসে গল্প করছিল। এমন সময় সন্ত্রাসীরা তাকে ধরে জবাই করে হত্যা করে। এই ঘটনায় তার বোন সম্পত্তি খাতুন বাদী হয়ে একটি মামলা করেন। এই মামলায় হানেফ আলীর ফাসির আদেশ হয়।

অবশ্য হানেফ আলীর ছোট ভাই, হরিনাকুন্ডু উপজেলা পরিষদের সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান সাজেদুর রহমান এশা দাবি করেন, তার ভাই রাজনৈতিক কারনে একাধিক মামলার আসামী হয়েছিল। সব মামলা থেকে তিনি খালাস পেয়ে যান। একটি মামলায় সাধারণ ক্ষমায় মুক্ত হন। তিনি ছাড়া পেয়ে ৬ বছর ঢাকায় ছিলেন। এলাকায় আসলে অনেকে অনেক কথা বলতে পারে, এই ভেবে ঢাকায় ছিলেন।

শৈলকুপায় তিন হত্যার বিষয়ে সংবাদকর্মীদের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে ঝিনাইদহের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ইমরান জাকারিয়া বলেন, হানেফ ছিল এলাকার ত্রাস। তার বিরুদ্ধে অসংখ্য হত্যাসহ অনান্য অপরাধের মামলা ছিল। সে সাধারণ ক্ষমায় কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে বাইরে এসে অপরাধ কর্মকান্ডে যুক্ত ছিল। প্রতিপক্ষরা তাকে হত্যা করেছে বলে তারা ধারনা করছেন।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে