রোববার, ০৪ মে ২০২৫, ২১ বৈশাখ ১৪৩২

সরকার পরিচালনায় বর্ধিত ব্যয়, চাপ বাড়াচ্ছে বরাদ্দে

এই ব্যয়ের চাপ রয়েছে আগামী অর্থবছরের বাজেটেও। এমন পরিস্থিতিতে রাজস্ব আয়ের বড় অংশ পরিচালন খাতে বরাদ্দ রাখছে অর্থ মন্ত্রণালয়...
রেজা মাহমুদ
  ০৮ মার্চ ২০২৫, ০০:০০
সরকার পরিচালনায় বর্ধিত ব্যয়, চাপ বাড়াচ্ছে বরাদ্দে

বিগত কয়েক অর্থবছর ধরেই সরকারের পরিচালন ব্যয় বাড়ছে। ফলে প্রতি বছরই এ খাতে বাড়াতে হয়েছে বরাদ্দের পরিমাণ। এই বরাদ্দ বাড়াতে গিয়ে টান পড়ছে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির অর্থে। আর বর্ধিত এই ব্যয়ের চাপ রয়েছে আগামী অর্থবছরের বাজেটেও। এমন পরিস্থিতিতে রাজস্ব আয়ের একটি বড় অংশ পরিচালন খাতে বরাদ্দ রাখছে অর্থ মন্ত্রণালয়।

অর্থমন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, ব্যাপক এই পরিচালন ব্যয়ের চাপ সামলাতে আগামী ২০২৫-২৬ অর্থবছরের জন্য ৮ লাখ ৪৮ হাজার কোটি টাকার বাজেট প্রণয়ন করতে যাচ্ছে অর্থ মন্ত্রণালয়, এবং প্রাক্কলিত বাজেটে এডিপিতে বরাদ্দের তুলনায় পরিচালন খাতে বরাদ্দ ১১৪ শতাংশ বেশি রাখছে, যা ১৪ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ ব্যবধান বলে জানান মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মূলত বিপুল পরিমাণ ভর্তুকি, ঋণের সুদ পরিশোধের ক্রমবর্ধমান ব্যয় এবং সরকারি খাতের বেতন-ভাতা বৃদ্ধির কারণে সরকারের আর্থিক সক্ষমতা সংকুচিত হয়েছে। যে কারণে, উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর অর্থায়ন ঋণনির্ভর রেখেই আগামী অর্থবছরের বাজেট প্রণয়ন করতে হচ্ছে অন্তর্বর্তী সরকারকে।

চলতি অর্থবছরের (২০২৪-২৫) সংশোধিত বাজেটে পরিচালন ব্যয়ের মধ্যে ২৩ শতাংশ ব্যয় হয় সরকারি চাকরিজীবীদের বেতন-ভাতা ও পেনশনে। এছাড়া, ২২ শতাংশ ব্যয় হয় ঋণের সুদ পরিশোধ, এবং ২০ শতাংশ ব্যয় হয় ভর্তুকি ও প্রণোদনায়। ২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেট, চলতি অর্থবছরের বাজটের চেয়ে ১৪ শতাংশ বেশি, যেখানে পরিচালন ব্যয়ে বরাদ্দের আকার ৫ লাখ ৭৮ হাজার কোটি টাকা (৬৮ শতাংশ) বলে জানিয়েছে অর্থ বিভাগের সূত্রগুলো।

চলতি অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটে এডিপিতে বরাদ্দ প্রাক্কলন করা হয়েছে ২.৭০ লাখ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরের মূল বাজেটে এডিপিতে বরাদ্দ ছিল ২.৬৫ লাখ কোটি টাকা। অর্থাৎ বেড়েছে মাত্র ৫ হাজার কোটি টাকা। তবে গত এক দশকের বাজেট বিশ্লেষণে সরকারের পরিচালন ও উন্নয়ন ব্যয়ের মধ্যে ব্যবধান বাড়ার চিত্র উঠে এসেছে। ২০১১-১২ অর্থবছরের বাজেটে পরিচালন ব্যয়ের পরিমাণ উন্নয়ন ব্যয়ের চেয়ে ১২৪ শতাংশ বেশি ছিল। পরের অর্থবছরগুলোতে এই ব্যবধান কমতে শুরু করে। তবে ২০১৯-২০ অর্থবছর থেকে ধারাবাহিকভাবে এই ব্যবধান বাড়ছে। চলতি অর্থবছর এটি বেড়ে ৯১ শতাংশে দাঁড়িয়েছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আগের সরকার রাজস্ব আয়ের পুরোটা ব্যয় করেছে পরিচালন ব্যয়ে। যার ফলে সরকারের উন্নয়ন কর্মকান্ড পুরোটাই ঋণনির্ভর রেখে আগামী অর্থবছরের বাজেট প্রণয়ন করছে অর্থ মন্ত্রণালয়।

এ বিষয়ে অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, এসব ব্যয় নিয়ন্ত্রণ করে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে ব্যয় করা হলে অর্থনীতি ও মানবসম্পদ উন্নয়নে তা ভূমিকা রাখত। স্কুল-কলেজে শিক্ষা উপকরণের সংকট রয়েছে, শিক্ষকের বেতনও এদেশে অনেক কম। একজন সরকারি প্রাইমারি শিক্ষকের চেয়েও ঢাকার একটি প্রাইভেট কার চালকের বেতন অনেক বেশি। মফস্বলে অনেক প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যসেবা ও ওষুধ পাওয়া যায় না। পরিচালন ব্যয়ে সরকারের অপচয় নিয়ন্ত্রণ করে স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাতের উন্নয়নে মনোযোগ দেওয়া উচিত।

তিনি আরও বলেন, ভর্তুকি কমানোর কথা যত সহজে বলা যায়, তত সহজে কমানো যায় না। আন্তর্জাতিক বাজারে সারসহ কৃষি উপকরণের দাম না কমলে কৃষি ভর্তুকি কমানো সম্ভব হবে না। কারণ, এর সঙ্গে দেশের খাদ্য নিরাপত্তার বিষয়টি জড়িত। তবে বিদু্যতের কস্ট (ব্যয়) কমানোর জন্য সরকার চেষ্টা করছে।

এদিকে অর্থবিভাগের কর্মকর্তারা জানান, ২০১৪ সালের একতরফা নির্বাচনের আগের অর্থবছর থেকেই ব্যবসায়ীদের খুশি রাখতে নানা প্রণোদনা বাড়ানোর পাশাপাশি ভর্তুকি ও প্রণোদনা দেওয়ার মধ্য দিয়ে দেশে ভর্তুকিনির্ভর অর্থনীতি গড়ে তোলে আওয়ামী লীগের সরকার। ২০১৫ সালে বেতন-ভাতা দ্বিগুণ করার পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসহ সরকারি চাকরিজীবীদের জন্য বিভিন্ন ভাতার প্রচলন করে বেতন-ভাতা ও পেনশনের আকার বাড়ানো হয়েছে। এই সময়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসহ বিভিন্ন সংস্থার সদস্যদের ঝুঁকি ভাতাসহ বিভিন্ন নামে নতুন নতুন ভাতা চালু করা হয়েছে।

২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারির জাতীয় নির্বাচনের আগে সরকারি চাকরিজীবীদের ৫ শতাংশ ইনক্রিমেন্টের পাশাপাশি অতিরিক্ত ৫ শতাংশ ইনসেনটিভ চালু করে শেখ হাসিনা সরকার, যা এখনো বহাল আছে। বাড়তি পরিচালন ব্যয় মেটানোর পাশাপাশি দ্রম্নত উন্নয়ন দেখাতে গিয়ে ব্যাংক ও সঞ্চয়পত্র থেকে উচ্চ সুদে বিপুল পরিমাণ ঋণ নিয়েছে আওয়ামী লীগ সরকার, যার সুদ পরিশোধ করতেই চলতি বাজেটে ৯৩ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। আগামী অর্থবছর এটি প্রায় এক লাখ কোটি টাকায় পৌঁছাবে।

সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)-এর নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন আগের সরকারের নীতি নির্ধারণ প্রক্রিয়ার সমালোচনা করে বলেছিলেন, অর্থনৈতিক বাস্তবতা বিবেচনায় না নিয়ে বিভিন্ন প্রেসার গ্রম্নপের চাপে আগের সরকার নানা রকম ভর্তুকি, প্রণোদনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, যা পরিচালন ব্যয় বাড়িয়ে দিয়েছে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে