১. অন্তর্বর্তীকালীন সরকার কি বৈধ
সরকার? এর সাংবিধানিক ভিত্তি কী?
প্রথমত, বাংলাদেশের সংবিধান ১৯৭২-এর পর থেকে নানা ধরনের পরিবর্তের মধ্য দিয়ে গেছে। ১৯৭২-এ যে সংবিধান ছিল সেটা আসলে ২০২৪-এ নেই। সংবিধানের এই রেডিক্যাল পরিবর্তনের শুরু করেছিল শেখ মুজিবুর রহমান নিজেই। ৪র্থ সংশোধনীর মাধ্যমে। বাকশাল প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে।
২০১১-তে এসে সবচেয়ে ঝামেলাপূর্ণ বিষয়গুলো যোগ করা হয়েছে। যেমন- আর্টিকেল ৭(ক), ৭(খ)। এসব সংশোধনীগুলো করা হয়েছে মূলত সংবিধানের মাধ্যমে নিজেদের ক্ষমতাকে পাকাপোক্ত করার জন্য। এই সংবিধানের মাধ্যমে শেখ হাসিনা একজন স্বৈরশাসকের পরিণত হয়েছে। জুলাইয়ে ছাত্র-জনতার গণ-অভু্যত্থানের মাধ্যমে যার কবর রচিত হয়েছে।
নিশ্চিতভাবে গণ-অভু্যত্থান সাংবিধানিক কাঠামো মেনে কিংবা সাংবিধানিক নিয়ম-কানুন মেনে হয়নি। এটির বৈধতা মূলত- 'মানুষের ইচ্ছা' (চবড়ঢ়ষব'ং রিষষ)। শেখ হাসিনার স্বৈর শাসন মানুষ দেখতে চায়নি, এ জন্য জাতি-ধর্ম-বর্ণ-পেশা নির্বিশেষে সবাই মাঠে নেমে এসেছে। এটার মধ্যে দিয়েই মানুষের ইচ্ছা ও আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটেছে।
ঠিক তেমনি, গণ-অভু্যত্থান পরবর্তী সরকার গঠনে ও মানুষের ইচ্ছার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। কারণ, ডক্টর ইউনূসকে প্রধান উপদেষ্টা করে গঠিত সরকার নিয়ে সাধারণ মানুষকে প্রতিবাদ করতে দেখা যায়নি। তারমানে সবার ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটেছে। তাছাড়া, এই সরকার এখনো চাইলে গণভোটের মাধ্যমে তাদের বৈধতা যাচাই করতে পারে।
পুরো বিষয়টিকে জুরিসপ্রম্নডেনশিয়াল পার্সপেক্টিভ থেকে ব্যাখ্যা করতে গেলে আমরা ঐবহং কবষংবহ-এর ্তুচঁৎব :যবড়ৎু ড়ভ খধ্িথ পাই, যেখানে তিনি বলেছেন, একটা স্টেটে একটা এৎঁহফহড়ৎস থাকে যেটা সর্বোচ্চ আইন আর এর আন্ডারে কিছু হড়ৎস থাকে। আমরা যদি চবড়ঢ়ষবং্থ রিষষ কে এৎঁহফহড়ৎস ধরি তাহলে আমরা মানুষের ইচ্ছার বহিঃপ্রকাশের মাধ্যমে গঠিত সরকার বৈধতা দিতে পারি। অতএব, এই সরকারের বৈধতা হলো গণ-অভু্যত্থান বা 'পিপল'স উইল'।
দ্বিতীয়ত, ডক্ট্রিন অব নেসেসিটি-এর মাধ্যমে ইন্টেরিম গভর্মেন্টের বৈধতাকে জাস্টিফাই করা যায়। যখন একটা নির্দিষ্ট জায়গায় কোনো ভ্যাকুয়াম থাকে, সেটা পূরণ করার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়ার প্রয়োজন রয়েছে। শেখ হাসিনা পালিয়ে গেল, কিন্তু সেই পজিশনটা তো ফিলআপ করার প্রয়োজনীতা রয়েছে। এমন সিচুয়েশন সাধারণত বাংলাদেশে এর আগে ঘটেনি। খুব স্বাভাবিকভাবে বর্তমান সংবিধানে এই পরিস্থিতি মোকাবিলা করা কিংবা নতুন সরকারপ্রধান নিয়োগের নিয়ম-কানুন বলা হয়নি। সুতরাং, সংবিধানের বাইরে গিয়েই সরকার গঠন করাটাই যুক্তিযুক্ত ছিল।
২. সংবিধানের বাইরে গিয়ে সরকার গঠন করে সংবিধানের আলোকে রাষ্ট্র পরিচালনা?
আমরা ইতোমধ্যে বলেছি যে, এই সরকার বর্তমান সংবিধানের আলোকে গঠিত সরকার নয়। তাহলে এ সরকার কেন শাহাবুদ্দিন চুপ্পুর অধীনে শপথ নিল? সব আইন কেন এই সংবিধানের অধীনে অর্ডিন্যান্স আকারে বানানো হচ্ছে? এককথায়, সংবিধানের বাইরে গিয়ে সরকার গঠন করে সংবিধান মেনে রাষ্ট্রপরিচালনা করাটা প্যারাডক্সিক্যাল হয়ে যায়। কারণ, এই সংবিধান মানার জন্য তো আর এই গণ-অভু্যত্থান হয়নি। বিদ্যমান সংবিধানের কাঠামোকে চ্যালেঞ্জ করাই ছিল এই অভু্যত্থানের মূল লক্ষ্য। এক দফা ঘোষণার মূল বিষয়ও ছিল- 'ফ্যাসিবাদের পতন ও নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত'।
নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত বলতে বিদ্যমান কাঠামোকে উপড়ে ফেলে নতুন কাঠামোর প্রচলনকে বোঝানো হয়। এমতাবস্থায়, এ সরকার জটিলতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। শেখ মুজিবের ছবিকে সব মন্ত্রণালয়ে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছিল প্রচলিত সংবিধানের বিধান মেনে। সেই ছবি নামাতে এই সরকারের ৩ মাস লেগে গেছে। এতদিন ঝুলিয়ে রেখে এখন যে নামালো- এটার বৈধতা কী? নিশ্চয় বিদ্যমান সংবিধান নয়। তাহলে, এই সরকারের উচিত ছিল প্রথম দিন থেকেই শেখ মুজিবের ছবি নামিয়ে ফেলা। তাছাড়া, এ সরকারের উচিত ছিল একটি অন্তর্বর্তীকালীন সংবিধান প্রণয়ন করা।
অন্তর্বর্তীকালীন সংবিধান যে কোনো ফরমেটে হতে পারতো। যেমন- বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রকে ১ম সংবিধান হিসেবে বিবেচনা করা হয়। অর্থাৎ, ওই ঘোষণাপত্রে একটা সংবিধানের মৌলিক বৈশিষ্ট্যসমূহ (সরকারের বিভিন্ন বিভাগের কার্যাবলি) উলেস্নখ ছিল। এমনভাবে একটি ডকুমেন্ট প্রণয়ন করে সেটার ভিত্তিতে দেশ চলতে পারতো। সুতরাং, বর্তমান সরকারের এই সংবিধান মানার ক্ষেত্রে দ্বিমুখীতায় এই সরকারকে দূর্বল করে তুলছে। কিছু ক্ষেত্রে বিদ্যমান সংবিধান মানা হচ্ছে, কিছু ক্ষেত্রে মানা হচ্ছে না। হয় পুরোটা মানতে হবে, না হলে পুরোটা বাদ দিতে হবে। তবে, পুরোটা যদি মানা হয়, তাহলে জুলাই অভু্যত্থানের স্পিরিটের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হবে। সুতরাং, বর্তমান সংবিধানকে বাদ দিয়ে নতুন সংবিধান লিখতে হবে অথবা এটাকে সময়োপোযোগী সংস্কার করতে হবে- যাতে এটা জুলাই বিপস্নবকে এন্ডোর্স করে।
৩. সংবিধান পুনর্লিখন
নাকি সংশোধন?
বর্তমান সংবিধানকে সংশোধনের চেয়ে পুনর্লিখন করাটা জরুরি নিম্নোক্ত কয়েকটি কারণে।
আর্টিকেল ৭(ক): এই অনুচ্ছেদে সংবিধানের কোনো বিধান 'অসাংবিধানিক' উপায়ে পরিবর্তন, পরিবর্ধন ও পরিমার্জন করাকে রাষ্ট্রদ্রোহী অপরাধ হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। প্রথমত, একটা সংবিধানে কখনো এমন বিধান থাকতে পারে না। সংবিধান কোনো পেনাল ল' নয়। দ্বিতীয়ত, এই অন্তর্বর্তী সরকার যেহেতু সাংবিধানিক নয়, সেহেতু এই সরকার কোনো সংশোধন করতে পারবে না। যদি করে তাহলে সেটা রাষ্ট্রদ্রোহ অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে। তৃতীয়ত, এই অনুচ্ছেদকে কিন্তু সংশোধন করেও পরিবর্তন করা সম্ভব না, কারণ এটাও 'অসংশোধনীয় অনুচ্ছেদসমূহ ৭(খ)' এর অন্তর্ভুক্ত।
আর্টিকেল ৭(খ): পৃথিবীর বিভিন্ন সংবিধানে এমন 'এটার্নিটি ক্লজ' রয়েছে, যেখানে সংবিধানের কিছু মৌলিক বিধানাবলি সন্নিবেশিত থাকে- যা কখনো পরিবর্তন করা যায় না। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এগুলো সরকার বা রাষ্ট্রের ক্যারেক্টার সংক্রান্ত থাকে। কিন্তু, অদ্ভুতভাবে বাংলাদেশের সংবিধানে প্রস্তাবনা, ৫২টি অনুচ্ছেদ, ও মৌলিক বিধানসমূহকে অপরিবর্তনীয় হিসেবে এই ক্লজে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। সহজভাবে বললে বাংলাদেশের সংবিধানের অলমোস্ট এক-তৃতীয়াংশ অপরিবর্তনীয় হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। তারমানে এই সংবিধানের এক-তৃতীয়াংশ কখনোই পরিবর্তন করা যাবে না। এটি 'ঢ়ড়ঢ়ঁষধৎ ংড়াবৎবরমহঃু' ধারণার পরিপন্থি।
তাছাড়া, এভাবে পার্লামেন্টের সংবিধান সংশোধনের ক্ষমতাকে অনেকেই ্তুপড়হংঃরঃঁঃরড়হধষ যধহফপঁভভং্থ ও বলেছেন। তাছাড়া, কোন পার্লামেন্ট কি ভবিষ্যতের পার্লামেন্টের আইন প্রণয়ন কিংবা সংশোধনের ক্ষমতাকে খর্ব করতে পারে? অতএব, ৭(ক) এবং ৭(খ)-এর কারণে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার চাইলেও সংবিধানের কোনো সংবিধান সংশোধন করতে পারবে না। সুতরাং, সংশোধনের চেয়ে পুনর্লিখনই শ্রেয়।
আগামী পর্বে সমাপ্ত।
আবুজার গিফারী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের
আইনের শিক্ষার্থী এবং ইন্টারন্যাশনাল
ইনস্টিটিউট অব ল' অ্যান্ড
ডিপেস্নামেসি-এর রিসার্চ অফিসার।