'দ্য ভেজিটেরিয়ান' হান কাংয়ের মাস্টার পিস। ২০০৭ সালে উপন্যাসটি প্রকাশের পর সারা কোরিয়ায় আলোড়ন তুলেছিল।
দ্য ভেজিটেরিয়ান- নামটার কারণে মনে হতেই পারে নিরামিষ ভোজনের ওপর কোনো বই। কিন্তু এটা মূল গল্প নয়। উপন্যাসটির মূল বিষয় হলো বিচ্ছিন্নতা। আর এই বিচ্ছিন্নতার গভীরে যাওয়ার জন্য হ্যান কাং পাঠককে এমনভাবে ভাবনার জালে ঘিরে ধরেন- যা তার লেখক সত্তার শক্তিকেই স্পষ্ট করে।
বইটির মূল চরিত্র ইয়ংহাই। তিনি কোরীয় গৃহবধূ। আচমকাই নিরামিষভোজী হওয়ার সিদ্ধান্ত নেন আর তার এমন সিদ্ধান্ত পরিবারের জন্য অস্বস্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু বইটিতে দেখা যায়, তার এই সিদ্ধান্তের কারণ শুধু খাদ্যাভাসের পরিবর্তন ছিল না। বরং মানসিক ও শারীরিক স্বাধীনতার প্রতীক। তিনি নিজেকে আবিষ্কার করেন এক অচেনা মানুষ হিসেবে এবং তার জীবনযাত্রা হয়ে ওঠে অদ্ভুত। বিপর্যস্ত পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়, বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন চারপাশ থেকে।
একজন লেখক অনন্য হয়ে ওঠেন শুধু তার গল্প বা পটভভূমির কারণে নয়। বরং গল্পবলার ধরনে, আলাদা বৈশিষ্ট্যের কারণেও। হান কাংও সেই প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছেন তার লেখায়। তিনি তা সফলতার সঙ্গে ধরেও রেখেছেন।
প্রধান চরিত্র ইয়ংহাইয়ের নিরামিষভোজিতা সমাজের প্রচলিত রীতিনীতির বিরুদ্ধে এক ধরনের বিদ্রোহ হিসেবে উঠে আসে বইটিতে। ইয়ংহাইয়ের নিরামিষভোজিতা শুধু খাদ্যাভাসের বদলে যাওয়া নয়, বরং এর মধ্য দিয়ে ঘটনার নানা প্রেক্ষাপট এবং রূপান্তরের ঘটনাও ঘটে। দেখা যায়, এই বদল ইয়ংহাইয়ের মানসিক অবস্থার প্রতিফলন। ক্রমশ বেড়ে ওঠা জীবনযাপনের মধ্য দিয়ে অবচেতন মনে জমে থাকা বিভিন্ন মানসিক আঘাত, চাপ, পারিপার্শ্বিকতা তাকে এমন এক পরিস্থিতির দিকে ঠেলে দেয়- তিনি বিচ্ছিন্ন হতে থাকেন ক্রমাগত। তার লড়াই হয়ে ওঠে অনেকটাই অন্তর্দ্বন্দ্বমূলক।
ইয়ংহাইয়ের পরিবার উপন্যাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তার নিরামিষভোজিতার সিদ্ধান্ত স্বামীর সঙ্গে সম্পর্কের ভাঙনের সূচনা শুধু নয়, ইয়ংহাইয়ের বাবা-মা তার সিদ্ধান্তকে ব্যক্তিগত অপমান হিসেবেও দেখে। ইয়ংহাইয়ের বোনের সঙ্গেও তার সম্পর্ক ক্রমশ জটিল হয়ে উঠে, কারণ সে তার বোনের এই পরিবর্তনকে বোঝার চেষ্টা করলেও, এক সময় তা মেনে নিতে পারে না।
লক্ষ্য করার বিষয় হলো, হান কাংয়ের লেখনী কতটা শক্তিমান তার সাক্ষর বইটির পাতায় পাতায়। শৈল্পিকতা এবং গভীর চিন্তা তিনি ছড়িয়েছেন দক্ষ শিল্পীর হাতে। যেখানে উপন্যাসের মূল কাহিনীর সঙ্গে গভীর সংযোগ স্থাপিত হয় পাঠকের। পাঠক ভিন্ন অনুভূতির দিকে ধাবিত হতে থাকেন।
বইটি যখন ২০১৬ সালে 'দ্য ভেজিটেরিয়ান' ইংরেজিতে অনুবাদ হয় তখন এটি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আলোড়ন তুলেছিল। উপন্যাসটি বিশেষভাবে সমাদৃত হয়। ইংরেজিতে অনূদিত হওয়ার পর এটি ম্যান বুকার ইন্টারন্যাশনাল পুরস্কারও অর্জন করে। এই বইটি শুধু লেখকের বা প্রধান চরিত্র ইয়ংহাইয়ের নয়, বরং মানুষের অন্তর্নিহিত মানসিক ও শারীরিক সংগ্রামের প্রতিফলন।
একজন শক্তিমান লেখক তার লেখার মধ্য দিয়ে পাঠকের চিন্তার উদ্রেক ঘটান, পাঠক মুগ্ধ হয়ে পড়েন- যেখানে হান কাং কতটা সফল এই বইটি তার এক অনন্য উদ্াহরণ।