বৃহস্পতিবার, ০১ মে ২০২৫, ১৭ বৈশাখ ১৪৩২

লা মিজারেবল

ভিক্টর হুগো
  ৩১ জানুয়ারি ২০২৫, ০০:০০
লা মিজারেবল
লা মিজারেবল

বিশ্ব সাহিত্যের উপন্যাসের সেরা তালিকা নিজের মতো করে করতে চাওয়া হলে, আর সেই তালিকায় লা মিজারেবল থাকবে। নইলে তালিকাটি যেন অসম্পূর্ণই থেকে যায়!

লা মিজারেবল পৃথিবীর সেরা উপন্যাসগুলোর একটি- যেখানে উঠে এসেছে জাঁ ভালজাঁর বিষণ্ন দুঃখপীড়িত আর সংক্ষুব্ধ জীবনের কথা। একটা মানুষের জীবন কতটা দুঃখময় হতে পারে, দুর্ভাগ্য কীভাবে জীবনকে ঘিরে ধরে, বেদনায় করুণ হতে হতে শেষ হতে পারে- তার এক শক্তিমান সাবলীল প্রকাশ ঘটেছে লা মিজারেবল উপন্যাসে।

এই উপন্যাসে ভিক্টোর হুগো প্রতিটি পাতায় পাতায় দেখিয়েছেন তার লেখকসত্তার শক্তি। প্রতিভার এমন এক স্বাক্ষর তিনি রেখেছেন- যা শুধু সেই সময়টাতেই নয়, আজও স্মরণীয়। লা মিজারেবল প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল ১৮৬২ সালে। যেটি লিখিত হয়েছিল বিপস্নবের পটভূমিকে কেন্দ্র করে। উপন্যাসটির কাহিনী এগিয়ে যায় জাঁ ভালজাঁর জীবনকে ঘিরে।

জাঁ ভালজাঁ উপন্যাসে বর্ণিত সেই ব্যক্তি, যিনি ছোটবেলায় বাবা-মাকে হারিয়ে ফেলেন এবং বড় বোনের সংসারে আশ্রয় নিতে বাধ্য হন।

আর ভাগ্য এখানেও তার জন্য সুখের ছিল না। কেননা, সেই বোনের সংসারও ছিল অভাবে, আঘাতে জর্জরিত। সাত সন্তানকে নিয়ে তার বড় বোনের সংসারে সুখ তো দূরের কথা, ঠিকমতো খাবারও জোটানই কঠিন ছিল। ভালজাঁরে বয়স যখন ২৫ বছর তখন তার বোনের স্বামীও মারা যায়। আর তখন বোনের সংসার চালানোর দায়িত্ব নেয় ভালজাঁ নিজেই। বোনের বড় সংসারটি চালাতে ভালজাঁকে করতে হতো অবর্ণনীয় পরিশ্রম। কিন্তু এরই মধ্যে তার জীবনে নেমে এলো অভাবিত ঘটনা, যাকে বলা যায় দুর্ভাগ্যের এক চূড়ান্ত পরিস্থিতি। কেননা, এক শীতে কাজ না পেয়ে খুব বিপদে পড়ে গেল জাঁ ভালজাঁ, কারণ টাকা নেই। বোনের ছোট্ট শিশুর ক্ষুধার জ্বালা সে সইতে পারল না। শেষ পর্যন্ত সে বাধ্য হয়ে রুটি চুরি করল। কিন্তু এখানেও ভাগ্য তার বিপরীত। ধরা পড়ে গেল সে, অনেক বোঝাতে চাইল সবাইকে তার চুরির কারণ। শুনল না তার কথা কেউ। সমস্ত আকুতি উপেক্ষিত হলো। বিচারে তাকে পাঁচ বছরের কারাদন্ড দেওয়া হলো। বিচারের এই রায়ে সে বিস্মিত হলো- ক্ষুধার তাড়না সহ্য করতে না পেরে একটা রুটি চুরির এমন শাস্তি! সমাজের প্রতি বিতৃষ্ণ হয়ে উঠল ভালজাঁ। যে সমাজ, ক্ষুধার্তকে খাবার দিতে পারে না কিন্তু পেটের দায়ে চুরি করলে, তাকে নির্মম শাস্তি দিতে একটুও দেরি করে না, সেই সমাজের প্রতি তার দৃষ্টি ঘৃণায় ভরে উঠল। আর বিচারের সাজা মেনে নিতে না পেরে বারবার পালাতে লাগলো জাঁ ভালজাঁ। কিন্তু দুর্ভাগ্য যেন তার রক্তে মেশানো। প্রতিবারই ধরা পড়ে গেল। আর ধরা পড়ার সঙ্গে তার সাজার মেয়াদও বাড়তে লাগল।

শেষ পর্যন্ত পাঁচ বছরের সাজা খাটতে এসে সে বের হলো উনিশ বছরের সাজা খেটে! কিন্তু দেখা যায়, ৪৬ বছরের প্রৌঢ় ভালজাঁ জেল থেকে বের হয়ে স্বস্তি কিংবা শান্তি, কিছুই পেল না।

বলা দরকার, তখনকার ফরাসি সমাজে জেলখাটা কয়েদিদের ঘৃণা করা হতো। আর তা এতটাই যে, টাকার বিনিময়ে সামান্য খাবার জোগাড় করতে ব্যর্থ হয় জাঁ ভালজাঁ। যখন ভালজাঁ ক্রমাগত হতাশ হয়ে পড়ছিল, জীবনের এমন এক সময়ে দেখা পেল বিশপ মিরিয়েলের। যেন ভালজাঁর জীবনে আশার প্রদীপ হয়ে আসলেন বিশপ। আর বিশপের কাছ থেকে পাওয়া সাহায্য নিয়ে অলঙ্কারের ব্যবসা করে অল্প সময়ে ধনী হয়ে গেল জাঁ ভালজাঁ। কিন্তু দুর্ভাগ্য কখনো পিছু ছাড়েনি তার। এক মিথ্যা মামলায় আবারো আদালতে যেতে হয় জাঁ ভালজাঁকে। দেওয়া হয় যাবজ্জীবন কারাদন্ড। জাঁ ভালজাঁ কোনোক্রমেই এই সাজা আর মেনে নিতে পারেননি। আবারও জেল থেকে পলায়ন। এরপর পরিচয় আত্মগোপন করে কোজেত নামের এক এতিম মেয়েকে নিজের মেয়ে হিসেবে গ্রহণ করে নতুনভাবে জীবন শুরু করল। কোজেতকে পাওয়ার পর ভালজাঁর অনুভূতিতে ভিন্ন অনুরণণ তৈরি হয়। পৃথিবী তার কাছে যেন নতুন হয়ে ওঠে। কিন্তু স্বাভাবিকভাবেই সেই কোজেতও মারিয়াস নামক এক যুবককে বিয়ে করে অন্য ঘরে চলে যায়। মেয়ে দূরে চলে যাওয়ায় ভালজাঁ বেদনায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। এরপর মারিয়াসও জাঁ ভালজাঁকে ভুল বোঝে। তখন সে পুরোপুরি ভেঙে পড়ল। জীবন সায়াহ্নে কোজেত আর মারিয়াসকে দেখার তৃষ্ণায় মৃতু্যর প্রহর গুণতে শুরু করল।

সত্যিকার অর্থেই পুরো উপন্যাসের পাতায় পাতায় এমনসব দৃশ্যর অবতারণা করেছেন ভিক্টর হুগো- যেখানে মুগ্ধতা, সামাজিক বাস্তবতা, বৈষম্য আর জীবনের নানা দোলাচল পাঠককে আকৃষ্ট করে রাখে। পাঠকের হৃদয়ও বেদনায় কাতর হয়ে পড়ে। এই উপন্যাসে শুধু জাঁ ভালজাঁর গল্প নয়, আরও অনেক অসাধারণ চরিত্রের আবির্ভাব হয়েছে। আর পুরো উপন্যাস পাঠে, এটা যেন আপনা আপনি বোধগম্য হয়ে ওঠে- কেন এই উপন্যাস সারা বিশ্বে এত বেশি পঠিত এবং সমাদৃত! উপন্যাস শেষ করার পর এই প্রশ্নের উত্তরও যেন এমনি জানা হয়ে যায়- কেন বিশ্ব সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ উপন্যাসের তালিকায়, লা মিজারেবল!

\হ-নীল অরণ্য

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে