বছরের বারো মাসজুড়ে আবিদ হাসানের বাসায় তার গ্রামের বাড়ির কেউ না কেউ আসতেই থাকে। এই দলে আত্মীয়স্বজনরাও বাদ যায় না। দেখা গেল কারো চোখে সমস্যা, ডাক্তার দেখাতে হবে ঢাকায়। হোটেলে না উঠে তারা চলে আসে আবিদ হাসানের বাসায়। এই নিয়ে তার কোনো অভিযোগ নেই। বিপদে পড়েই তো এখানে আসে। তামান্নারও এই নিয়ে কোনো মাথাব্যথা নেই স্বামীর মতো। স্বামীর স্বল্প আয়ে সংসারকে কোনোরকম জোড়াতালি দিয়ে টিকিয়ে রাখার দৈনন্দিন যুদ্ধ তো আছেই, তার ওপর এসব মানুষের আগমন। অন্য কেউ হলে হয়ত এই নিয়ে বিবাদে জড়াতো। তামান্না এসব থেকে নিজেকে সুরক্ষিত রেখেছে অনায়াসে।
গত কয়েকমাস ধরে আবিদ হাসানের বোনরা এই বাসায় আসা-যাওয়া করছে। সম্পত্তি ভাগাভাগি নিয়ে এক সময় এই বোনরা আবিদ হাসানের সঙ্গে ঝামেলা করেছে। তামান্নাকে সহ্য হতো না তাদের। রিনা আর সুরমা অকারণে দোষ খুঁজত ভাবি তামান্নার। এই দুই ননদের কম জ্বালাতন সহ্য করেনি সে। পান থেকে চুন খসলেই রিনা ও সুরমা ছাড় দিত না তামান্নাকে।
পৈত্রিক সম্পত্তি নিয়ে ভাইবোনের সমস্যা এতটাই জটিল হয় যে, আবিদ হাসান এক সময় তামান্নাকে নিয়ে ঢাকায় চলে আসেন। সেসব দিনের স্মৃতি স্মরণ করাটা এখন তিনি বাদ দিয়ে দিয়েছেন।
এক সময় পরিস্থিতি অবশ্য স্বাভাবিক হয়। ভাইবোনের ফাটল ধরা সম্পর্কে একটু একটু জোড়া লাগে। যোগাযোগ বাড়ে ফোনকলে। একে অন্যের খবর নিতেও বেশ উদার মনোভাব দেখায়। বোনদের সঙ্গে স্বামীর মধুর সম্পর্কের পুনরাবৃত্তি দেখে তামান্না খুশি হয়। রিনা ও সুরমাকে ঢাকার বাসায় বেড়াতে আসবার আবেদন জানায়। তারাও মাঝেমধ্যে এখানে আসে।
২.
আজ সোমবার। সুরমা শুক্রবারে ভাইয়ের বাসায় এসেছে। ননদকে সমাদরে কোনো ত্রম্নটি রাখেনি তামান্না। তবে, এখন যেহেতু তার লেখালেখির ব্যস্ততা বেশি, তাই সে দিনের বেশিরভাগ সময় কাগজে-কলমে মিশে থাকে। যতটুকু অবসর হয়, ততটুকু সময় লেখালেখিতে বরাদ্দ রাখে। কিন্তু সুরমা, ভাবির এই কর্মকান্ড হজম করতে পারে না। তার ধারণা তাকে মূল্যায়ন করা হচ্ছে না ঠিকমতো। ভাবি চাচ্ছে না সে এখানে আসুক। তা না হলে লেখালেখির নাম করে নিজেকে এভাবে আলাদা করে রাখবে কেন!
বিষণ্ন মনে সুরমা রাতে ভাইয়ের কাছে নিরালায় বসে নালিশ দেয়, 'ভাবি সারাদিন এত লিখে কেন? আমি কি কিছু বুঝি না?' আবিদ হাসান জানতে চান, 'কি বুঝিস?' সুরমার অভিযোগমাখা কণ্ঠ, 'লেখার ছলে নিজেকে দূরে রাখে আমার থেকে। যাতে আমি চলে যাই, আমরা কি সব সময় এখানে আসি?'
আবিদ হাসানের মেজাজ খারাপ হয়। এই বোনরা যে জীবনভর তামান্নার বিপক্ষে অবস্থান করেছে, তিনি ভুলেননি সেসব। সম্পর্কের মরা পথ তাজা করে আবার এখানে এসে পুরনো দিনের মতো ভিত্তিহীন বিবাদের সূত্রপাত খুঁজছে। সুরমা বলে, 'আমি কালকেই চলে যাব। আসব না আর এখানে।' রাগে গা ফোঁসফোঁস করা আবিদ হাসান ছাড়েন না। উত্তেজিত হয়ে বলেন, 'অযথা সমস্যা তৈরি করিস না। তামান্নার এখন ব্যস্ত সময়। বইমেলায় ওর অনেক বই বের হবে। সেদিকে সময় দিতে হয়। তোদের অযত্ন কখন করল?' সুরমা জবাব দেয়, 'বই লিখতে হবে কেন?' আবিদ হাসান বলেন, 'পয়সার জন্য। যখন অভাবে ছিলাম আমরা, তোরা কয়দিন খবর নিয়েছিস? টাকা দিয়ে সহায়তা করিসনি কেউ। তামান্নার বই প্রচুর চলে বইমেলায়। অনেক পাঠক আছে ওর। প্রকাশক মেলা শেষে আমাদের যে পয়সা দেয়, সেটা দিয়ে আমাদের সংসারের অভাব দূর হয়।'
সুরমা ভাইয়ের কথায় চুপ হয়ে যায়। ঠিক সে সময় তামান্না এসে বলে, 'তুমি কী খাবে সুরমা? চা না কফি?' সুরমা কোনো কথা বলে না।