প্রাচীনকাল হতে বিবাহ সমাজের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হিসেবে প্রতিষ্ঠা রূপ লাভ করেছে। অবশ্য সামাজিক বিবর্তন প্রক্রিয়ার পরিবর্তন হয়েছে এবং ধারা অব্যাহত গতিতে এগিয়ে চলছে। দু'টি মানুষ নতুন সুখের সন্ধানেই বিবাহ নামক নতুন জীবনে প্রবেশ করে, কিন্তু যখন এ জীবন আর তাদের সুখ দিতে পারে না তখনই ঘটে বিবাহবিচ্ছেদ। পরিসংখ্যান বু্যরোর (বিবিএস)-এর 'বাংলাদেশ স্যাম্পল ভাইটাল স্ট্যাটিসটিকস' শিরোনামের প্রতিবেদনে ওঠে এসেছে, দেশে গত ১৭ বছর ধরেই তালাকের হার ঊর্ধ্বমুখী। বিবাহবিচ্ছেদ বেশি ঘটছে শিক্ষিত দম্পতিদের মধ্যে। বিবাহবিচ্ছেদ অবশ্যই একটি গুরুতর সমস্যা। তবে এটির চেয়েও বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়াচ্ছে বিচ্ছেদকৃত পরিবারের বিচ্ছিন্ন সন্তানগুলোর অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ। বাবা-মায়ের বিচ্ছেদের কারণে সন্তানের জীবনের গতিধারায় অনেক পরিবর্তন আসে। শিশুদের ওপর বিবাহবিচ্ছেদের প্রভাব অত্যন্ত প্রকট। বাবা-মায়ের মধ্যে বিবাহবিচ্ছেদের কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় শিশুরা। ফলে স্বামী-স্ত্রী আলাদা হলে সন্তানরা কার নিকট থাকবে, সেখানকার পরিবেশ তাদের জন্যে কতটা উপযুক্ত, আত্মীয়স্বজনের নিকট থাকলে তারা কীভাবে দেখবে এসব বিষয় শিশুদের মনে মারাত্মকভাবে প্রভাব ফেলে। এর মধ্যে রয়েছে খাদ্যাভ্যাস, আচরণ ও পরীক্ষার ফলাফলের ক্ষেত্রে পরিবর্তন। অন্যান্য মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যার আশঙ্কাও আছে। অনেক ক্ষেত্রে দেখা গেছে, বিচ্ছেদের পর সন্তানের অভিভাবকত্ব মাকে দেওয়া হলে মায়ের নতুন সংসারে আগের সন্তানটি হয়ে যায় বোঝা, এমনকি মেয়ে শিশুর ক্ষেত্রে সৎ বাবার দ্বারা যৌন হয়রানির শিকার হয়েছে এমন ঘটনাও এখন অহরহ। আর অভিভাবকত্ব বাবাকে দেওয়া হলে বাবা নতুন বিয়ে করলে সন্তান হয়ে যায় নতুন সংসারের পুরনো আসবাবপত্র। এছাড়া বাবা-মায়ের বিচ্ছেদের ফলে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের কথা ভেবে তারা কোনো কিছুতে মনোনিবেশ করতে পারে না। ফলে শিক্ষাজীবনেও মারাত্মক ক্ষতি হয় বাবা-মার বিচ্ছেদের কারণে। বাবা-মায়ের বিচ্ছেদের ফলে যখন এ সামাজিক প্রতিষ্ঠানটি ভেঙে যায় তখন চরম বিপাকে পড়ে সন্তানেরা। যার স্পষ্ট প্রভাব লক্ষ্য করা যায় সন্তানদের জীবনে। বিচ্ছেদের ফলে ভঙ্গুর পরিবারের সন্তানরা মানসিকভাবে চাপে থাকে। তাই তারা পরিবর্তন মানতে পারে না। ভঙ্গুর পরিবারের সন্তানেরা বার বার পরিবর্তিত পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়। তাই পরিবর্তনের প্রতি তাদের এক ধরনের অনীহা সৃষ্টি হয়। নতুন পরিবার, নতুন বাসা, স্কুল, বন্ধু ও পারিপার্শ্বিকতা তাদের নিকট এক ধরনের অনীহার বিষয়ে পরিণত হয়। তাছাড়া বিবাহবিচ্ছেদের নানারকম আবেগীয় সম্পর্কের পরিসমাপ্তি ঘটে এবং নতুন বাস্তবতার জন্ম দেয়। এর ফলে মানুষের মধ্যে অনুভূতি, রাগ, ক্ষোভ, উৎকণ্ঠা এবং অন্যান্য মানবীয় গুণাবলির ক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। এ পরিবেশে বসবাসরত শিশুরা তাদের আবেগ, ভালোবাসা বা রাগ, ক্ষোভ প্রকাশ করতে পারে না। যেসব পরিবারে বাবা-মায়ের মধ্যে সুসম্পর্ক থাকে না সেসব পরিবারের সন্তানেরা একটি অসহায় অবস্থার মধ্য দিয়ে দিনাতিপাত করে। তারা সবসময় ভাবতে থাকে আমাদের পরিবারে কেন বিবাহবিচ্ছেদ হবে। তারা কারণ অনুসন্ধান করে এবং আশঙ্কা করে বাবা-মা আলাদা হলে তাদের কী হবে প্রভৃতি বিষয় নিয়ে এক ধরনের অস্বস্তি কাজ করে। এ বিষয়গুলো এক পর্যায়ে বাচ্চাদের মধ্যে পতিত হয়। এমনকি তারা এর ফলে বিপথে পরিচালিত হতে পারে। বাবা-মায়ের বিবাহবিচ্ছেদের কারণে বাচ্চারা একটি খারাপ সময়ের মধ্য দিয়ে জীবনযাপন করে। ফলে তাদের আচরণের ক্ষেত্রে পরিবর্তন দেখা দেয়। এমনকি অনেক খারাপ আচরণ বা অপরাধের পথে ধাবিত হয়। আচরণগত বিপর্যয় তাদের ভুল পথে পরিচালিত হওয়ার ইঙ্গিত বহন করে- যা কোনো পরিবার বা সমাজের জন্য অশনিসংকেত। এছাড়া পরিবারের বিবাহবিচ্ছেদের ফলে সন্তানদের মানসিক স্বাস্থ্যের পাশাপাশি শারীরিক স্বাস্থ্যেরও ক্ষতি হয়ে থাকে। এ ধরনের ক্ষতি তাদের পরবর্তী জীবনে কাটিয়ে উঠতে অনেক বেগ পেতে হয়। এমনকি অনেক বাচ্চা যাদের আবেগীয় অনুভূতি প্রবল তারা এ ক্ষতি বা প্রভাব আদৌ কাটিয়ে উঠতে পারে না। ফলে তারা এক অপূরণীয় ক্ষতির সম্মুখীন হয়। বাংলাদেশে বিবাহবিচ্ছেদকে এখনো সমাজের অনেকেই নিন্দনীয় মনে করে। তাই মা-বাবার বিচ্ছেদ হলে শিশুরা একটা অতিরিক্ত মানসিক চাপের মধ্যে থাকে। অনেকে সমাজ, প্রতিবেশীদের কাছে ও বিদ্যালয়ে বুলিংয়ের শিকার হয় এবং প্রতিবেশী ও আত্মীয়দের কটু মন্তব্য শোনে। এই বৈষম্যমূলক সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন প্রয়োজন। তাই বাবা-মায়ের উচিত সন্তানের সুন্দর ভবিষ্যতের কথা ভেবে হলেও নিজেদের বোঝাপড়ার মাধ্যমে পরবর্তী পদক্ষেপ ঠিক করে নেওয়া। কারণ আপনার সন্তান বড় হয়ে উঠবে আপনার পরিচয়েই। বিবাহবিচ্ছেদ একটি সুন্দর পরিবারকে সবচেয়ে কুৎসিত রূপদান করে। তাই এটি কোনোভাবেই কাম্য হতে পারে না। বিবাহবিচ্ছেদের ফলে অবুঝ শিশুগুলোর ভবিষ্যতে যেন আঁধার নেমে না আসে সে ব্যবস্থা করতে হবে এবং বিবাহবিচ্ছেদ যাতে না ঘটে সেজন্য সবাইকে থাকতে হবে। এজন্য সরকারকে সচেতনা বৃদ্ধির পাশাপাশি আইনের যথাযথ বাস্তবায়ন করতে হবে।