একবিংশ শতাব্দীতে এসে বাংলাদেশও পৃথিবীর অন্যান্য দেশের সঙ্গে নারী ক্ষমতায়ন এবং নারী অধিকার নিয়ে বেশ সজাগ হয়ে উঠেছে। সরকারের ব্যাপক উৎসাহের ফলে নারীরা এখন প্রায় সব জায়গায় অবদান রাখতে সক্ষম হচ্ছে। পুরুষের সঙ্গে তাল মিলিয়ে তারা বাইরের জগতে কাজ করছে। কিন্তু তাদের মুখোমুখি হতে হচ্ছে নানা প্রতিবন্ধকতার। বিশেষ করে তৃণমূল পর্যায়ে নারী ভয়ংকর নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে। রাস্তা থেকে শুরু করে কর্মস্থল পর্যন্ত তাদের বেশ কয়েকটি সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। বিভিন্ন জায়গায় এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ে অবধি নারীরা লাঞ্ছিত হচ্ছে। যানবাহনে ভিড়ের মধ্যে নারীর সঙ্গে অসদাচরণ করা এ উপমহাদেশে খুবই পরিচিত একটা বিষয়। কিন্তু পরিতাপের বিষয় এই যে, দেশ ক্রমে উন্নতি করলেও দেশের জনগণের চিন্তাধারার কোনো উন্নয়ন এখনো হয়নি। এ ক্ষেত্রে জাতীয় পর্যায়ে বিভিন্ন আন্দোলন, সেমিনার, আলোচনা সভার আয়োজন করা হলেও আসলে ফলাফল আসছে শূন্য। কারণ যেসব পরিকল্পনা গৃহীত হচ্ছে তার কোনোটাই বাস্তবায়ন করা হচ্ছে না। ফলশ্রম্নতিতে নারী নির্যাতনের ঘটনা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এক্ষেত্রে বাদ যাচ্ছে না শিশুরাও। ২০১৮ সালের পর থেকে বাচ্চা শিশুদের ওপর নির্যাতন ও ধর্ষণের মাত্রা বাড়তে দেখা যাচ্ছে।
বছরখানেক আগে, নাটোরের সিংড়া উপজেলায় চাচা কর্তৃক ভাতিজি ধর্ষিত হয়। এর থেকে বোঝা যাচ্ছে যে, নারী নিজ পরিবারেও নিরাপদ নয়। বর্তমানে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, এমনকি দেশের শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপীঠগুলোতেও নারী শিক্ষার্থী যৌন নিপীড়নের শিকার হচ্ছে। পরিতাপের বিষয় হলো যে, এসব কাজে লিপ্ত হতে দেখা যায় শিক্ষকদেরও। প্রায় সময়ই বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে নারী নির্যাতনের ঘটনা শোনা যায় তাদের নিয়ে।
সম্প্রতি ব্র্যাক কর্তৃক প্রকাশিত 'নারীর যৌন হয়রানি ও দুর্ঘটনামুক্ত সড়ক' শীর্ষক গবেষণায় দেখা গেছে, ৯৪ শতাংশ নারী গণপরিবহণে শারীরিক বা অন্য কোনোভাবে যৌন হয়রানির শিকার হচ্ছে। বেশিরভাগ সময় এসব যৌন নিপীড়নকারীর বয়স ৪১ থেকে ৬০ বছরের মধ্যে হয়ে থাকে। এতে সম্মানহানির ভয়ে বা অন্য কোনো কারণে নারীরা চুপ থাকে। এজন্য সব ঘটনা সামনেও আসে না। নগরে রাতের বেলায় নারী নির্যাতনের প্রবণতা বেশি দেখা যায়। বিশেষ করে ফাঁকা বাস বা লেগুনায় নারীরা প্রায়ই ছিনতাই এবং গণধর্ষণের শিকার হয়। এমনকি কর্মস্থলেও তারা নানাভাবে বিকৃত শ্রেণির মানুষের দ্বারা নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে। নারীদের জন্য আলাদা কোনো পরিবহণের ব্যবস্থা না থাকায় প্রতিনিয়ত সমস্যার সম্মুখীন হতে হচ্ছে তাদের।
এসব ঘটনা প্রায় সময়ই ধামাচাপা পড়ে যায়। অনেকে সম্মান বাঁচাতে চেপে যান আবার অনেককে জোর করে চুপ করিয়ে দেওয়া হয়। যেসব ঘটনা সামনে আসে, সেগুলোর সঠিক তদন্ত বা বিচারের অভাবে দোষীদের শাস্তি হয় না। অনেক সময় বিচার প্রক্রিয়া অনেক দীর্ঘ হওয়ার কারণে অনেক ভুক্তভোগী পরিবার বিচার ব্যয় নির্বাহ করতে না পেরে হাল ছেড়ে দেয়। শেষ অবধি দেখা যায়, হাজারখানেক ধর্ষকদের মধ্যে শাস্তি পায় গুটিকয়েক। বাকিরা গায়ে হাওয়া লাগিয়ে ঘোরে আর নতুন অপরাধ সংঘটিত করে।
অনেক সময় পুলিশ প্রশাসন 'সাক্ষী গোপালের' ভূমিকায় থাকে। ফলে, তৃণমূল পর্যায়ের মানুষের বিচার পাওয়ার আর কোনো আশাও থাকে না। সম্প্র্রতি পাবনার বেড়ায় অপহরণের এক মাস ২৩ দিন পার হয়ে গেলেও কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি এসএসসি পরিক্ষার্থী রূপন্তী সাহাকে। তার পরিবারের ধারণা, আশ্বাস দিলেও পুলিশ তাদের কোনো সাহায্যই করছে না। শোকসন্তপ্ত রূপন্তীর বাবা বলেন, 'মেয়েটাকে মেরে ফেলেছে কিনা জানি না।'
যে দেশে জনসংখ্যার অর্ধেকের বেশি নারী, সেখানে নারীর প্রতি এমন আচরণ খুবই দুঃখজনক। এ বিষয় নিয়ে মিছিল মিটিং করার মাধ্যমে জনগণের সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। প্রতিনিয়ত সেমিনার সিম্পোজিয়ামের আয়োজন করতে হবে। পরিবহণে নারীর জন্য সংরক্ষিত সিট ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। অতিরিক্ত যাত্রী ওঠানো থেকে বাস মালিকদের নিরুৎসাহিত করতে হবে। পাশাপাশি প্রশাসনের ভূমিকাও এক্ষেত্রে অপরিহার্য। প্রশাসন জোরালো পদক্ষেপ না রাখলে সমস্যা আরও জটিল হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। সর্বক্ষেত্রে মেয়েরা সম্মানের সঙ্গে পদচারণা করুক- এই আমাদের কাম্য।