বৃহস্পতিবার, ০১ মে ২০২৫, ১৮ বৈশাখ ১৪৩২

অধ্যবসায়ীদের অনুপ্রেরণার নাম মাদাম কুরী

কায়ছার আলী
  ১০ ডিসেম্বর ২০২৪, ০০:০০
অধ্যবসায়ীদের অনুপ্রেরণার নাম মাদাম কুরী
অধ্যবসায়ীদের অনুপ্রেরণার নাম মাদাম কুরী

সীমাহীন ব্যর্থতা, দরিদ্র্যতা এবং হতাশার অতল গহব্বরে নিমজ্জিত থেকে বিশ্বসেরা হয়ে সফলতার স্বর্ণোজ্জ্বল ইতিহাস গড়ে নিজের নাম অনেকর মতো কর্মের মাধ্যমে স্বর্ণাক্ষরে লিপিবদ্ধ করেছেন। তিনি হলেন- জীবন সংগ্রামে জয়ী, বিশ্বশান্তি ও নৈতিকতার অগ্রদূত মহীয়সী বিজ্ঞানী মাদাম কুরী। ১৮৬৭ সালের ৭ নভেম্বর পোল্যান্ডের ওয়ারশতে এক হতদরিদ্র কৃষক পরিবারে তার জন্ম। চার বোনের মধ্যে ছোট্ট মেরী শৈশবেই মাকে হারান এবং তাদের বাবা স্বাধীনতা আন্দোলনে সহায়তা করার জন্য স্কুলে চাকরিচু্যত হন। সে সময় তিনি স্কুলের সেরাছাত্রী হওয়ায় এবং শেষ পরীক্ষায় অসাধারণ কৃতিত্বের জন্য স্বর্ণপদক পান। অত্যধিক পড়াশোনার চাপ, সাধনা আর সংগ্রাম ছিল তার নিত্য ছায়াসঙ্গী। দারিদ্রের কষাঘাতে জর্জরিত তিনি ক্ষুধার জ্বালায় প্রায়ই বেহুশ হয়ে পড়তেন। মাত্র ১৯ বছর বয়সে তিনি গৃহশিক্ষিকা থাকাকালীন ধনী পরিবারের এক ছেলে তার আচার-আচরণে স্বভাব চরিত্রে মুগ্ধ হয়ে প্রণয় থেকে পরিণয়ের প্রস্তাব দিলে গৃহকর্তীর অসহ্য তিরস্কারে তিনি দিশেহারা হয়ে জীবনের লক্ষ্য বদলে ফেলেন। প্যারিসে পাড়ি দিয়ে দরিদ্রতাকে মহান ভেবে বিজ্ঞানে লেখাপড়া এবং গবেষণার মাত্রায় নিজেকে পুরোপুরি নিয়োজিত করেন। রান্না-বান্নার কাজে সময় অপচয় হবে ভেবে যৎসামান্য খেতেন। এর ফলে, তার মাথা ঘুরতো এবং বিছানায় বেহুশ হয়ে পড়ে থাকতে হতো। মাঝে মাঝে ক্লাসে তিনি সংজ্ঞা হারিয়ে ফেলতেন। বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে বেশি সময় তিনি অপচয় করতেন না। কেননা, তিনি জানতেন সময় জীবনে অত্যন্ত মূল্যবান। বোর্ডিং এ চতুর্থ তলায় যে কক্ষে তিনি থাকতেন সেখানে পর্যাপ্ত আলো, শীতের দিনে কক্ষ গরম করার কেনো ব্যবস্থাই ছিল না। ঠান্ডায় আঙুলগুলো বরফের মতো জমে যেত, ঠক ঠক করে হাত পাগুলো কাঁপতো; কিন্তু এসব তিনি মোটেই আমলে নিতেন না। মোট কথা শীত নিবারণ আর শরীর গরম রাখার জন্য রাতে শরীরের ওপর পুস্তকের স্তূপ চাপিয়ে দিতেন। লেখাপড়া নিয়ে তন্ময় থাকায় ক্ষুধার কথা তিনি ভুলে যেতেন। কেননা, তার পেটের ক্ষুধার চেয়েও মনের অদম্য ক্ষুধা ও ভিতরের দাহ জ্বালা ঠান্ডা হওয়ার ছিল না। পদার্থ বিদ্যার পর অংকেও তিনি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উচ্চশিক্ষায় প্রথম হন। অধ্যাপক পিয়েরে কুরীর বিজ্ঞানের প্রতি ছিল তার জীবনের প্রবল আকর্ষণ। পারস্পরিক কথাবার্তা বিনিময়ের পর তারা বন্ধুত্ব থেকে বিয়ে বন্ধনে আবদ্ধ হন। স্বামীর ল্যাবরেটরিতে দিনে বেশিরভাগ সময় কাটাত মেরী। বিয়ের সময় তাদের সম্পদ বলতে দুটি সাইকেল ছাড়া আর কিছুই ছিল না। সাইকেল দুটিতে চড়ে তারা দুজনে হানিমুন করতে ফ্রান্সের পাড়া গাঁয়ে বেরিয়ে পড়তেন, সামান্য পরিমাণে খাদ্যদ্রব্য নিয়ে। ১৮৯৭ সালে তাদের প্রথম সন্তান আইরিনের জন্ম হয়। সন্তান জন্মের কিছুদিন পর ১৮৯৮ থেকে ১৯০২ এই ৪৫ মাস তারা দুজনেই দিনমজুরের মতো অমানসিক পরিশ্রম করেছেন। ১৯০৩ সালে পদার্থ বিজ্ঞানে 'পোলোনিয়াম' আবিষ্কারের জন্য তারা যৌথভাবে নোবেল পুরস্কার পান। বিদেশে থেকেও নিজের জন্মভূমির প্রতি মেরীর ছিল অকৃত্রিম ভালোবাসা। তাই নিজের দেশ পোল্যান্ডের নাম অনুসারে দ্রব্যটির নাম রাখেন 'পোলোনিয়াম'। নোবেল পুরস্কারের অর্থ দিয়ে গবেষণা চলাকালীন ঋণ পরিশোধ এবং বাকি অর্থ গবেষণার জন্য ব্যয় করেন। দ্বিতীয় কন্যা ইভ-এর জন্মের পর ১৯০৪ সালে বৃষ্টিভেজা পথে পিছলে পড়ে মালবাহী গাড়ির ধাক্কায় রক্তাক্ত হয়ে মারা যান পিয়েরে কুরী। স্বামীর মৃতু্যর পর শোককে শক্তিতে পরিণত করে আবার গবেষণার মনোনিবেশ করলেন মেরী কুরী। প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম মহিলা অধ্যাপক ড. মেরী কুরী। ১৯১১ সালে 'রেডিয়াম' আবিষ্কারের জন্য তিনি রসায়নে নোবেল পুরস্কার পেলেন। পৃথিবীর ইতিহাসে তিনিই একমাত্র ব্যক্তি যিনি দুইবার নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন এবং তাদের পরিবারেই একমাত্র মেয়ে জামাইসহ তারা ৫ বার নোবেল পুরস্কার পান। তাদের পরিবারের প্রতি পৃথিবীবাসীর ঋণের শেষ নেই। মাদাম কুরী শুধু একজন সফল বিজ্ঞানীই ছিলেন না, একাধারে ছিলেন নিবেদিত স্ত্রী, একজন দায়িত্বশীল মা এবং একজন মানবদরদি। পিয়েরে কুরীর সাহচর্যে যে তেজস্ক্রিয় ভালোবাসার সূচনা হয়েছিল তার সমাপ্তি ঘটে পিয়েরে কুরীর মৃতু্যর মধ্য দিয়ে। মাদাম কুরী প্রথা ভেঙে বিশ্বজয় করেছিলেন। কেননা, তখন মেয়েদের পোল্যান্ডের ওয়ারশ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার কোনো সুযোগ ছিল না। মানবজাতির জন্য তিনি নিজের জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। তেজস্ক্রিয় মৌল রেডিয়াম আবিষ্কার এবং মানবদেহের ওপর এর প্রভাব নিয়ে গবেষণা করায় তার শেষ পরিণতি হয় করুণ যন্ত্রণাদায়ক মরণব্যাধিতে অসহ্য মৃতু্য। তিনি নিজে অসহনীয় ব্যথা সহ্য করে মানুষকে ব্যথামুক্ত জীবন দান করেছেন। ক্যানসার চিকিৎসায় রেডিয়াম সবচেয়ে ফলপ্রদ প্রতিষেধক। সারাজীবন বন্ধুর পথ পাড়ি দিয়েছেন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানী মাদাম কুরী। অসাধারণ এবং মহামানবদের মতো বিস্ময়কর আবিষ্কারকে লাভজনক ব্যবসায় পরিণত না করে মানবসেবাকে উৎসর্গ করে গবেষণাগায় দেশে-বিদেশে তৈরি করে তা ব্যয় করেছেন। তারই আবিষ্কৃত সন্তানতুল্য 'রেডিয়াম' তাকে চিরদিনের জন্য ১৯৩৪ সালের ৪ জুলাই তার জীবনদ্বীপ নির্বাপিত করে। তার ব্যবহৃত সবকিছুই ছিল অত্যন্ত তেজস্ক্রিয়। তার মৃতু্যর পর তার দেহ থেকে যেন তেজস্ক্রিয়তা ছড়াতে না পারে সে জন্য তার কফিনটি এক ইঞ্চি সিসা দিয়ে আবৃত করে দেওয়া হয়।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে