আমাদের সৌরজগতের বাইরে খুঁজে পাওয়া গ্রহের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে ক্রমেই। তার কোনোটিতে প্রাণের সম্ভাবনা আছে কি না তা জানতে সাহায্য করবে এ ধরনের গবেষণা। প্রাণের সম্ভাবনা আছে এমন গ্রহও মিল্কিওয়েতে বেড়ে চলেছে। বিশেষ করে কেপলার টেলিস্কোপের কল্যাণে তা সম্ভব হয়েছে। কেপলার টেলিস্কোপ উজ্জ্বল সব নক্ষত্রের আলোয় বাধা সৃষ্টি করা গ্রহের চিহ্ন খুঁজে বের করে।
বিজ্ঞানীদের হিসাব অনুযায়ী প্রতি পাঁচটি সূর্যের মতো তারকার একটিতে পৃথিবীর মতো একটি গ্রহ থাকতে পারে। এটিকে থাকতে হবে 'গোল্ডিলক জোন' নামের একটি অঞ্চলে। তারকা থেকে ঠিক এমন দূরত্বে যা যথেষ্ট উষ্ণ যে পানি বরফে রূপান্তরিত হয় না, আবার এতই শীতল যে পানি বাষ্প হয়ে উবে যায় না। এমন অবস্থানে থাকা গ্রহের মাঝে এখন বিজ্ঞানীরা খুঁজছেন পানির উপস্থিতি এবং প্রাণের সম্ভাবনা। এ কারণে তাদের তৈরি সিমুলেশনগুলোয় বিশেষ করে তার পরিবেশ ও আবহাওয়ার ওপরে গুরুত্ব দেওয়া হয়। এ কারণেই সৃষ্টি করা হয় সমুদ্র আছে এমন একটি গ্রহের সিমুলেশন। এখানে মূলত দেখা হয়, গ্রহের ঘূর্ণনগতির পরিবর্তন করা হলে তাপপ্রবাহের ওপর সমুদ্র কী ভূমিকা রাখবে।
সমুদ্রের মতো বিশাল জলাশয় থাকলে সেসব গ্রহের আবহাওয়া অনেকটা সহনীয় হয়ে ওঠে। সৌর তেজস্ক্রিয়তা বা মৌসুমি তাপমাত্রা পরিবর্তনের মাত্রাটা তেমন ভয়াবহ হয় না। সমুদ্র থাকলে তাপমাত্রার ওঠানামার প্রক্রিয়াটি হয়ে ওঠে অনেকটাই সহনীয়, যা প্রাণের উৎপত্তি এবং টিকে থাকার জন্য জরুরি।
প্রাণের উৎপত্তির জন্য প্রয়োজন তরল পানি। এ কারণেই বিজ্ঞানীরা খুঁজে যাচ্ছেন এমন গ্রহ যেখানে তরল পানির উপস্থিতি থাকতে পারে। কিন্তু প্রাণের জন্য একটি গ্রহে শুধু পানি নয়, বরং পানির বিশাল সমুদ্র থাকতে হবে।
একদল বিজ্ঞানী তৈরি করেছেন এমন একটি কম্পিউটার সিমুলেশন যেখানে সম্ভাব্য পৃথিবীর মতো গ্রহের সমুদ্রে পানি চলাচলের ব্যাপারটি বোঝা যায়। দেখা যায় যে, একটি স্থিতিশীল ও বসবাসযোগ্য পরিস্থিতি তৈরি করার জন্য সমুদ্রের গুরুত্ব খুব বেশি।
পুরো গ্রহে সমানভাবে তাপ ছড়িয়ে দিতে সাহায্য করে সমুদ্র। প্রাণ ধারণের উপযোগী হতে হলে তাই একটি গ্রহে সমুদ্র থাকা প্রয়োজন। অনেক গ্রহই এমন 'গোল্ডিলক জোন'-এ অবস্থিত হতে পারে কিন্তু সমুদ্র না থাকলে সেখানে প্রাণ টিকবে না, পৃষ্ঠের তাপমাত্রা মাত্রাতিরিক্ত ওঠানামা করবে। এর একটি সহজ উদাহরণ হলো মঙ্গলগ্রহ। একই দিনে এর তাপমাত্রা ৮২ ডিগ্রি ওঠানামা করতে পারে। এ কারণে ভিনগ্রহের প্রাণী খুঁজতে হলে আগে ভিনগ্রহের সমুদ্র খোঁজাটা জরুরি।
এলিয়েন যে থাকতে পারে এ সম্ভাবনা কোনো বিজ্ঞানীই একেবারে উড়িয়ে দিতে পারেন না। পৃথিবীর বাইরে বিশাল এই মহাজগতে কোথাও না কোথাও তো প্রাণের উৎপত্তি হতেই পারে! আর এই এলিয়েনের খোঁজ নিয়ে গবেষণার শেষ নেই। কিন্তু কিছু বিজ্ঞানী আবার এক ধাপ এগিয়ে চিন্তা করছেন! এলিয়েনের দেখা যে পাওয়া যাবে সে ব্যাপারে তারা নিশ্চিত। তাদের চিন্তা অন্যখানে। এলিয়েনের সঙ্গে দেখা হয়ে গেলে মানুষ কী আচরণ করবে, তা নিয়ে মাথাব্যথা শুরু হয়ে গেছে তাদের!
নির্দিষ্ট আচরণবিধি!
এলিয়েনের সঙ্গে দেখা হয়ে যাওয়ার আগেই একেবারে কঠোর নীতিমালা নির্ধারণের কথা চিন্তা করা হচ্ছে। স্টারশিপ কংগ্রেস নামের এক সভায় এ কথা বলা হয়। এলিয়েন ও মানুষের মাঝে যোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ করতেই এ ব্যবস্থা জরুরি। এর কারণ হিসেবে বলা হয়- মানুষের সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও প্রযুক্তিগত বিভিন্ন পরিবর্তন আসার সম্ভাবনা আছে এলিয়েনদের সংস্পর্শে আসার ফলে। মানব সভ্যতার এহেন পরিবর্তন এড়াতে নীতিমালা নির্ধারণ করা দরকার।
এর উল্টোটাও কিন্তু প্রযোজ্য। কারণ মহাকাশযানে যেসব মানুষ থাকবে তাদের মাঝেও কিন্তু তাদের নিজস্ব সংস্কৃতি প্রকাশ পাবে। আর তাই ভিনগ্রহে যাওয়ার আগে মানুষের সংস্কৃতি এদের সঙ্গে যাবে কি না বা কী পরিমাণে যাবে তা নিয়ন্ত্রণ করারও দরকার।
অসীম সম্ভাবনা
ইন্টারন্যাশনাল স্পেস ডেভেলপমেন্ট হাব-এর ঈঊঙ আরমেন পাপাজিয়ানের মতে, 'আমাদের দৃষ্টিভঙ্গির ওপরই অনেকটা নির্ভর করছে এসব নীতিমালা। আমরা কী আশা করছি তার ওপর ভিত্তি করবে আমাদের আচরণ। আর মানুষের যা স্বাতন্ত্র্য রয়েছে তা অবধারিতভাবেই এলিয়েনদের সংস্পর্শে আসবে।'
কী করা যেতে পারে?
এলিয়েনদের খোঁজ পাওয়া গেলে মানুষ তাদের থেকে পালিয়ে থাকবে না, এটা ধরে নেওয়া যায়। তাদের সঙ্গে মানুষ স্বাভাবিকভাবেই যোগাযোগ স্থাপন করতে চাইবে। এই সময়ে নিরাপদ স্পেসসু্যট পড়ে থাকলে কোনোরকমের ক্ষতির সম্ভাবনা থাকার কথা নয়। গবেষণার জন্য রিসার্চ স্টেশন স্থাপন করার প্রয়োজন হবে। টেনেসি ভ্যালির ইন্টারস্টেলার ওয়ার্কশপের লেস জনসন ও তার দল কয়েকটা মূলনীতি বের করেছেন যেগুলো সব ধরনের (!) এলিয়েনের সঙ্গে যোগাযোগে কাজে লাগবে। এগুলো হলো-
ক. সরাসরি যোগাযোগের আগে এদের ব্যাপারে যতটা সম্ভব তথ্য সংগ্রহ করে নিতে হবে।
খ. জীবন্ত বুঝতে পারলে একে না ঘাঁটানোই শ্রেয়।
গ. এদের কোনো নমুনা পৃথিবীতে নিয়ে আসার ঝুঁকি না নেওয়াই ভালো, কারণ আমাদের প্রকৃতির বাস্তুসংস্থানের সঙ্গে এটি খাপ না খাওয়ার সম্ভাবনা থাকতে পারে।
প্রথম দর্শন
এলিয়েনের সঙ্গে প্রথম দর্শনে কী করবেন তা ভাবার সময় এলিয়েনদের মানসিক ও শারীরিক ক্ষতি যেন না হয় সে ব্যাপারেও কিন্তু আমাদের ভাবা উচিত। আর আমাদের জন্য যে ব্যাপারটা চমকদার হবে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। মানুষখেকো জংলির সামনে একজন আধুনিক মানুষ এসে পড়লে সেই জংলি মানুষের যে মনোভাব হবে, মানুষের চেয়ে উন্নত এলিয়েন দেখলে মানুষের মনের অবস্থাও তো তেমনই হওয়ার কথা! সুতরাং এই অবস্থায় নীতিমালা কতটা কার্যকর হবে তাই ভাবার বিষয়!
এত এত নক্ষত্র, তার আশপাশে কত হাজার হাজার গ্রহ। সব ফেলে পৃথিবীতেই কেন হামলা করবে তারা? এমন তো নয় যে পৃথিবীতে আসার পথটা খুব মনোরম, স্পেসশিপের জানালা দিয়ে দেখতে দেখতে আসা যাবে। বিভিন্ন সিনেমা থেকে দুটি যুক্তি পাওয়া যায়। একটি হলো, পৃথিবীর প্রাকৃতিক সম্পদ আহরণ। আরেকটি কারণ হলো, তারা পৃথিবীতে নিজেদের বংশের ধারা ছড়িয়ে দিতে চায়। আসলে কিন্তু এ দুটি যুক্তির একটিও খাটে না।
পৃথিবীর থেকে কী ধরনের প্রাকৃতিক সম্পদ চাইতে পারে এলিয়েনরা? ধরে নেই তারা শিল্পকারখানায় ব্যবহার করার মতো কাঁচামাল খুঁজছে। কিন্তু অন্যান্য গ্রহে এমন কী নেই, যা পৃথিবীতে আছে? ধাতু-অধাতু সবই মোটামুটি অন্যান্য গ্রহে পাওয়া যায়, তার জন্য কয়েক আলোকবর্ষ পাড়ি দেওয়ার দরকার নেই। ব্যতিক্রম হলো পানি, অন্তত আমরা তা-ই জানি। অথচ এই মহাবিশ্বে পানিও কিন্তু আছে অনেক জায়গায়ই। বৃহস্পতির কিছু চাঁদেই আছে অনেক পানি। সেখান থেকে পানি নিতে গেলে তেমন কোনো হাঙ্গামা করতে হবে না, কারো সঙ্গে যুদ্ধও করতে হবে না। অন্য গ্রহে পাড়ি দেওয়ার মতো প্রযুক্তি যাদের আছে, জমাটবাঁধা পানি আহরণের প্রযুক্তিও তাদের থাকার কথা।
তারা কি চাষবাসের জন্য আবাদি জমি খুঁজতে আসবে পৃথিবীতে? কিন্তু তার জন্যও আসলে মহাকাশ পাড়ি দেওয়ার প্রয়োজন পড়ে না। তারা নিজেদের সৌরজগতেই এমন মাটি খুঁজে নিতে পারে।
এই গ্রহে এলিয়েন বংশবিস্তারের ধারণাটা আরও বেশি অবাস্তব। পৃথিবীতেই এক প্রজাতির প্রাণীর সঙ্গে আরেক প্রজাতির সংকর করাটা ভয়াবহ ঝামেলার ব্যাপার। আর অন্য গ্রহ থেকে এসে মানুষের সঙ্গে প্রজননের ব্যাপারটা তো আরও দূরের কথা।
অনেকে আরও উচ্চমাত্রার চিন্তাভাবনা করেন। তারা বলেন, মানুষ যেভাবে পৃথিবীকে দূষিত করে ধ্বংসের পথে নিয়ে যাচ্ছে, তা ঠেকানোর জন্যই আসবে এলিয়েনরা। প্রথম কথা হলো, তারা জানবে কীভাবে যে আমাদের পৃথিবী হুমকির মুখে আছে? আর জানলেই বা তাদের কী এমন দরকার পড়েছে গায়ে পড়ে আমাদের পৃথিবীর উপকার করতে আসবে? পৃথিবীর জীবজগতের প্রতি তাদের যদি এতই দরদ থাকত, তবে তারা ৬৬ মিলিয়ন বছর আগে ডাইনোসরদের বিলুপ্তি রোধ করে ফেলত। কিন্তু তা হয়নি।
পৃথিবীর যদি তেমন গুরুত্বপূর্ণ কিছু থেকেই থাকে তবে তা হবে আমাদের সংস্কৃতি এবং বাস্তুসংস্থান। আর এসব জানার জন্য আসলে এত দূরদূরান্তের পথ পাড়ি দিতে হবে না, কোনোভাবে আমাদের টিভির সিগন্যাল ধরতে পারলেই হবে। সুতরাং সিনেমায় যা-ই দেখুন না কেন, খুব শিগগিরই এলিয়েন এসে আপনার-আমার পৃথিবী দখল করে নিচ্ছে না, নিশ্চিন্ত থাকুন।