বৃহস্পতিবার, ০৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ২০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১

তথ্যপ্রযুক্তিতে বায়োমেট্রিক্সের ব্যবহার

বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ডেস্ক
  ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ০০:০০
তথ্যপ্রযুক্তিতে বায়োমেট্রিক্সের ব্যবহার

বায়োমেট্রিক শব্দটি এখন অতিপরিচিত এক শব্দ। মোবাইল ফোনের সিম নিবন্ধনের জন্য তা এ দেশে ব্যাপক আলোচিত। কিন্তু এই বায়োমেট্রিক্স পদ্ধতি বা বিষয়টি কী? আর এর ইতিহাস সম্পর্কেই বা কতটুকু জানা যায়? আসুন কিছুটা হলেও জেনে নিই এ সম্পর্কে। বায়োমেট্রিক্স হলো বায়োলজিক্যাল ডেটা মাপা এবং বিশ্লেষণ করার বৈজ্ঞানিক প্রযুক্তি। গ্রিক শব্দ 'নরড়' (ষরভব) ও 'সবঃৎরপ'(ঃড় সবধংঁৎব) থেকে উৎপত্তি হয়েছে (ইরড় সবঃৎরপং) বায়োমেট্রিক্স। তথ্যপ্রযুক্তিতে বায়োমেট্রিক্স হলো সেই প্রযুক্তি যা মানুষের দেহের বৈশিষ্ট্য যেমন : ডিএনএ, ফিঙ্গারপ্রিন্ট, চোখের রেটিনা এবং আইরিস, কণ্ঠস্বর, চেহারা এবং হাতের মাপ ইত্যাদি মেপে এবং বিশ্লেষণ করে বৈধতা নির্ণয় করে। কম্পিউটার পদ্ধতিতে নিখুঁত নিরাপত্তার জন্য বায়োমেট্রিক্স পদ্ধতি ব্যবহার হয়। এ পদ্ধতিতে মানুষের বায়োলজিক্যাল ডেটা কম্পিউটারের ডেটাবেজে সংরক্ষিত করে রাখা হয় এবং পরে এসব ডেটা নিয়ে স্বয়ংক্রিয়ভাবে মিলিয়ে দেখা হয়। ডেটাতে মিল পেলে তা বৈধ বলে বিবেচিত হয় এবং অনুমতিপ্রাপ্ত হয়। বিশেষ ব্যক্তিকে শনাক্ত করার ক্ষেত্রে ব্যবহৃত বায়োমেট্রিক্স প্রযুক্তি কী, এর উন্নয়ন, প্রয়োজনীয়তা এবং সুবিধাদি সম্পর্কে চলুন আরও একটু জানা যাক। সহজ একটি উদাহরণ দিয়ে ব্যাখ্যা করলে আরও পরিষ্কার হয়ে যাবে। অনেকেই হয়তো লক্ষ করেছেন, বড় বড় প্রতিষ্ঠানের গেটে ফিঙ্গারপ্রিন্ট সেন্সর লাগানো থাকে। এই পদ্ধতির মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানটিতে কারা ঢুকতে পারবে আগে থেকেই তাদের ফিঙ্গারপ্রিন্ট নিয়ে কম্পিউটারে বিশেষ নিরাপত্তা সফটওয়্যারের ডেটাবেজে সংরক্ষণ করে রেখে দেওয়া হয়। গেটে আসা প্রবেশকারীরা আঙুল দিয়ে ফিঙ্গারপ্রিন্ট সেন্সরের বিশেষ স্থানে চাপ দিলে ফিঙ্গারপ্রিন্ট তৈরি হয়ে তা কম্পিউটারে যাবে এবং কম্পিউটারে রক্ষিত ফিঙ্গারপ্রিন্টের সঙ্গে মিলিয়ে দেখবে। যদি মিলে যায় তাহলে গেট খুলে যাবে আর মিল না পেলে গেট খুলবে না। এই ফিঙ্গারপ্রিন্ট হলো এখানে একটি বায়োলজিক্যাল ডেটা। ফিঙ্গারপ্রিন্ট বা আঙুলের ছাপ হলো মানুষের অনন্য বৈশিষ্ট্য। একজনের আঙুলের ছাপের সঙ্গে অন্যজনের ছাপ কখনো মেলে না। আর এই আঙুলের ছাপকে ব্যবহার করে কম্পিউটার সফটওয়্যারনির্ভর যে নিরাপত্তাব্যবস্থা করা হয় তা-ই হলো বায়োমেট্রিক্স পদ্ধতি।

বায়োমেট্রিক্সের প্রকারভেদ : দেহের গঠন ও আচরণগত বৈশিষ্ট্যের ওপর ভিত্তি করে বায়োমেট্রিক্স পদ্ধতি বিভিন্ন প্রকার হতে পারে। যেমন : ১. দেহের গঠন ও শারীরবৃত্তীয় বৈশিষ্ট্যের বায়োমেট্রিক্স পদ্ধতি- মুখ, ফিঙ্গারপ্রিন্ট, হ্যান্ড জিওমেট্রি, আইরিস, রেটিনা এবং শিরা; ২. আচরণগত বৈশিষ্ট্যের বায়োমেট্রিক্স পদ্ধতি- কণ্ঠস্বর, সিগনেচার, টাইপিং কি স্ট্রোক।

বায়োমেট্রিক্সের ব্যবহার :বর্তমানে নিরাপত্তার কাজে বায়োমেট্রিক্স পদ্ধতি ব্যাপকভাবে ব্যবহার হচ্ছে। এ প্রযুক্তি সাধারণত দুই ধরনের কাজে ব্যবহার হয় : ১. ব্যক্তি শনাক্তকরণ (ওফবহঃরভরপধঃরড়হ), ২. সত্যতা যাচাই (ঠবৎরভরপধঃরড়হ)।

বর্তমানে সবচেয়ে বেশি প্রচলিত বায়োমেট্রিক্স পদ্ধতিগুলো হলো- ফিঙ্গারপ্রিন্ট রিডার, ফেইস রিকগনিশন, হ্যান্ড জিওমেট্রি, আইরিস ও রেটিনা স্ক্যান, ভয়েস রিকগনিশন এবং সিগনেচার ভেরিফিকেশন।

এই পদ্ধতি অল্প কয়েক দশক ধরে ব্যবহৃত হলেও এর উদ্ভব কয়েকশ', বা কয়েক হাজার বছর আগে। বৈশিষ্ট্য হিসেবে মানুষের প্রাচীনতম এবং সবচেয়ে মৌলিক উদাহরণ তার মুখ। সভ্যতার শুরু থেকে মানুষের মুখ ব্যবহার হয়েছে পরিচিত এবং অপরিচিত ব্যক্তিকে চিহ্নিত করতে। জনসমষ্টি বৃদ্ধি এবং কাজের পরিধি এবং সম্প্রদায় প্রবর্তিত হওয়ার কারণে এই সহজ কাজটি উত্তরোত্তর আরো চ্যালেঞ্জিং হয়ে ওঠে। এর ফলে ব্যক্তি শনাক্তকরণ ও সত্যতা যাচাইয়ে অনেক পরিবর্তন এসেছে।

এ ছাড়া অন্যান্য বৈশিষ্ট্যের স্বীকৃতির জন্য একটি আনুষ্ঠানিক মাধ্যম হিসেবে সভ্যতার ইতিহাসজুড়ে এই বায়োমেট্রিক্স ব্যবহার করা হয়েছে।

আনুমানিক ৩১ হাজার বছর আগে গুহাবাসের যুগে এবং প্রাগৈতিহাসিককালে মানুষ গুহায় হাত আঁকা ছবির মাধ্যমে দেয়াল সুশোভিত করত। এই চিত্রকলাগুলোই অনেক সময় 'একটি অবিস্মরণীয় স্বাক্ষর হিসেবে' কাজ করেছে।

খ্রিষ্টপূর্ব ৫০০ বছর আগে ব্যাবিলনে ব্যবসায়িক লেনদেনের কাজে কাদামাটির ওপর আঙুলের ছাপ ব্যবহৃত হতো।

জোয়াও দ্য ব্যারোস নামের এক স্প্যানিশ অনুসন্ধানকারী এবং লেখক লিখেছেন, প্রথম চীনা বণিকরা ফিঙ্গারপ্রিন্ট ব্যবহার করত ব্যবসায়িক লেনদেন নিষ্পত্তির জন্য। এ ছাড়া চীনা বাবা-মায়েরা পরস্পর থেকে শিশুদের পার্থক্য করতে আঙুলের ছাপ এবং পদচিহ্নের ব্যবহার করতেন।

মিসরীয় ইতিহাসের গোড়ার দিকে ব্যবসায়ীদের পরিচিতি, খ্যাতি, বিশ্বস্ত ব্যবসায়ী, সফল লেনদেন এবং বাজারে যারা নতুন তাদের মধ্যে পার্থক্য নির্ণয় করতে শারীরিক বর্ণনা দিয়ে চিহ্নিত করা হতো।

১৮ শতকের মাঝামাঝি শিল্প বিপস্নবের পর দ্রম্নতগতিতে নগরায়ণ ও ব্যবসায়িক পরিবর্তনের ফলে মানুষকে চিহ্নিত করার প্রয়োজন অনেক বেশি বেড়ে যায়। ব্যবসায়িক ও কর্তৃপক্ষের মধ্যে ব্যবসার পরিধি ক্রমবর্ধমানভাবে বেড়ে চললে একটি ফরমাল পদ্ধতির প্রয়োজন হয়ে পড়ে।

পরিচিতি, নিরাপত্তা, যে নামেই হোক, পুলিশ বা নিরাপত্তাবাহিনী ব্যক্তিগতভাবে প্রথম আঙুলের ছাপ নেয় সাউথ আমেরিকা, এশিয়া এবং ইউরোপে। উপমহাদেশে এই ছাপ নেওয়া হয় ভারতের পশ্চিমবঙ্গে। সে সময় পুলিশ ইন্সপেক্টর এডওয়ার্ড হেনরির জন্য মানুষের ছাপ নিয়েছিলেন আজিজুল হক। এই সিস্টেমকে বলা হয় হেনরি সিস্টেম। ফিঙ্গারপ্রিন্ট শ্রেণিকরণের জন্য সেই ব্যবস্থা এখনো ব্যবহার করা হয়।

আসল বায়োমেট্রিক সিস্টেম চালু হয় বিংশ শতাব্দীর শেষ ভাগে কম্পিউটার সিস্টেমের উদ্ভবের সঙ্গে। ১৯৯০ থেকে ২০০০ সালের মধ্যে বিভিন্ন অ্যাপিস্নকেশনের ক্ষেত্রে এর প্রয়োগ শুরু হয়।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে