শুক্রবার, ১৭ মে ২০২৪, ৩ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১

ভারতের ক্রিকেটের বর্ণালী চরিত্র আজহারউদ্দিন

ক্রীড়া ডেস্ক
  ০৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০০:০০
ভারতের ক্রিকেটের বর্ণালী চরিত্র আজহারউদ্দিন

টেস্ট অভিষেকেই সেঞ্চুরি, তাও আবার টানা তিন টেস্টে! এমনই রাজসিক অভিষেকে সবাই ধরে নিয়েছিল, গাভাস্কার পরবর্তী ভারতীয় ক্রিকেট পেয়ে গেছে তাদের মহাতারকা। পরবর্তী ১৬ বছরে ভারতীয় ক্রিকেটের অবিসংবাদিত নেতা হয়ে ওঠেন মোহাম্মদ আজহারউদ্দিন। কিন্তু ক্যারিয়ার সায়াহ্নে বিনা মেঘে বজ্রপাত। গোটা দেশ যখন আজহারের শততম টেস্টের ক্ষণগণনা করছে তখনই ম্যাচ ফিক্সিং কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে যায় ভারতের এই অধিনায়কের নাম। ভারতের ক্রিকেটের সবচেয়ে বর্ণালী চরিত্র আজহার। অবিসংবাদিত নায়ক নিমিষেই হয়ে যান ভারতের সবচেয়ে বিতর্কিত, সমালোচিত, নিন্দিত ক্রিকেটার।

তার কব্জির মোচড়ে খেলা ফ্লিক শটকে নান্দনিকতার চরমতম দৃষ্টান্ত মনে করা হতো। মাঠে চলনবলন ও ব্যাটিং সৌন্দর্যে ঠিকরে বের হতো আভিজাত্য। অভিষেকে তোলপাড় তুলে দেওয়া আজহার মাত্র পাঁচ বছরের মধ্যেই পেয়ে গিয়েছিলেন ভারতীয় দলের অধিনায়কত্ব। এমন স্বপ্নের মতো ক্যারিয়ারের শেষটা কি-না আক্ষেপের!

১৯৮৪ সালের শেষদিনে ঐতিহ্যবাহী ইডেন গার্ডেনে অভিষেক আজহারের। প্রথম ইনিংসেই ১১০ রান করে তাক লাগিয়ে দেন তিনি। সিরিজের পরের দুই টেস্টেও একটি করে সেঞ্চুরি। অভিষেকে টানা তিন টেস্টে সেঞ্চুরি- এই মর্ত্যলোকে একমাত্র আজহারেরই আছে এমন বিরল কীর্তি। এরপর ইংল্যান্ডের বিপক্ষেই ওয়ানডে অভিষেক। চিন্নাস্বামী স্টেডিয়ামে সেই ইনিংসেও ৪৭ রানে ছিলেন অপরাজিত।

১৯৮৯ সালে কৃষ্ণমাচারি শ্রীকান্তের অধীনে পাকিস্তান সফরে টেস্ট সিরিজ ড্র করে ফেরে ভারত। ইমরান-ওয়াসিম-ওয়াকার ত্রয়ীর বোলিং লাইনআপ সামলে এমন ফলে সন্তুষ্ট হলেও ভারতীয় বোর্ড অধিনায়কত্বের ব্যাটটা আজহারের হাতেই সঁপে দেয়। এরপর ১৯৯০ সালের ইংল্যান্ড টু্যরে লর্ডসের প্রথম টেস্টে খেলেন সেই মহাকাব্যিক ১২১ রানের ইনিংস, ভারত হারার পরও যাকে ইংলিশ ক্রিকেটার ভিক মার্কস 'উজ্জ্ব্বলতম টেস্ট সেঞ্চুরি' বলে আখ্যায়িত করেন।

সেই সিরিজে ৮৫.২০ গড়ে ৪২৬ রান করেন আজহার, যা ভারতীয় অধিনায়কদের মধ্যে ইংল্যান্ডের মাটিতে সর্বোচ্চ রান হিসেবে ২০১৮ সাল পর্যন্ত টিকেছিল। বিরাট কোহলি অবশেষে সেই রেকর্ড ভাঙেন।

আজহারের নেতৃত্বে ভারত দুইবার এশিয়া কাপ জিতলেও বিশ্বকাপে সফল হতে পারেনি। ১৯৯২ বিশ্বকাপে গ্রম্নপ পর্ব থেকেই বিদায় নেয় ভারত। আর ১৯৯৬ সালে নিজ দেশের বিশ্বকাপে সেমিফাইনাল থেকেই বিদায় নেয়। ইডেন গার্ডেনে সেই সেমিফাইনালে শ্রীলংকার বিপক্ষে ভারতের সেই হার আজও ভারতীয় ক্রিকেটের বড় কলঙ্ক।

দুই শতাধিক ম্যাচে ভারতকে নেতৃত্ব দিয়েছেন আজহারউদ্দিন। তার নেতৃত্বে ৪৭ টেস্টের ১৪টিতে জয় পায় ভারত। আর একদিনের ক্রিকেটে ১৭৪ ম্যাচে ৯০টিতে জয় এনে দেন।

তবে আজহারের ক্যারিয়ারের সবচেয়ে বড় আক্ষেপ হয়ে আছে শততম টেস্ট খেলতে না পারার ব্যর্থতা। ৯৯ টেস্টে ক্যারিয়ার আটকে যাওয়ার আগে ৪৫.০৩ গড় আর ২২ সেঞ্চুরিতে ৬ হাজার ২১৫ রান করেন। ওয়ানডে ক্রিকেটেও ছিলেন ১০ হাজার রান পূর্ণ করার পথে। ৩৩৪ ওয়ানে ম্যাচে ৩৬.৯২ গড়ে ৭ সেঞ্চুরিতে ৯৩৭৮ রান করেন এই মিডল অর্ডার ব্যাটার।

আজহারের শততম টেস্ট খেলতে না পারা আর ১০ হাজার রান পূর্ণ করতে না পারার পেছনে আছে ভারতীয় ক্রিকেটের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় কেলেঙ্কারির যোগ। ২০০০ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার তৎকালীন অধিনায়ক হ্যান্সি ক্রনিয়ের বিরুদ্ধে ম্যাচ ফিক্সিংয়ের অভিজ্ঞ আনা হয়। সেই ফিক্সিংয়ের বিশদ তদন্তে কেঁচো খুঁড়তে সাপ বেরিয়ে আসে। এক বিবৃতিতে ক্রনিয়ে জানান, ১৯৯৬ সালে ভারতের বিপক্ষে কানপুর টেস্টের তৃতীয় দিনে আজহার তাকে ফোন করে সন্ধ্যায় তার কক্ষে ডাকেন। সেখানেই মুকেশ গুপ্তা নামের এক বুকির সঙ্গে ক্রনিয়ের পরিচয় করিয়ে দেন আজহার। এর কিছুক্ষণ পর আজহার তাদের রেখে কক্ষ থেকে বেরিয়ে যান। সিবিআই এই ঘটনার তদন্ত করতে গিয়ে সংশ্লিষ্টতা খুঁজে পায় ভারতীয় ব্যাটার অজয় জাদেজারও। সেই সঙ্গে আজহারের সঙ্গে সঞ্জয় চাওলা নামের আরও এক বুকির যোগাযোগের তথ্য পায়।

এই তদন্তে জানা যায়, ১৯৯৬ সালে রাজকোটে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে ম্যাচ ছাড়াও ১৯৯৭ ও ১৯৯৯ সালে পেপসি কাপেও ম্যাচ ফিক্সিংয়ে জড়িত আজহার। এই ঘটনায় আজীবনের জন্য ক্রিকেট থেকে নিষিদ্ধ করা হয় আজহারকে। জাদেজা নিষিদ্ধ হন ৫ বছরের জন্য।

আক্ষেপ থাকলেও প্রাপ্তিও কম নয় আজহারের। একমাত্র ক্রিকেটার হিসেবে অভিষেক টেস্টে ও ক্যারিয়ারের শেষ টেস্টে সেঞ্চুরি হাঁকানোর রেকর্ড তার দখলে। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে প্রথম খেলোয়াড় হিসেবে ৩০০ ওয়ানডে খেলার কৃতিত্বও তার দখলে। ক্রিকেট থেকে ছিটকে পড়ার সময় ভারতীয় ফিল্ডারদের মধ্যে সর্বোচ্চ ক্যাচ নেওয়ার রেকর্ডও ছিল তার দখলে। পরে অবশ্য রাহুল দ্রাবিড় সে রেকর্ড ভেঙে দেন। ১৯৮৬ সালে তাকে অর্জুনা পদকে ভূষিত করে ভারত সরকার। ১৯৮৮ সালে পান পদ্মশ্রী। ১৯৯১ সালে উইজডেনের 'ক্রিকেট পেস্নয়ার অব দ্য ইয়ার' খেতাবেও ভূষিত হন।

বরাবরই আজহার তার বিরুদ্ধে ওঠা ম্যাচ ফিক্সিংয়ের অভিযোগ অস্বীকার করে এসেছেন। সব ধরনের ক্রিকেট থেকে তাকে নিষিদ্ধ করা হলে অন্ধ্র প্রদেশের উচ্চ আদালতে এই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করেন তিনি। দীর্ঘদিন মামলাটি প্রক্রিয়াধীন থাকার পর ২০১২ সালে উপযুক্ত প্রমাণের অভাবে অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয় তাকে। ২০১৯ সালে তিনি হায়দরাবাদ ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন।

কব্জির মোচড়ে ২২ গজে ফুল ফোটানো এই শিল্পী একের পর এক বিতর্কে জড়িয়েছেন। বিয়ে করেছেন তিনবার, যেখানে আছেন বলিউড সুন্দরী সঙ্গীতা বিজলানি থেকে আমেরিকান নাগরিক শ্যানোন মেরি। নাম লিখিয়েছেন রাজনীতিতে, হয়েছেন সংসদ সদস্য। তার জীবন নিয়ে বলিউডে বানানো হয়েছে সিনেমা। গতকাল ছিল সেই আজহারউদ্দিনের জন্মদিন। ১৯৬৩ সালের ৮ ফেব্রম্নয়ারি হায়দরাবাদে জন্মগ্রহণ করেছিলেন ভারতের সাবেক এই অধিনায়ক।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
X
Nagad

উপরে