বুলবুল আহমেদ। চিত্রনায়ক-পরিচালক-প্রযোজক। বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে অন্যতম সুদর্শন, জননন্দিত চিত্রনায়ক ছিলেন বুলবুল আহমেদ। অসামান্য অভিনয় প্রতিভার অধিকারী, সুশিক্ষিত-পরিমার্জিত রুচিশীল ও সৃজনশীল এক অভিনেতা। ভিন্নমাত্রার অভিনয় দক্ষতায় অন্যরকম এক নায়কোচিত ইমেজ গড়ে তুলেছিলেন রুপালি পর্দায়। ক্ল্যাসিক বা রোমান্টিক সব ধরনের চলচ্চিত্রে অনবদ্য সাবলীল অভিনয় দক্ষতায় তিনি ছিলেন স্বাচ্ছন্দ্য। সিনেমাদর্শকদের অতিপ্রিয় 'দেবদাস'-'মহানায়ক'-'ভালোমানুষ' বুলবুল আহমেদ।
১৯৪১ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর পুরান ঢাকার আগামসি লেনে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। তার আসল নাম তাবারক আহমেদ, পিতামাতা তাকে 'বুলবুল' বলে ডাকতেন। পিতা খলিল আহমেদ ছিলেন পাকিস্তান আমলের অর্থ বিভাগের ডেপুটি সেক্রেটারি, অভিনেতা ও নাট্যকার। মায়ের নাম মোসাম্মত মোসলেমা বেগম। অনেক সময় তাদের বাড়িতে নাটকের মহড়া হতো। কিশোর বুলবুল প্রায়ই সেই মহড়া দেখতেন। ঢাকার ফুলবাড়িয়ার মাহবুব আলী ইনস্টিটিউশনে তার বাবার নির্দেশিত নাটক মঞ্চস্থ হলে, তিনিও দেখতে যেতেন। সেখান থেকেই তার অভিনয়ের প্রতি আগ্রহ জন্ম নেয়।
বুলবুল আহমেদ ঢাকার কলেজিয়েট স্কুল থেকে ১৯৫৭ সালে, ম্যাট্রিকুলেশন এবং ঢাকা কলেজ থেকে ১৯৫৯ সালে আইএ পাস করেন। নটর ডেম কলেজ থেকে ১৯৬১ সালে, বিএ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগ থেকে ১৯৬৩-তে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন সময়ে, সলিমুলস্নাহ মুসলিম হলের বার্ষিক নাটকে অভিনয় করতেন তিনি, এক সময় গ্রম্নপ থিয়েটার ড্রামা সার্কেল নাট্যগোষ্ঠীর স্বক্রিয় সদস্য হয়ে যান।
পড়ালেখা শেষ করে বুলবুল আহমেদ, তৎকালীন ইউবিএল ব্যাংক-এ চাকরি নেন। ইউবিএল ব্যাংকের টিএসসি শাখার ম্যানেজার ছিলেন তিনি। চাকরির পাশাপাশি মঞ্চ ও টিভি নাটকে অভিনয় করতেন।
টেলিভিশনে বুলবুল আহমেদ অভিনীত উলেস্নখযোগ্য নাটক- বরফ গলা নদী, মালঞ্চ, ইডিয়েট, মাল্যদান, বড় দিদি, আরেক ফাল্গুন, শেষ বিকালের মেয়ে, দক্ষিণের জানালা, তোমাদের জন্য ভালোবাসা, তুমি রবে নীরবে, টাকায় কিনা হয়, হৈমন্তী, দূরদর্শিনী, সারাদিন বৃষ্টি ও এই সব দিনরাত্রি প্রভৃতি।
বুলবুল আহমেদ 'ইয়ে করে বিয়ে' ছবিতে অভিনয়ের মাধ্যমে চলচ্চিত্রে পদার্পণ করেন। ইউসুফ জহির পরিচালিত ছবিটি মুক্তিপায় ১৯৭৩ সালে। তার অভিনীত অন্যান্য ছবিসমূহের মধ্যে আছে- অঙ্গীকার, রুপালি সৈকতে, মনের মানুষ, অঙ্গার, সীমানা পেরিয়ে, সূর্য কন্যা, জননী, যাদুর বাঁশি, বধূ বিদায়, জন্ম থেকে জ্বলছি, ওয়াদা, দেবদাস, মহানায়ক, ভালো মানুষ, যৌতুক, সোনার হরিণ, দি ফাদার, আরাধনা, শেষ উত্তর, গাংচিল, সোনার তরী, কলমিলতা, কালো গোলাপ, সাক্ষী, আলস্নাহ মেহেরবান, পুরস্কার, সময় কথা বলে, ফেরারী বসন্ত, সোহাগ, বৌরাণী, ঘরসংসার, ডার্লিং, শক্তিশালী, ছোট মা, জীবন নিয়ে জুয়া, সঙ্গিনী, স্মৃতি তুমি বেদনা, স্বামী, বদনাম, পেনশন, দহন, শত্রম্ন, মা ও ছেলে, শুভদা, মায়ের দাবি, লাভ ইন আমেরিকা, সারেন্ডার, নওজোয়ান, ঝিনুকমালা, রাজলক্ষ্ণী ও শ্রীকান্ত, দুই জীবন, রঙ্গীন নবাব সিরাজউদ্দৌলা, পদ্মা মেঘনা যমুনা, ত্রাস, বিক্ষোভ, এই ঘর এই সংসার, দিপু নাম্বার টু, মৌমাছি, আকর্ষণ, গরম হাওয়া, কত যে আপন, প্রাণের চেয়ে প্রিয়, এখনো অনেক রাত, শ্বশুরবাড়ী জিন্দাবাদ, নিঃশ্বাসে তুমি বিশ্বাসে তুমি, সুন্দরী বধূ, তুমি শুধু আমার, গোলাগুলি, দুই নয়নের আলো, ইত্যাদি।
বুলবুল আহমেদ যেমন চলচ্চিত্রের রুপালি পর্দায় আলো ছড়িয়েছেন তেমনি তার অভিনীত অনেকে চলচ্চিত্রের গানও মানুষের মনের গভীরে গেঁথে আছে। যেমন : হাজার মনের কাছে প্রশ্ন রেখে (মহানায়ক), আমার এই দুটি চোখ (মহানায়ক), বলবো কী আর ওগো তুমি যে আমার (সানাই), যদি বউ সাজো গো (ওয়াদা), সামাল সামাল সামাল সাথী (ওয়াদা), বিমূর্ত এই রাত্রি আমার (সীমানা পেরিয়ে), ঐ ভীরু মন আমার মনের (ভালো মানুষ, ছবিটি বুলবুল আহমেদ অভিনীত হলেও গানটির দৃশ্যে থাকেন ইলিয়াস কাঞ্চন ও ববিতা), মনটা কেন হঠাৎ করে বাঁধন হারালো (গাঙচিল), দুটি মন যখন কাছে এলো (সঙ্গিনী), তুমি ছাড়া আমি একা (দুই জীবন), দুঃখ ভালোবেসে প্রেমের খেলা খেলতে হয় (জন্ম থেকে জ্বলছি), চিরদিন সাথী তোমাকেই চাই (কালো গোলাপ), এ আকাশকে সাক্ষী রেখে (সোহাগ) ও বউ কথা কও (শিমুল পারুল), একবার যদি কেউ ভালোবাসতো (জন্ম থেকে জ্বলছি), শত জনমের স্বপ্ন তুমি আমার জীবনে এলে (রাজলক্ষ্ণী শ্রীকান্ত), একটুস খানি দেখ (বধূ বিদায়) ও ভাপা পিঠারে (শিমুল পারুল) ইত্যাদি।
বুলবুল আহমেদ চলচ্চিত্রে অভিনয়ের পাশাপাশি কয়েকটি ছবি প্রযোজনা ও পরিচালনা করেছেন। তার প্রযোজিত ও পরিচালিত ছবি- মহানায়ক, ভালো মানুষ, আকর্ষণ, গরম হাওয়া, কত যে আপন, প্রভৃতি।
কাজের স্বীকৃতি স্বরূপ চারবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছেন। সীমানা পেরিয়ে (১৯৭৭), বধূ বিদায় (১৯৭৮), শেষ উত্তর (১৯৮০) ছবির জন্য শ্রেষ্ঠ অভিনেতা এবং দীপু নাম্বার টু (১৯৯৬) ছবিতে পার্শ্ব চরিত্রে শ্রেষ্ঠ অভিনেতার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পান। রূপালী সৈকতে (১৯৭৯), দেবদাস (১৯৮২), ফেরারী বসন্ত (১৯৮৩), রাজলক্ষ্ণী ও শ্রীকান্ত ছবির জন্য শ্রেষ্ঠ অভিনেতা হিসেবে পেয়েছেন, বাচসাস চলচ্চিত্র পুরস্কার।
পারিবারিক জীবনে বুলবুল আহমেদ ১৯৬৩ সালে অভিনেত্রী ফৌজিয়া আহমেদ ডেইজিকে বিয়ে করেন। এই দম্পতির তিন সন্তান। মেয়ে ঐন্দ্রিলা ও তিলোত্তমা এবং ছেলে শুভ। ছেলে-মেয়েরাও অভিনয়ের সঙ্গে যুক্ত। নায়ক বুলবুল আহমেদের স্মৃতিকে ধরে রাখতে এবং প্রবীণ শিল্পীদের সম্মানিত করার প্রয়াসে, পরিবারের পক্ষ থেকে গঠিত হয়েছে 'বুলবুল আহমেদ ফাউন্ডেশন'। বুলবুল আহমেদ ২০১০ সালের ১৫ জুলাই, ঢাকায় মৃতু্যবরণ করেন। মৃতু্যকালে তার বয়স হয়েছিল ৬৯ বছর।
নতুন খবর হলো- বাবা বুলবুল আহমেদের জীবনের গল্প নিয়ে একটি সিনেমা নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছেন মেয়ে ঐন্দ্রিলা। এই সিনেমার জন্য তিনি পড়াশুনাও করেছেন। এখন চলছে চিত্রনাট্য তৈরির গবেষণা।
সিনেমাটি প্রসঙ্গে ঐন্দ্রিলা বলেন, 'বাবাকে নিয়ে আমার অনেক স্বপ্ন ও পরিকল্পনা রয়েছে। শুধু বাবাকে নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণ করব বলে ফিল্ম বিষয়ে পড়াশুনাও করেছি। চলচ্চিত্র নির্মাণে এখন নিজেকে উপযুক্ত মনে করছি, তাই ঘোষণা দিয়েছি চলচ্চিত্র নির্মাণের। বর্তমানে টেবিলওয়ার্ক চলছে। এটি রিসার্চ বেইজড কাজ। পারফেক্টলি করতে হলে অনেক সময় লাগবে। এর জন্য বুলবুল আহমেদের সময়কার চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্ট যারা বেঁচে আছেন, তাদের সঙ্গেও দেখা করছি। পাত্রপাত্রী নির্বাচনে একটু সময় লাগবে। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে চলতি বছরের শেষের দিকে সিনেমার শুটিং শুরু করার ইচ্ছা রয়েছে।'
সিনেমায় নায়ক হবেন কে, জানতে চাইলে ঐন্দ্রিলা বলেন, 'কাকে নায়ক করব তা এই মুহূর্তে বলতে পারছি না। সিনেমার কাজ শুরু করলে এ নিয়ে ভাবব। যখন নির্মাণে হাত দেব, তখন যাকে আব্বুর চরিত্রে উপযুক্ত মনে হবে, তাকেই প্রস্তাব দেব।'