রোববার, ০৮ জুন ২০২৫, ২৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

পুঁজিবাজারে বিদেশীদের অংশগ্রহণ তলানীতে

২০২৪ সালে দেশে পুঁজিবাজারের মোট লেনদেনে বিদেশীদের অংশগ্রহণের পরিমাণ ১ দশমিক ২২ শতাংশে দাঁড়িয়েছে।
অর্থ-বাণিজ্য রিপোর্ট
  ১৩ জানুয়ারি ২০২৫, ০০:০০
পুঁজিবাজারে বিদেশীদের অংশগ্রহণ তলানীতে
পুঁজিবাজারে বিদেশীদের অংশগ্রহণ তলানীতে

একটি দেশের পুঁজিবাজার কতটা বিনিয়োগ উপযোগী সেটি পরিমাপের অন্যতম একটি সূচক হচ্ছে বিদেশী বিনিয়োগকারীদের উপস্থিতি। তাদের বিনিয়োগের ওপর ভিত্তি করেই একটি দেশের পুঁজিবাজার বৈশ্বিক হয়ে ওঠে। কিন্তু বাংলাদেশের পুঁজিবাজারে বিদেশীদের অংশগ্রহণ তলানীতে ঠেকেছে।

সর্বশেষ ২০২৪ সালে দেশের পুঁজিবাজারের মোট লেনদেনে বিদেশীদের অংশগ্রহণের পরিমাণ ১ দশমিক ২২ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। ফ্লোর প্রাইস, নীতির অধারাবাহিকতা, ভালো শেয়ারের অভাব, বিনিময় হারের অস্থিরতা ও সুশাসনের ঘাটতির কারণে বিদেশীরা দেশের পুঁজিবাজার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।

1

দেশের প্রধান পুঁজিবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) তথ্যানুসারে, গত নয় বছরে এক্সচেঞ্জটির মোট লেনদেনে বিদেশীদের অংশগ্রহণ ৩ দশমিক ৮৫ থেকে কমে ১ দশমিক ২২ শতাংশে নেমে এসেছে। ২০১৬ সালে ডিএসইতে বিদেশীদের লেনদেনের পরিমাণ ছিল ৮ হাজার ৭৭৩ কোটি টাকা, যা ছিল এক্সচেঞ্জটির মোট লেনদেনের ৩ দশমিক ৬৮ শতাংশ। ২০১৭ সালে এক্সচেঞ্জটির মোট লেনদেনের ২ দশমিক ৬৪ শতাংশ ছিল বিদেশীদের, টাকার অংকে যা ১১ হাজার ৪৪৮ কোটি। ২০১৮ ও ২০১৯ সালে ডিএসইতে বিদেশীরা যথাক্রমে ৯ হাজার ২৭৩ কোটি ও ৭ হাজার ৮২৩ কোটি টাকার শেয়ার লেনদেন করেছেন এবং এক্সচেঞ্জটির মোট লেনদেনে তাদের অংশগ্রহণের হার ছিল যথাক্রমে ৩ দশমিক ৪৮ ও ৩ দশমিক ৪৪ শতাংশ। কভিডের বছর ২০২০ সালে পুঁজিবাজারে বিদেশীদের লেনদেনের পরিমাণ ছিল ১০ হাজার ৩৮৮ কোটি টাকা, যা ছিল ডিএসইর মোট লেনদেনের ৩ দশমিক ৮৫ শতাংশ। ২০২১ সালে এক্সচেঞ্জটির মোট লেনদেনে বিদেশীদের অংশগ্রহণের হার নেমে যায় ১ দশমিক ১০ শতাংশে এবং টাকার অংকে লেনদেন দাঁড়ায় ৭ হাজার ৭৬৪ কোটিতে। ২০২২ ও ২০২৩ সালে ডিএসইতে বিদেশীদের লেনদেনের পরিমাণ তলানিতে গিয়ে ঠেকে। এ দুই বছরে এক্সচেঞ্জটির মোট লেনদেনে বিদেশীদের অংশগ্রহণের হার ছিল যথাক্রমে দশমিক ৮৯ ও দশমিক ৭৭ শতাংশ। এ সময়ে টাকার অংকে বিদেশীদের লেনদেনের পরিমাণ ছিল যথাক্রমে ৪ হাজার ১৮০ কোটি ও ২ হাজার ১৬৭ কোটি টাকা। সর্বশেষ ২০২৪ সালে ডিএসইতে বিদেশীদের লেনদেন কিছুটা বেড়ে ৩ হাজার ৯২৯ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে, যা ছিল গত বছরে এক্সচেঞ্জটির মোট লেনদেনের ১ দশমিক ২২ শতাংশ।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে ডিএসই ব্রোকার্স অ্যাসোসিয়েশনের (ডিবিএ) প্রেসিডেন্ট সাইফুল ইসলাম বলেন, 'ফ্লোর প্রাইস আরোপ করার মাধ্যমে বাংলাদেশের পুঁজিবাজার থেকে বিদেশী বিনিয়োগকারীদের এক প্রকার হটিয়ে দেয়া হয়েছে। এছাড়া আরো বেশকিছু কারণে বিদেশীরা বাংলাদেশের পুঁজিবাজার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে বিনিয়োগ্য শেয়ারের ঘাটতি, মুদ্রা বিনিময় হারে অস্থিরতা এবং তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোয় স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার অভাব। ২০২৩ সালে পুঁজিবাজারে বিদেশীরা যে পরিমাণ লেনদেন করেছেন গত বছরের আগস্ট গণ-অভু্যত্থানের পরে সেটি অনেক বেশি হওয়ার কথা ছিল। শুরুতে কিছুটা হয়েও ছিল। কিন্তু এক্ষেত্রে সমস্যা হচ্ছে বিনিয়োগ করার মতো ভালো শেয়ারের অভাব। ঘুরেফিরে তাদের সেই একই শেয়ারে বিনিয়োগ করতে হচ্ছে এবং কোনো বৈচিত্র্য নেই। ফলে এ পরিস্থিতির পরিবর্তনের জন্য ভালো শেয়ারের তালিকাভুক্তির বিকল্প নেই।'

পুঁজিবাজারে ক্রমান্বয়ে বিদেশীদের নিট পোর্টফোলিও বিনিয়োগের পরিমাণ কমে যাওয়ার পেছনে বেশকিছু কারণকে দায়ী করেছেন বিশ্লেষকেরা। এমএসসিআই ফ্রন্টিয়ার মার্কেট সূচকের রিটার্ন ১০ বছর ধরেই শ্লথ অবস্থানে রয়েছে। এতে ফ্রন্টিয়ার মার্কেট থেকে বিদেশীরা ধীরে ধীরে সরে যাচ্ছেন। এর বিপরীতে ২০০৮ সালের সাব প্রাইম মর্টগেজ সংকটের পর থেকেই যুক্তরাষ্ট্রের পুঁজিবাজারে ঊর্ধ্বমুখিতা দেখা যাচ্ছে। এ কারণে বেশি রিটার্নের আশায় বিদেশী বিনিয়োগকারীরা ফ্রন্টিয়ার মার্কেট থেকে বিনিয়োগ প্রত্যাহার করে যুক্তরাষ্ট্রে যাচ্ছেন। দেশের ব্যাক খাতের দুর্বলতা, তারল্য ঝুঁকি, মুদ্রা বিনিময় হার ঝুঁকির বিষয়গুলোও বিদেশী বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগ সিদ্ধান্তে প্রভাব ফেলেছে। মেয়াদি মিউচুয়াল ফান্ডের মেয়াদ ১০ বছর বাড়ানোর সিদ্ধান্তের কারণেও এ খাতের বিদেশী বিনিয়োগকারীরা অসন্তুষ্ট হয়েছিলেন। এ নিয়ে নিয়ন্ত্রক সংস্থা ও আদালতের দ্বারস্থ হতেও দেখা গেছে তাদের। পর্যাপ্ত ভালো শেয়ারের জোগান না থাকার কারণেও বিদেশীদের কাছে বিনিয়োগের জন্য সুযোগ কম। কভিড-১৯-এর কারণে ২০২০ সালের মার্চে শেয়ার নির্দিষ্ট দরের চেয়ে যাতে কমতে না পারে সেজন্য ফ্লোর প্রাইস নির্ধারণ করে দিয়েছিল বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)। তখন অনেক বিদেশী বিনিয়োগকারী ক্রেতা না থাকার কারণে শেয়ার বিক্রি করতে চেয়েও করতে পারেননি। ব্যাংকের ঋণ ও আমানতের সুদহার নির্ধারণ করে দেয়ার বিষয়টিকেও মুদ্রাবাজারে নিয়ন্ত্রক সংস্থার হস্তক্ষেপ হিসেবে দেখছেন বিদেশীরা। বৈশ্বিকভাবেই মুক্তবাজার অর্থনীতিতে নিয়ন্ত্রক সংস্থার হস্তক্ষেপ গ্রহণযোগ্য নয় বিদেশীদের কাছে। সর্বোপরি সাম্প্রতিক সময়ে ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়নের বিষয়টিও বিদেশীদের এ দেশ থেকে বিনিয়োগ প্রত্যাহারের অন্যতম একটি কারণ।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে