কারও দায়িত্বাধীন থানা হেফাজতে থাকা ট্রাংক ভেঙে এইচএসসি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস। কেউ ঘুস নিয়ে ওসি থেকে এসআই। আবার কেউ ভিডিও ভাইরালের পর থানা ছেড়ে পালালেন! এসব বিষয় নিয়ে গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে চলছে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা।
প্রশ্ন ফাঁসকাণ্ড নওগাঁর ধামইরহাট থানা, ঘুষ গ্রহণের বিভাগীয় মামলায় জয়পুরহাটের আক্কেলপুর থানার অফিসার ইনচার্জ পদে থাকা মাসুদ রানার পদাবনতি (ডিমোসন) ও ক্ষেতলাল থানার নবনিযুক্ত অফিসার ইনচার্জ হাশমত আলীর ভিডিও ভাইরালের ঘটনায় থানা ছেড়ে পালানো এখন টক অব দ্য কান্ট্রি। তবে মাসুদ রানার ডিমোসনের বিষয়টি পজিটিভভাবে দেখছেন সচেতন মহল। তারা বলছেন, এ থেকে অসৎ পুলিশ সদস্যরা শিক্ষা নিয়ে নিজেদের শুধরে নিতে পারবেন। শাস্তির এ ধারা অব্যাহত রেখে জতনার পুলিশ গড়ে তোলার দাবি তাদের।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সম্প্রতি উত্তরের সীমান্তবর্তী জেলা নওগাঁর ধামইরহাট থানা সমালোচনার শীর্ষে রয়েছে। থানা হেফাজতে রক্ষিত প্রশ্নপত্রের ট্রাংক খোলা অবস্থায় পাওয়ার ঘটনায় আলোচনায় আসে এই থানা। গত ১৫ মে নওগাঁ জেলা প্রশাসনের ট্রেজারি থেকে ধামইরহাট থানায় প্রশ্নপত্রের তিনটি ট্রাংক নেয়া হয়। নিয়ম অনুযায়ী থানার ভল্ট বা মালখানায় প্রশ্নপত্র সংরক্ষণের কথা।
কিন্তু রাখা হয় হাজতখানায়। সেখানে রক্ষিত ট্রাংক থেকে বের করা হয় ইতিহাস দ্বিতীয় পত্রের প্রশ্ন। গত ১৯ জুন বিষয়টি জানাজানির পর শুরু হয় তোলপাড়। ঘটনা অনুসন্ধানে পৃথক তিনটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে জেলা প্রশাসন, পুলিশ ও শিক্ষা বোর্ড কর্তৃপক্ষ। ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন রাজশাহী শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যানসহ একটি প্রতিনিধি দল। বাতিল করা হয় প্রশ্নপত্র। আগামী ১৯ জুলাই অনুষ্ঠেয় ইতিহাস দ্বিতীয় পত্রের পরীক্ষাটি বিভাগের আট জেলায় বিকল্প প্রশ্নপত্রে অনুষ্ঠিত হবে।
এ ঘটনায় দায়িত্বে অবহেলার অভিযোগে ধামইরহাট থানার ওসি আব্দুল মালেকসহ ছয় পুলিশ সদস্যকে প্রত্যাহার করে পুলিশ লাইনে সংযুক্ত করা হয়েছে। পুলিশের দাবি- প্রশ্নপত্রের ট্রাংক সিলগালা ও তালাবদ্ধ অবস্থায় ছিল। আসামির এক হাতে হাতকড়া থাকলেও অন্য হাত খোলা ছিল। তিনি নখ দিয়ে সিলগালা খুলে ফেলেন এবং তালা খোলেন। এরপর প্রশ্নপত্র ছড়িয়ে রাখেন এবং কিছু ছিঁড়ে ফেলেন। সিসিটিভির ফুটেজে এসব দেখা গেছে।
হত্যাকাÐে জড়িত থাকার অভিযোগে গ্রেপ্তার থানা হাজতে থাকা যে ব্যক্তি প্রশ্নপত্রের ট্রাংক খোলেন; সরকারি সম্পদ বিনষ্টের অভিযোগে ওই আসামির বিরুদ্ধে নতুন একটি মামলা করেছে ধামইরহাট থানা পুলিশ। আদালতের মাধ্যমে তাকে কারাগারে পাঠানো হয়েছে বলে গণমাধ্যমে বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (পত্নীতলা সার্কেল) শরিফুল ইসলাম। এদিকে, ঘুষকাণ্ড নওগাঁর পাশর্^বর্তী জয়পুরহাটের আক্কেলপুর থানার ওসির (পরিদর্শক) পদে থাকা মাসুদ রানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) পদে ডিমোসনের বিষয়টিও রয়েছে আলোচনায়।
২০১৮ সালে রংপুর ডিবিতে কর্মরত থাকাকালিন জেলার পীরগঞ্জ থানার একটি হত্যা মামলায় ঘুসগ্রহণ ও ক্ষমতার অপব্যবহার সংক্রান্ত বিভাগীয় মামলায় তাকে আগামী তিন বছরের জন্য এই দÐ দেয়া হয়েছে। জয়পুরহাট পুলিশ সুপারের কার্যালয়ে এ সংক্রান্ত পত্র আসার পর মাসুদ রানাকে গত ২৪ জুন থানার ওসির পদ থেকে প্রত্যাহার করে নেয়া হয়। এর আগে গত ৮ মার্চ ওসি হিসেবে তাকে আক্কেলপুর থানায় পদায়ন করা হয়।
অপরদিকে, ভাইরালকাণ্ড আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছেন ক্ষেতলাল থানার অফিসার ইনচার্জ হাশমত আলী। জামায়াত-শিবিরের মিছিলে নেতা-কর্মীদের লাঠিপেটার একটি ভিডিও সম্প্রতি ফেসবুকে ভাইরাল হলে গত ২৫ জুন গোপনে থানা ছেড়ে চলে যাওয়ার ঘটনায় আলোচনায় আসেন তিনি। এরপর এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে ওসি হাশমত আলী থানা ছেড়ে পালিয়েছেন।
ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়া ভিডিওতে দেখা যায়, জয়পুরহাট সদরে জামায়াত নেতা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর মুক্তির দাবিতে আয়োজিত মিছিলে জামায়াত-শিবিরের নেতাকর্মীর ওপর লাঠিচার্জ করছে পুলিশ। তাদের মধ্যে ক্ষেতলাল থানার নবাগত ওসি হাশমত আলীকেও লাঠিচার্জ করতে দেখা যায়।
সেসময় তিনি জয়পুরহাট সদর থানা পুলিশের উপ-পরিদর্শক (এসআই) হিসেবে কর্মরত ছিলেন। ওই ভিডিওটি ২০১২ সালের নভেম্বরের। ঘটনার ১৩ বছর পর গত ১৩ জুন হাশমত আলী ক্ষেতলাল থানার ওসি হিসেবে যোগ দেন। অভিযোগ রয়েছে- মিছিলকারীদের ওপর আক্রমণের সময় সামনের সারিতে ছিলেন তৎকালীন এসআই হাশমত আলী। তার লাঠির আঘাতে গুরুতর আহত হন জামায়াতের নেতা অধ্যাপক নজরুল ইসলামসহ অনেকেই। সেদিন এসআই হাশমতের গুলিতে শিবিরের সাথী বদিউজ্জামান নিহত হন বলে অভিযোগ জামায়াতের।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, ২০২৪ এর জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানে হাশমত আলী নওগাঁ জেলা গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) ওসির দায়িত্বে ছিলেন। সেসময় ছাত্র-জনতার আন্দোলন দমনে সামনের সারিতে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। ছাত্র-জনতার ওপর গুলি চালানোর চেষ্টাও করেছিলেন। তবে নওগাঁ জেলা পুলিশের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা তাকে গুলি না চালানোর নির্দেশ দিলে বন্দুকের ট্রিগার চাপতে পারেননি তিনি। এরপর ছাত্র জনতার গণঅভ্যুত্থান সফল হলে জেলার গুরুত্বপূর্ণ মহাদেবপুর থানায় তাকে ওসি হিসেবে ২০২৪ সালের ১৫ সেপ্টম্বর পদায়ন করা হয়।
এখানে যোগদানের পর আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠেন তিনি। স্থানীয় কয়েকজন নেতার সহযোগিতায় গড়ে তোলেন একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট। সিন্ডিকেটের সদস্যরা থানা চত্বরে মিনি আদালত বসিয়ে বিচার বাণিজ্য, মাদক ব্যবসায়ীদের থেকে কমিশন আদায়, নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগ ও অঙ্গ সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীদের গ্রেপ্তারের ভয় দেখিয়ে অর্থ আদায়; মাদকসহ মোটরসাইকেল আটকের পর থানায় মামলা রেকর্ড না করে টাকার বিনিময়ে মাদক ব্যবসায়ীকে মোটরসাইকেল ফিরিয়ে দেয়াসহ নানা অপকর্ম চালিয়ে যেতে থাকেন এ চক্রের সদস্যরা।
এসব ঘটনা জনাজানি হলে মহাদেবপুর থানার ওসির পদ থেকে ২০২৫ সালের ১ মার্চ হাশমত আলীকে প্রত্যাহার করে নওগাঁ পুলিশ সুপারের কার্যালয়ে বদলি করা হয়।
হাশমত আলীকে খুঁজে না পাওয়ায় এসব অভিযোগের ব্যাপারে তার বক্তব্য পাওয়া যায়নি। এ বিষয়ে গণমাধ্যমে জয়পুরহাটের পুলিশ সুপার মুহাম্মদ আবদুল ওয়াহাব বলেন, ওসি হাশমত আলীকে প্রত্যাহার করে পুলিশ লাইনসে সংযুক্ত করা হয়েছে। জয়পুরহাট সদর থানায় এসআই পদে কর্মরত থাকাকালীন জামায়াতের মিছিলে তার লাঠিপেটার একটি ভিডিও ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়ার পর এই ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। আক্কেলপুর থানার অফিসার ইনচার্জ পদে থাকা মাসুদ রানার বিষয়ে পুলিশ সুপার বলেন, অনেক আগের একটি বিভাগীয় মামলা ছিল।
সেটার শাস্তি হয়েছে। আর কিছু নয়। ধামইরহাট থানার প্রশ্ন ফাঁসকাÐে জানতে চাইলে নওগাঁর জেলা প্রশাসক ও জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মোহাম্মদ আব্দুল আউয়াল বলেন, তদন্ত কমিটির সদস্যরা তার নিকট তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিয়েছেন। তিনি তা যথাযথ কর্তৃপক্ষ বরাবর প্রেরণ করেছেন। সংশ্লিষ্টরা নিয়ম অনুযায়ী আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন।
রাজশাহী শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক আ ন ম মোফাখখারুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, থানার ভল্ট বা মালখানায় প্রশ্নপত্র সংরক্ষণের কথা। কিন্তু সেগুলো হাজতে রাখা এবং সেখানে আসামি থাকার বিষয়টি কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। পুলিশকে এ বিষয়ে ব্যাখ্যা দিতে হবে।