সিলেটের গোলাপগঞ্জের মৃৎশিল্প প্রযুক্তি আর বিশ্বায়নের যুগে হারিয়ে যেতে বসেছে। হারিয়ে যেতে বসেছে বাংলার ইতিহাস ঐতিহ্য সংস্কৃতির অনেক কিছু। পর্যাপ্ত সংরক্ষণ ও রক্ষণাবেক্ষনের অভাবে আধুনিক বিশ্বের কাছে আমাদের এই শিল্প অনেকটাই এখন অচেনা ও অপরিচিত। কিছু বছর আগেও এই মৃৎশিল্প কিংবা মৃৎশিল্পীদের তৈরী মাটির তৈজসপত্রের যেমন চাহিদা ছিলো, তেমনি এর কদর ছিল দেশ ছাড়িয়ে বিদেশেও। এককালে রাত দিন নিরলস পরিশ্রমের মাধ্যমে ব্যস্ত সময় পার করতেন এই মৃৎশিল্পীরা। কিন্তু সময়ের বিবর্তনে আর কালের পরিক্রমায় প্রযুক্তির কাছে যেনো হার মানতে হচ্ছে এই নিম্নআয়ের মানুষদের। ফলে যুগের পরিবর্তনের সাথে সাথে বাংলা হারাচ্ছে তার অনেক পুরনো সংস্কৃতি ও সভ্যতা।
গোলাপগঞ্জ উপজেলার পৌরসভাধীন কুমারপাড়ার মৃৎশিল্পীরা এখন অনেটাই অলস সময় পার করতেছেন। যুগ যুগ ধরে তাদের পূর্বপুরুষরা যে পেশায় নিয়োজিত ছিল কালের আবর্তে তা ¤øান। পূর্বপুরুষদের পেশাকে পরিবর্তন করে বিভিন্ন পেশার আশ্রয় নিয়ে জীবিকা নির্বাহ করতে হচ্ছে। দু/একটি পরিবার ছাড়া কোন বাড়িতেই এখন মাটির তৈজসপত্র দেখা যায়না বা কুমোর বাড়ির সেই চাকা ঘুরেনা। যে দু/একটি বাড়িতে এখনও হাড়ি পাঁতিল তৈরী হয়, তারাও এখন অনেকটা দায় পড়ে কাজ করছেন এমনটাই বললেন স্থানীয় এক মৃৎশিল্পী। মাটিকে চাকার মাধ্যমে উপকরণ হিসেবে নিয়ে হাতের ভালোবাসা ও শৈল্পিকতার মাধ্যমে বিভিন্ন আকর্ষনিয় খেলনা বা নিত্য পণ্যের আকৃতি দান করছেন। কথা হলো কুমোরপাড়ার বাসিন্দা বিশ্ব পাল এর সাথে তিনি বলেন বাপ দাদার আমল থেকে আমরা এই পেশায় নিয়োজিত। আমরা যখন ছোট ছিলাম তখন দেখতাম এই পেশার রমরমা ব্যবসা ছিলো। পার্শ্ববর্তী বিল থেকে মাটি সংগ্রহ করে সেই মাটিকে প্রথমে মাড়িয়ে নেয়া হত। এবং পরে চাকা ঘুরিয়ে খেলনা, হাড়ি, পাতিল, থালা, বাটিসহ নানা পণ্য সামগ্রী তৈরী করে রোদে শুকিয়ে রাতে আবার সেগুলো (পৈন) আগুনে পুড়ানো হতো। পরের দিন আবার সেগুলো নেওয়ার জন্য দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বড় বড় আড়ৎদাররা আসত। এখন আর সেরকম ব্যবসা নেই, বড় কোন অর্ডারও আসেনা।
পূর্ব পুরুষের এই পেশাটি এখন ধরে রাখাই আমাদের অনেকটা কষ্টসাধ্য হয়ে দাড়িয়েছে। তিনি বলেন, আমরা এখানে প্রায় পয়ত্রিশটি পরিবার আছি। সবাই একসময় এই পেশায় নিয়োজিত ছিলাম, কিন্তু এখন অনেকেই এই পেশা ছেড়ে অন্য পেশায় যোগ দিচ্ছেন কারন এই পেশায় যারা আছেন তাদের অনেকেরই এখন নুন আনতে পানতা ফুরাচ্ছে। আগে পহেলা বৈশাখ ও পৌষ সংক্রান্তিতে অনেক মাল বিক্রি করতাম। বিভিন্ন মেলায় ও নিয়ে যাওয়া হতো, অনেক চাহিদা ছিলো কিন্তু এখন মেলায় ও আর আগের মতো পণ্য বিক্রি হয় না। পূর্ব পুরুষের এই পেশাটি অনেকের সাথে আমাদেরও প্রায় ছাড়ার উপক্রম। সিরামিক, মেলামাইন ও প্লাস্টিকের ভীড়ে হারিয়ে যাচ্ছে এই শিল্প।
পুতুল পাল, পরেশ পাল, রসেন্দ্র পাল সহ অনেকের সাথে কথা হলে তারা বলেন, আমরা জীবনের সায়াহ্ন কালে এসে দাঁড়িয়েছি, আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম এই পেশায় থাকলে না খেয়ে মরবে। সুতরাং দেশের উন্নয়ন হচ্ছে, দেশ এগিয়ে যাচ্ছে, ভালো কথা সেটা আমরাও চাই কিন্তু আমাদের বাদ দিয়ে-তা হয়না। আমরা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে অনুরোধ জানাবো আমাদের দিকে একটু দৃষ্টি দেওয়ার জন্য। যাতে করে এই শিল্প বা বাংলার সংস্কৃতি পরবর্তী প্রজন্মের কাছ থেকে চিরতরে বিলীন হয়ে না যায়। সরকারের পৃষ্ঠপুষকতায় ও স্থানীয় প্রশাসনের আন্তরিতায় রক্ষা পেতে পারে এই শিল্প।
যাযাদি/ সোহেল