সোমবার, ০৭ অক্টোবর ২০২৪, ২২ আশ্বিন ১৪৩১

রাতে সুবাস ছড়িয়ে ভোরে বেদনা বুকে ঝরে শিউলি

এস.এম.দেলোয়ার হোসাইন, শিবচর (মাদারীপুর)
  ১২ নভেম্বর ২০২৩, ১৩:৪৯
রাতে সুবাস ছড়িয়ে ভোরে বেদনা বুকে ঝরে শিউলি

শরৎ গিয়ে প্রকৃতিতে বিরাজ করছে হেমন্ত। তবুও চারপাশে তার রাজত্ব। বলছি সাদা বসন আর জাফরান রঙে মোড়া শুভ্রকুমারী শিউলির কথা। অতি সাধারণ এক ফুল শিউলি। রাতের আঁধারে নিজের রূপ পুরোটা ছড়িয়ে, বাতাসে বিলিয়ে দেয় নেশা লাগানো সুবাস। আর ভোরের আলো ফুটলেই ঝরে পড়ে সাদা-কমলা গালিচা তৈরি করে। কার সঙ্গে যেন অভিমান কিংবা লুকোচুরি করে এই শিউলি।

শিশির ভেজা সকালে ঝরে থাকা শিউলি ফুলের অপূর্ব দৃশ্য গ্রামের পথে প্রান্তরে ও বসতবাড়িতে প্রায় দেখা যায়। এই ফুলের সৌন্দর্য আর মিষ্টি ঘ্রাণে বাগান, উন্মুক্ত স্থান ও বসতবাড়ির আঙিনা মেতে ওঠে।

বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কিংবা জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামও কিন্তু মুগ্ধ হয়েছেন এই শিউলির রূপে। ‘শেফালী বনের মনের কামনা’, ‘শিউলি ফুল, শিউলি ফুল, কেমন ভুল, এমন ভুল’, ‘শরৎ, তোমার অরুণ আলোর অঞ্জলি...শিউলি বনের বুক যে ওঠে আন্দোলি’, ‘শিউলি বনের উদাস বায়ু পড়ে থাকে তরুতলে’—এ গানগুলোতে রবি ঠাকুর শিউলির কথা বলেছেন বারবার যা মুগ্ধ করেছে সবাইকে।

নজরুল এই শিউলির রূপে মুগ্ধ হয়েই লিখেছেন, ‘শিউলি তলায় ভোর বেলায় কুসুম কুড়ায় পল্লী-বালা।’ আবার নিজের বুকের হাহাকারের কথা প্রকাশ করতে আশ্রয় নিয়েছেন শিউলির। লিখেছেন, শিউলি ফুলের মালা দোলে শারদ-রাতের বুকে ঐ / এমন রাতে একলা জাগি সাথে জাগার সাথী কই...’।

আগে যত্রতত্র শিউলি গাছ দেখা গেলেও নগর সভ্যতার কারণে এখন আর তেমনটি চোখে পড়ে না। শিউলি ফুল হারিয়ে যেতে বসেছে। নতুন করে এখন আর যত্ন করে শিউলি গাছ কেউ বুনে না। তবুও অনাদর-অবহেলায় বেড়ে ওঠা শিউলি ফুলের গাছ চোখে পড়ে মাঝেমধ্যেই। তাইতো এখনো শিউলিতলায় ভোরবেলায় পল্লী বালিকারা ফুল কুড়াতে ভিড় জমায়।

জানা যায়, শিউলির ভেষজ গুণও অনন্য। স্বাদে তিতা হলেও মৌসুমি জ্বর, গলা বসা, ক্রিমি, জন্ডিস ও খাদ্যে বিষক্রিয়াজনিত সমস্যায় দু-তিন চামচ পাতার রস সেবন উপকারী। এ ছাড়া অতীতে খাবারের রং হিসেবে শিউলি বোঁটার ব্যবহার ছিল। শিউলি এই উপমহাদেশেরই নিজস্ব উদ্ভিদ। আদি নিবাস মধ্য ও উত্তর ভারতে। বৈজ্ঞানিক নাম Nyctanthes arbortristis। তেমন বড় নয়। ডালপালা প্রচুর। বাকল পুরু, ফ্যাকাশে রঙের। সরু শাখার দুই পাশে বিপরীত দিকে ঘন পাতার বিন্যাস। পাতা একটু খসখসে। কিনার খাঁজকাটা ও ডগা সরু। শীতে ও বসন্তে পাতা ঝরে যায়। গ্রীষ্মে নতুন পাতায় শাখা ভরে ওঠে। ফুল ফোটা শুরু হয় শরতের প্রথম থেকে। তবে হেমন্তও এই ফুল ফোটে, ঝরে। কার্তিকের প্রথম দিকে ফুল কিছুটা কম হয়, তবে মাসের শেষ দিকে ফুলের সংখ্যা বাড়ে। শিউলির অন্য নাম শেফালি। এই দুটো নাম বারবার এসেছে রবীন্দ্রনাথের গান ও কবিতায়।

উপজেলার উমেদপুর ইউনিয়নের তনয় রায়দের বাড়িতে গিয়ে শিউলি ফুলের গাছে অপরূপ দৃশ্য মিলে। তিনি বলেন, ‘আমাদের বাড়িতে একটি বড় পুরাতন শিউলি ফুলের গাছ আছে। প্রচুর ফুল ফুটে। প্রতিদিন সকালে উঠে শিউলি গাছের নিচে এসে দাঁড়াই। শিশুরা দল বেঁধে শিউলি কুড়ায়। এ দৃশ্য দেখে মনটা ভালো হয়ে যায়। এই ফুল আমরা ও আশপাশের সনাতন ধর্মাবলম্বীরা পূজা-অর্চনায়ও ব্যবহার করেন। এবং সকালে সনাতন ধর্মের মেয়েরা ফুল নিতে আসে।

সাংবাদিক অপূর্ব জয় রায় বলেন, ‘শরৎ বিদায় নিলেও ফুলটিকে উপহার হিসেবে হেমন্তের কাছে রেখে গেছে। হেমন্ত মানেই প্রভাতের শিশিরভেজা শিউলি, ঝিরিঝিরি বাতাসে দোল খাওয়া ধবধবে কাশবন, পদ্ম-শাপলা-শালুকে আচ্ছন্ন জলাভূমি। গাছে গাছে শিউলি ফোটার দিন। আমরাও ছোটবেলায় শিউলি কুড়িয়ে মালা গাঁথতাম।’

শিউলি নিয়ে পুরাণে রয়েছে বিষণ্ণ কাহিনী। রাজকুমারী পারিজাতিকা একবার সূর্যের প্রেমে পড়েছিলেন কিন্তু শত চেষ্টা করেও রাজকুমারী সূর্যকে পেতে ব্যর্থ হন। তারপর এই ব্যর্থতাকে মেনে নিতে না পেরে প্রবঞ্চিত রাজকন্যা হলেন আত্মঘাতী। তার চিতা ভস্ম থেকে জন্মাল একটি গাছ। আর সেই গাছেই তার বেদনা ফুটল শুভ্র ফুল হয়ে। রাতের নিভৃতে। সূর্যের আলোর স্পর্শ পাওয়ার আগেই গেল ঝরে। সেই হলো শিউলি ফুল। উজ্জ্বল কমলাবৃন্তের ওপর সাজানো তুষার শুভ্র পাপড়ির চোখজুড়ানো স্নিগ্ধ রূপ আর মনে প্রশান্তি আনা সৌরভের জন্য শিউলি ফুল কেবল প্রিয়ই নয়, আদরণীয় হয়ে আছে ছেলে-বুড়ো সবার কাছে। তবে ব্যর্থ প্রেমিক যুগলদের কাছেও তার কদর কম নয়।

পুরাণের সে স্বর্গের ফুল হোক কিংবা রাজকন্যা পারিজাতের পরাজিত প্রেম— শিউলির প্রতি আমাদের ভালোবাসা থাকবে সবসময়। হয়তো কোনো নারী শিউলির মালা গুঁজে দেবেন খোঁপায় কিংবা কোনো তরুণ খুব ভোরে শিউলি কুড়াবে প্রিয়তমার জন্য।

যাযাদি/ এস

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে