বৃহস্পতিবার, ১২ জুন ২০২৫, ২৯ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি যে কারণে পতন হয়েছিল

যাযাদি ডেস্ক
  ১০ জুন ২০২৫, ১৭:১০
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি যে কারণে পতন হয়েছিল
ছবি: সংগৃহীত

দীর্ঘ আড়াই শতাব্দীর ঔপনিবেশিক শাসন এবং বাণিজ্যিক একাধিপত্যের পর অবশেষে ইতিহাসের পাতায় স্থান করে নিলো ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। একদা অপ্রতিরোধ্য এই শক্তির পতন ছিল সুদূরপ্রসারী, যার কারণ নিহিত ছিল একাধিক অভ্যন্তরীণ দুর্বলতা, ক্রমবর্ধমান দুর্নীতি, এবং ভারতীয় জনগণের তীব্র প্রতিরোধের মধ্যে।

সূচনা ও উত্থান

1

১৬০০ সালে প্রতিষ্ঠিত এই কোম্পানি বাণিজ্যিক উদ্দেশ্য নিয়ে ভারতে প্রবেশ করলেও, খুব দ্রুতই তারা রাজনৈতিক ও সামরিক শক্তিতে পরিণত হয়। ১৭৫৭ সালের পলাশীর যুদ্ধ এবং ১৭৬৪ সালের বক্সারের যুদ্ধের মাধ্যমে তারা বাংলায় নিজেদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে এবং ধীরে ধীরে ভারতের বিশাল অংশে নিজেদের শাসন বিস্তার করে। তাদের মূল উদ্দেশ্য ছিল ভারতীয় সম্পদ শোষণ করে ব্রিটেনে পাঠানো, যা ব্রিটেনের শিল্প বিপ্লবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

পতনের মূল কারণসমূহ.........................

দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনা: কোম্পানির কর্মচারীদের মধ্যে ব্যাপক দুর্নীতি ছড়িয়ে পড়েছিল। ব্যক্তিগত লাভের জন্য তারা কোম্পানির স্বার্থ ক্ষুণ্ণ করত, যা কোম্পানির আর্থিক মেরুদণ্ড ভেঙে দেয়। এই দুর্নীতির ফলে কোম্পানি ক্রমাগত লোকসানের সম্মুখীন হয় এবং ব্রিটিশ সরকারের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে।

ভারতীয় প্রতিরোধ ও বিদ্রোহ: কোম্পানির শোষণমূলক নীতি এবং নির্মম শাসনের বিরুদ্ধে ভারতীয় জনগণের মধ্যে অসন্তোষ বাড়তে থাকে। ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহ, যা ভারতীয় ইতিহাসে প্রথম স্বাধীনতা যুদ্ধ নামেও পরিচিত, কোম্পানির ভিত্তিকে নড়িয়ে দেয়। যদিও এই বিদ্রোহ দমন করা হয়েছিল, তবে এটি কোম্পানির দুর্বলতা এবং ভারতীয়দের প্রতিরোধের ক্ষমতা প্রমাণ করে।

ব্রিটিশ সরকারের হস্তক্ষেপ: কোম্পানির অব্যবস্থাপনা এবং ভারতে ক্রমবর্ধমান অস্থিরতার কারণে ব্রিটিশ সরকার কোম্পানির উপর নিয়ন্ত্রণ বাড়াতে শুরু করে। ১৭৭৩ সালের রেগুলেটিং অ্যাক্ট এবং ১৭৮৪ সালের পিটস ইন্ডিয়া অ্যাক্টের মাধ্যমে ব্রিটিশ পার্লামেন্ট কোম্পানির কার্যকলাপে হস্তক্ষেপ করে। ১৮১৩ সালের চার্টার অ্যাক্টের মাধ্যমে কোম্পানির বাণিজ্যিক একাধিপত্য সীমিত করা হয় এবং ১৮৩৩ সালের চার্টার অ্যাক্টের মাধ্যমে এর বাণিজ্যিক কার্যক্রম পুরোপুরি বন্ধ করে দেওয়া হয়।

অর্থনৈতিক সঙ্কট: অতিরিক্ত সামরিক ব্যয়, দুর্নীতি এবং প্রশাসনিক অব্যবস্থাপনার কারণে কোম্পানি তীব্র অর্থনৈতিক সঙ্কটে পড়ে। তাদের লাভের পরিমাণ কমে যায় এবং ঋণের বোঝা বাড়তে থাকে।

প্রশাসনিক অদক্ষতা: একটি বাণিজ্যিক সংস্থা হিসেবে যাত্রা শুরু করলেও, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি দ্রুতই একটি বিশাল সাম্রাজ্য পরিচালনা করার দায়িত্ব পায়। কিন্তু তাদের প্রশাসনিক কাঠামো এই বিশাল দায়িত্ব বহনে সক্ষম ছিল না, যার ফলে প্রশাসনিক অদক্ষতা এবং বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়।

পরিণতি: ১৮৫৮ সালে ব্রিটিশ পার্লামেন্ট ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে বিলুপ্ত ঘোষণা করে এবং ভারতের শাসনভার সরাসরি ব্রিটিশ সরকারের অধীনে নিয়ে আসে। এর ফলে ভারতে ব্রিটিশ রাজত্বের সূচনা হয়, যা প্রায় নব্বই বছর স্থায়ী ছিল। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির পতন কেবল একটি বাণিজ্যিক সংস্থার বিলুপ্তি ছিল না, এটি ছিল একটি ঔপনিবেশিক যুগের সমাপ্তি এবং ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা।

এই ঘটনা প্রমাণ করে যে, কেবল সামরিক শক্তি দিয়ে একটি জাতিকে দীর্ঘকাল শোষণ করা সম্ভব নয়, জনগণের প্রতিরোধ এবং অভ্যন্তরীণ দুর্বলতা শেষ পর্যন্ত যে কোনো সাম্রাজ্যের পতন ঘটাতে সক্ষম।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে