দেশের অর্থনীতিকে আরও গতিশীল করতে সেবার সমন্বয় ও প্রযুক্তিনির্ভর আধুনিক বন্দর চান ব্যবসায়ীরা। বন্দর সংশ্লিষ্ট অনেকের দাবি, সক্ষমতার চেয়েও এগিয়েছে চট্টগ্রাম বন্দর। তবে ব্যবহারকারীদের অভিযোগ, বন্দরের সেবায় সমন্বয়ের অভাব রয়েছে। তাই প্রযুক্তিনির্ভরতার পাশাপাশি মাতারবাড়ি সমুদ্রবন্দর ও বে-টার্মিনাল দ্রুত বাস্তবায়নের দাবি তাদের।
দেশের আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যের প্রায় ৯২ শতাংশ কার্যক্রম সম্পন্ন হয় চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে। বাংলাদেশে সমুদ্রপথে পরিবহন করা কনটেইনারের ৯৮ শতাংশ চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে পরিবাহিত হয়। আমদানি-রপ্তানি পণ্যের প্রায় ৯০ শতাংশ পরিবাহিত হয় চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে। আবার রপ্তানি আয়ের ৮০ শতাংশ আসে তৈরি পোশাক থেকে।
এ বিষয়ে ইন্টারন্যাশনাল বিজনেস ফোরাম অব বাংলাদেশের (আইবিএফবি) চট্টগ্রাম চ্যাপ্টারের চেয়ারপারসন এবং তৈরি পোশাক রপ্তানিকারকদের সংগঠন বিজিএমইএ পরিচালক এসএম আবু তৈয়ব বলেন, ‘বন্দর অনেক সময় সক্ষমতার বাইরে গিয়েও পারফর্ম করছে। কিন্তু ব্যবসায়ীরা সেভাবে উপকৃত হচ্ছেন না। কারণ, বন্দর সংশ্লিষ্ট সরকারি প্রতিষ্ঠানসহ ব্যবহারকারীদের সঙ্গে বন্দর কর্তৃপক্ষের সমন্বয়ের ঘাটতি রয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘সরকারি ছুটি, দাবি-দাওয়া নিয়ে নানান সংগঠনের কর্মসূচির কারণে বন্দরের কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হয়, বন্দরে কনটেইনারের জটলা তৈরি হয়। কিন্তু এই আপদকালীন সময়টা কাজে লাগানোর জন্য বন্দরের কোনো পরিকল্পনা নেই। এতে ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। এই সময়টি ব্যবস্থাপনার জন্য আমদানিকারক, রপ্তানিকারক, সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট, শিপিং কোম্পানি, ব্যাংক, বিমা থেকে শুরু করে সব স্টেকহোল্ডারদের নিয়ে একটি কমিটি গঠন করে সিদ্ধান্ত নেওয়া গেলে সবাই উপকৃত হবে, বন্দরও আরও বেশি গতিশীল হবে।’
বর্তমানে চট্টগ্রাম বন্দরে চারটি কনটেইনার টার্মিনাল চালু রয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনালে (এনসিটি) পাঁচটি জাহাজ বার্থিং করা যায়। পাশের চিটাগাং কনটেইনার টার্মিনালে (সিসিটি) তিনটি জাহাজ বার্থিয়ের সুযোগ রয়েছে। একই সঙ্গে পুরোনো জেনারেল কার্গো বার্থ (জেসিবি) হিসেবে ১৩টি জেটি রয়েছে চট্টগ্রাম বন্দর অভ্যন্তরে। গত বছর বন্দরের মোট কনটেইনারের ৪৪ শতাংশ এনসিটি, ১৯ শতাংশ সিসিটি এবং ৩৭ শতাংশ কনটেইনার জেসিবিতে হ্যান্ডলিং হয়েছে।
বন্দরের অর্থায়নে নতুন নির্মিত পতেঙ্গা কনটেইনার টার্মিনাল (পিসিটি) অপারেশনের জন্য গত বছর জুন থেকে সৌদি প্রতিষ্ঠান রেড সি গেটওয়ে টার্মিনাল ইন্টারন্যাশনালকে দেওয়া হয়। এখনো পুরোদমে চালু হয়নি টার্মিনালটি। এনসিটি টার্মিনালটিতে বার্ষিক ১০ লাখ টিইইউ কনটেইনার জাহাজে কনটেইনার ওঠানো-নামানোর সক্ষমতা থাকলেও গত বছর ২০২৪ সালে ১২ লাখ ৮১ হাজার টিইইউ কনটেইনার হ্যান্ডলিং হয়।
বন্দরের বার্থ অপারেটর এভারেস্ট পোর্ট সার্ভিস লিমিটেডের স্বত্বাধিকারী শাহাদাত হোসেন সেলিম বলেন, ‘বন্দরের বর্তমান যে সক্ষমতা, তার সর্বোচ্চ উজাড় করে দিয়ে কাজ চলছে। সব পক্ষই আন্তরিকতা দিয়ে কাজ করছে। বর্তমান বন্দরের সক্ষমতা বাড়ানোর আর সুযোগ নেই। ইচ্ছা করলেই আর বড় জাহাজ চট্টগ্রাম বন্দরের ঢোকানো সম্ভব হবে না। চাইলেও বর্তমান গভীরতাকে আর বাড়ানো যাবে না।’
তিনি বলেন, ‘এ সীমাবদ্ধতা নিয়েই কাজ করতে হবে। তবে ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে আমাদের আরও ৫-৭ বছর আগেই আধুনিক একটি সমুদ্রবন্দর করা প্রয়োজন ছিল, যার ড্রাফট ১২ মিটারের বেশি। তারপরেও বর্তমান মাতারবাড়ি কিংবা বে-টার্মিনালের কাজে যাতে আর কোনো বিলম্ব করা না হয়।’
‘সক্ষমতা নির্ভর করে পণ্য আমদানি-রপ্তানির ওপর। পোশাক শিল্পের প্রবৃদ্ধির ওপরও অনেকটা নির্ভর করে। আমাদের বর্তমানে বছরে ৯ লাখ টিইইউ কনটেইনার খালি চলে যায়। আমাদের রপ্তানি সক্ষমতা বাড়লে এসব কনটেইনার খালি পাঠাতে হতো না।’ বলেন তিনি।
বাংলাদেশ ফ্রেইট ফরোয়ার্ডার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বাফা) সহ-সভাপতি খায়রুল কবির সুজন বলেন, ‘চট্টগ্রাম বন্দর শত বছরের বেশি পুরোনো বন্দর। বন্দরের যে স্থাপনা তাতে নতুন কোনো অবকাঠামো তৈরির সুযোগ নেই। জিসিবিগুলোতে গ্যান্ট্রি ক্রেন সংযোজনের সুযোগও নেই। তাই আমাদের নতুন একটি বন্দর প্রয়োজন।’
তিনি বলেন, ‘আমাদের একটি আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর বন্দর প্রয়োজন। যেটি হবে বিশ্বমানের, যেখানে থাকবে বিশ্বমানের ইক্যুপমেন্ট। এখন নতুন নতুন জাহাজ তৈরি হচ্ছে। এসব জাহাজ হ্যান্ডেলের মতো করেই বন্দর তৈরি করতে হবে। এজন্য নতুন যে মাতারবাড়ি বন্দরের কার্যক্রম হাতে নিয়েছে বন্দর, তাতে যাতে বিষয়গুলোর প্রতিফলন ঘটে এবং নির্ধারিত সময়ের মধ্যে এসব কাজ সম্পন্ন করা হয়।’