ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে গত বছরের আগস্টে পতন হয় আওয়ামী লীগ সরকারের। রিজার্ভে দুর্বলতা, উচ্চমূল্যস্ফীতি, বিনিয়োগে মন্দাসহ নানা সংকটে দেশকে ফেলে চলে যায় বিগত সরকার। এরপর ব্যবসা বাণিজ্যে হামলা, জ্বালানি সংকট, বিনিয়োগ-কর্মসংস্থানে স্থবিরতায় যখন পুরো অর্থনীতি টালমাটাল, তখনই রাজস্ব কর্মীদের ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ বা কঠিন আন্দোলনে অচল হয়ে পড়েছে সারাদেশের ব্যবসা-বাণিজ্য।
সারাদেশে কর ও ভ্যাট আদায় কার্যক্রম বন্ধ আছে। আমদানি পণ্য খালাস হচ্ছে না, জাহাজে উঠছে না রপ্তানিমুখী পণ্য। বন্দরে নেই হাঁকডাকও ব্যস্ততা। শুল্ক-কর আদায় হচ্ছে না। সারাদেশের কর অফিসেও নেই কোনো কার্যক্রম। অর্থবছরের শেষ সময়ে বিপুল অঙ্কের বকেয়া রাজস্ব আদায়ের কথা থাকলেও তাও আদায় হচ্ছে না।
এদিকে দেশের শীর্ষ ব্যবসায়ীরা অবিলম্বে এই সংকটের সমাধান চেয়েছেন। পোশাক খাতের ব্যবসায়ীদের দাবি, রাজস্ব কর্মীদের ‘কমপ্লিট শাটডাউনে’ দিনে অন্তত আড়াই হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে ক্ষতি বাড়তেই থাকবে। তাই সরকারকে দ্রুত আলোচনার মাধ্যমে সংকটের সমাধান করতে হবে।
জানা গেছে, এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদের কেন্দ্রীয় নেতাদের দাবির সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করে গত ২৩ জুন থেকে কর্মবিরতি পালন করছে বেনাপোল কাস্টমস হাউসের কর্মকর্তারা।
গতকাল এক অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ গার্মেন্ট ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিজিএমইএ) সভাপতি মাহমুদ হাসান খান বাবু বলেন, দেশের পোশাক শিল্প হচ্ছে সবচেয়ে বড় খাত। যেখানে রপ্তানি হয় প্রায় ৪০ মিলিয়ন ডলার, আমদানি হয় ২০ মিলিয়ন ডলার। ৬৫ মিলিয়ন ডলার হলো ট্রানজেকশন। এটা যদি কর্মদিবস দিয়ে ভাগ করা হয় তাহলে প্রতিদিন আড়াই হাজার থেকে ২৬০০ কোটি টাকার মতো বলা যাবে না ক্ষতি হচ্ছে এটা ব্যাঘাত হচ্ছে।
বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএমএ) সভাপতি শওকত আজিজ রাসেল বলেন, প্রকৃতপক্ষে আমরা যারা ব্যবসা করি আমাদের এনবিআর, কাস্টমস তাদের সঙ্গে সম্পর্ক রেখে ব্যবসাটা করার চেষ্টা করি। কারণ, বাস্তবতা হলো আমরা তাদের কাছে জিম্মি। ক্ষমতার কন্ট্রোল নিয়ে ঝগড়া হচ্ছে, টাকা-পয়সার বণ্টন নিয়ে ঝগড়া হচ্ছে। মাঝপথে আমরা বিপদগ্রস্ত হচ্ছি। এরা সারাজীবন আমাদের জ্বালিয়েছে, এখন সরকারকে জ্বালাচ্ছে; এখন পুরা জাতিকে জ্বালাবে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আলোচনার মাধ্যমেই এই সমস্যার সমাধান সম্ভব। বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন বলেন, এই কর্মসূচি অর্থনীতির জন্য ব্যাপক ক্ষতিকর। এটা অর্থনীতির শ্বাসনালিকে একেবারে চেপে ধরার মতো। অর্থনীতি শ্বাস নিতে পারবে না। বাণিজ্য না হলে কারখানায় উৎপাদন হবে না, খামারে চাষ হবে না; এমনকি দোকানে পণ্য আসবে না।
এনবিআর বিভক্তির জেরে সংস্থার চেয়ারম্যানকে অপসারণের দাবিতে প্রায় দুই মাস ধরে আন্দোলন করছেন এর কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। গত ১ সপ্তাহ ধরে এনবিআর চেয়ারম্যানের অপসারণের দাবিতে কলমবিরতি কর্মসূচি পালন হচ্ছে। শনিবার প্রথমবারের মতো কমপ্লিট শাটডাউন কর্মসূচি পালন করে। এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদের ব্যানারে তারা সারাদেশে সংস্থার সব কাস্টম হাউস, ভ্যাট কমিশনারেট ও আয়কর অফিসে কর্মবিরতি পালন করেন। এতে কোনো অফিসেই কাজকর্ম হয়নি।
গত ১২ মে মধ্যরাতে এনবিআর বিলুপ্ত করে অধ্যাদেশ জারি করে সরকার। এর বিরুদ্ধে এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদের যৌক্তিক কর্মসূচির ফলে সরকার গত ২৫ মে একটি বিজ্ঞপ্তি জারির মাধ্যমে এনবিআর বিলুপ্ত না করে বরং এটিকে সরকারের একটি স্বতন্ত্র ও বিশেষায়িত বিভাগের মর্যাদায় আরও শক্তিশালী করা, রাজস্ব নীতি প্রণয়ণের লক্ষ্যে আলাদা একটি বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠান গঠন করা এবং প্রয়োজনীয় সব সংশোধনের পূর্ব পর্যন্ত জারি করা অধ্যাদেশটি কার্যকর করা হবে না বলে জানায়। তদপ্রেক্ষিতে ঐক্য পরিষদ একইদিনে তাদের কর্মসূচি প্রত্যাহার করে নেয়।
এরপর কাজে যোগ দিলেও আন্দোলনকারীরা এনবিআর চেয়ারম্যানের পদত্যাগের দাবিতে অটল থাকেন এবং সংস্থার কার্যালয়ে তাকে ‘অবাঞ্ছিত’ ঘোষণা করেন। পরে সেনাবাহিনী ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কড়া নিরাপত্তায় অফিসে ফেরেন এনবিআর চেয়ারম্যান।