বিশ্বব্যাপী সরকারি ঋণ ক্রমেই বেড়ে চলেছে, যা ২০২৪ সালে রেকর্ড ১০২ ট্রিলিয়ন ডলারে পৌঁছে। সরকারি ঋণের এ আকার আগের বছরের তুলনায় ৭ দশমিক ৩৬ শতাংশ বেশি। সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে এসব তথ্য জানিয়ে ইউএন ট্রেড অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (আঙ্কটাড) বলছে, এ ঋণের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ নিয়েছে উন্নয়নশীল দেশগুলো। তাদের বার্ষিক রাজস্বের বড় একটি অংশ ঋণ বাবদ সুদ হিসেবে ব্যয় করতে হচ্ছে। এতে ব্যাহত হচ্ছে মানব উন্নয়ন, স্বাস্থ্য ও শিক্ষার মতো প্রয়োজনীয় খাতে ব্যয় বৃদ্ধি। খবর আরব নিউজ।
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) কয়েক মাস আগে পূর্বাভাস দিয়েছিল, ২০২৫ সালে সরকারি ঋণ ২ দশমিক ৮ শতাংশীয় পয়েন্ট বেড়ে বৈশ্বিক জিডিপির ৯৫ শতাংশের ওপরে নিয়ে যাবে।
জাতিসংঘের সংস্থাটির মতে, উন্নয়নের জন্য ঋণ গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে। এর মাধ্যমে সরকারি ব্যয় নির্বাহ, জনগণের জন্য বিনিয়োগ ও উন্নত ভবিষ্যতের পথ তৈরি হয়। তবে সরকারি ঋণ অতিরিক্ত হলে কিংবা সুফল অনুপাতে ব্যয় বেড়ে গেলে এটি কঠিন বোঝা হয়ে দাঁড়ায়।
২০১০ সালের পর থেকে উন্নয়নশীল দেশগুলোর সরকারি ঋণ বৃদ্ধির হার উন্নত অর্থনীতির তুলনায় দ্বিগুণ গতিতে বেড়েছে। আঞ্চলিকভাবে ঋণ বণ্টন অনুযায়ী, বিশ্বের মোট ঋণের ২৪ শতাংশ হিস্যা এশিয়া ও ওশেনিয়া অঞ্চলে, এরপর লাতিন আমেরিকা ও ক্যারিবীয় অঞ্চল ৫ ও আফ্রিকা ২ শতাংশ।
সরকারি ঋণের পরিমাণে দেশভেদে ব্যাপক ব্যবধান দেখা যায়। দেশগুলো কী হারে ও কী মেয়াদে ঋণ নিতে পারছে তার ওপর এটি নির্ভর বলে উল্লেখ করেছে আঙ্কটাড। আন্তর্জাতিক আর্থিক কাঠামোয় বিদ্যমান অসাম্যও একে আরো বাড়িয়ে তোলে।
প্রতিবেদন অনুসারে, বিদেশ থেকে ঋণের কারণে উন্নয়নশীল দেশগুলোর খরচ ক্রমেই বাড়ছে। এসব দেশের অর্ধেকই ২০২৩ সালে রফতানি আয়ের অন্তত ৬ দশমিক ৫ শতাংশ ব্যয় করেছে এ ধরনের ঋণ পরিশোধে। যার পরিমাণ ৪৮৭ বিলিয়ন ডলার। এছাড়া উন্নয়নশীল দেশগুলোর অর্ধেকই রাজস্বের অন্তত ৮ দশমিক ৬ শতাংশ ব্যয় করেছে বিদেশী ঋণ পরিশোধে, যা ২০১০ সালের ৪ দশমিক ৭ শতাংশের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ।
প্রতিবেদনে আরো বলা হচ্ছে, উন্নয়নশীল দেশগুলোয় সরকারি ঋণের সুদ পরিশোধের নিট পরিমাণ ২০২৪ সালে ৯২১ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে, যা আগের বছরের তুলনায় ১০ শতাংশ বেশি। সুদ পরিশোধের এ চাপ আফ্রিকা এবং লাতিন আমেরিকা ও ক্যারিবীয় অঞ্চলে সবচেয়ে প্রকট। গত বছর রেকর্ড ৬১টি উন্নয়নশীল দেশ তাদের মোট রাজস্বের ১০ শতাংশ বা তার বেশি শুধু সুদ পরিশোধে ব্যয় করেছে।
সরকারি ঋণের বাড়বাড়ন্তের কারণে উন্নয়নশীল দেশগুলোয় টানা দ্বিতীয় বছরের মতো সম্পদের নিট বহির্মুখী প্রবাহ দেখেছে। ২০২৩ সালে দেশগুলো নতুন ঋণ থেকে যত অর্থ পেয়েছে তার তুলনায় ২৫ বিলিয়ন ডলার বেশি বিদেশী ঋণ পরিশোধে ব্যয় করেছে। মোট ৫১টি উন্নয়নশীল দেশ ঋণ অর্থায়নে নিট বহির্মুখী প্রবাহের সম্মুখীন হয়েছে, যা ২০১০ সালের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ এবং অধিকাংশ দেশই আফ্রিকা, এশিয়া ও ওশেনিয়া অঞ্চলের।
আঙ্কটাড বলছে, নিট বহির্মুখী প্রবাহের প্রভাব অত্যন্ত উদ্বেগজনক। এর মূল্য দিচ্ছে সাধারণ মানুষ। দীর্ঘস্থায়ী উচ্চ সুদহার, দুর্বল বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধি ও বাড়তে থাকা অনিশ্চয়তা সরকারি ব্যয়ের ওপর সরাসরি আঘাত হানছে। সুদ পরিশোধের হার স্বাস্থ্য ও শিক্ষার মতো গুরুত্বপূর্ণ খাতে ব্যয়ের তুলনায় দ্রুতগতিতে বাড়ছে। সামগ্রিকভাবে প্রায় ৩৪০ কোটি মানুষ এমন দেশে বাস করছে, যেখানে স্বাস্থ্য বা শিক্ষার চেয়ে বেশি অর্থ ব্যয় করা হচ্ছে সরকারি ঋণের সুদ বাবদ।
২০২১-২৩ সালে সুদ পরিশোধে আফ্রিকার দেশগুলো মাথাপিছু ৭০ ডলার ব্যয় করেছে, যা শিক্ষা ব্যয় ৬৩ ডলার ও জনস্বাস্থ্য ব্যয় ৪৪ ডলারকে ছাড়িয়ে গেছে। অন্যদিকে লাতিন আমেরিকা ও ক্যারিবীয় অঞ্চলে মাথাপিছু সুদ ব্যয় ছিল ৩৫৩ ডলার, যা জনস্বাস্থ্যের ৩৮২ ডলার ও শিক্ষা ব্যয় ৪০৩ ডলারের তুলনায় কিছুটা কম।
আঙ্কটাড বলছে, বেশির ভাগ উন্নয়নশীল দেশে ঋণ বাবদ খরচ উন্নত দেশের তুলনায় অনেক বেশি। উন্নয়নশীল অঞ্চলগুলো সাধারণত যুক্তরাষ্ট্রের তুলনায় দুই-চার গুণ বেশি সুদহারে ঋণ নেয়। ফলে অর্থ ফেরত দেয়ার জন্য অনেক বেশি সম্পদ প্রয়োজন হয়, যা উন্নয়নশীল দেশগুলোর পক্ষে বিনিয়োগ এবং ঋণের ভারসাম্য রক্ষাকে কঠিন করে তোলে।
এমন ঝুঁকিপূর্ণ পরিস্থিতিতে আন্তর্জাতিক আর্থিক কাঠামো সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরেছে আঙ্কটাড। তারা বলছে, অর্থনৈতিক ব্যবস্থা আরো অন্তর্ভুক্তিমূলক ও উন্নয়নমুখী হওয়া উচিত। উন্নয়নশীল দেশগুলো যেন সংকটকালে সহজে আরো বেশি তারল্য সহায়তা পায় তা নিশ্চিত করা উচিত। এটি সম্ভব হতে পারে বিশেষ ড্রয়িং রাইটসের (এসডিআর) বেশি ব্যবহার, আইএমএফ সারচার্জ সাময়িক স্থগিত, দেশভিত্তিক কোটার ভিত্তিতে আইএমএফের জরুরি অর্থায়নে প্রবেশাধিকারের বিস্তৃতি এবং আঞ্চলিক আর্থিক ব্যবস্থা ও বিশেষ করে দক্ষিণ গোলার্ধভুক্ত উন্নয়নশীল দেশগুলোর মধ্যে সহযোগিতা বৃদ্ধির মাধ্যমে।