৯ জুন শেষ হতে যাচ্ছে মার্কিন শুল্ক আরোপের ২ মাসের স্থগিত আদেশ। তবে এই শুল্ক হার যেন বাংলাদেশের উপর বাড়তি চাপ তৈরি না করে তার জন্য দফায় দফায় বৈঠক করেছে বাণিজ্য মন্ত্রানালয়ের সচিবসহ বিভিন্ন পদমর্যাদার কর্তারা। চিঠিও দিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা। সর্বশেষ এই সংকট সমাধানে বর্তমানে মার্কিন দেশে রয়েছেন বাণিজ্য উপদেষ্টাও। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা যায়যায়দিনকে জানিয়েছেন বৈঠকে ইতিবাচক সাড়া পাওয়া গেছে। সবকিছু ঠিক থাকলে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই আগের যে শুল্কহার ছিল তাই বহাল থাকবে।
এর আগে যুক্তরাষ্ট্র ‘রেসিপ্রোকাল ট্যারিফ এগ্রিমেন্ট’ নামে একটি চুক্তি স্বাক্ষরের প্রস্তাব দিয়ে তার খসড়া বাংলাদেশকে পাঠিয়েছে। বাংলাদেশও এই খসড়া নিয়ে তাদের মতামত জানিয়েছে। বাণিজ্য মন্ত্রনালয় সূত্র জানায়, খসড়া চুক্তি চূড়ান্ত করতে গত ২৬ জুন ইউএসটিআর এর কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন অন্তর্বর্তী সরকারের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা এবং রোহিঙ্গা সমস্যা বিষয়ক হাই-রিপ্রেজেন্টেটিভ ড. খলিলুর রহমান।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, যুক্তরাষ্ট্র সেখানে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে যুক্তরাষ্ট্রের নিজস্ব আইন বাংলাদেশকে অনুসরণ করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। তবে এতে রাজী না হয়ে ওই খসড়ার উপর বাংলাদেশের মতামত খলিলুর রহমানের কাছে পাঠানো হয়েছে, যা ২৬ জুনের সভায় ইউএসটিআরের কাছে তুলে ধরেছেন খলিলুর রহমান। বানিজ্য সচিব মাহবুর রহমান জানান, বাংলাদেশের ওপর রেসিপ্রোকাল ট্যারিফ সর্বোচ্চ ১০ শতাংশে সীমিত রাখার অনুরোধ করা হয়েছে, যা বর্তমানে কার্যকর রয়েছে।
এদিকে রেসিপ্রোকাল ট্যারিফ সর্বোচ্চ ১০ শতাংশে সীমিত রাখার অনুরোধ জানিয়ে এর বিপরীতে যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানি বাড়ানোর পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। এরই অংশ হিসেবে ইউক্রেন থেকে গম আমদানির প্রাথমিক অনুমোদন বাতিল করে যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানি করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। একইভাবে বোয়িং থেকে উড়োজাহাজ কেনার পরিকল্পনা করছে সরকার। শিগগিরই এ বিষয়ে প্রস্তাব পাঠানো হবে বলেও জানিয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সূত্র। এর বাইরে যুক্তরাষ্ট্র থেকে এলএনজি আমদানি বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছে বর্তমান সরকার। এরই অংশ হিসেবে গত এপ্রিলের পর থেকে এপর্যন্ত স্পট মার্কেট থেকে যে এলএনজি কেনার অনুমোদন দেওয়া হয়েছে, তার বেশিরভাগ নেওয়া হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের কোম্পানি থেকে।
সামগ্রিক বিষয়ে জানতে চাইলে বাণিজ্য সচিব মাহবুবুর রহমান যায়যায়দিনকে বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের ট্যারিফ ইস্যুতে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে সবধরণের ব্যবস্থা গ্রহন করা হয়েছে। ইতিমধ্যেই ওরা একটি খসড়া পাঠিয়েছে তার উপর আমরা মতামত দিয়েছি। যা গত ২৬ তারিখে মার্কিন প্রতিনিধিদের সঙ্গে আমাদের প্রতিনিধি আলোচনা করেছে। ওই আলোচনা প্রথমিক ভাবে আমাদের বেশির ভাগ প্রস্তাব ওরা মেনে নিয়েছে।
তবে কিছু বিষয়ে শুল্ক বৃদ্ধি মার্কিন ট্যারিফ আইনের আওতায় বাড়ানোর কথা জানানো হয়েছে। সেগুলো আমারা দেখছি এসব বিষয় নিয়ে অর্থ-উপদেষ্ঠা যুক্তরাষ্ট্র সফর করবেন। আশাকরি ৩ তারিখে এ বিষয়গুলো নিয়ে অর্থ-উপদেষ্টা মার্কিন প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠক করবেন। সে ক্ষেত্রে আগের যে শুল্কহার ছিল তা বহাল রাখতে অনুরোধ করা হবে। এর বিকল্পও আমরা রেখেছি। আশাকরি আমাদের বিকল্প প্রস্তাবে যুক্তরাষ্ট্র রাজি হবে।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান আগের শুল্কহার অব্যহত রাখতে যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানি বাড়াতে দেশটি থেকে এলএনজি, গম, উড়োজাহাজ, অস্ত্র ও গোলাবারুদ আমদানি করার পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্রের ১৯০টি পণ্যে বাংলাদেশ শুল্ক কমানোর অঙ্গীকার করে ঢাকা। এছাড়া, বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের তুলা রপ্তানি সহজ করতে সেন্ট্রাল বন্ডেড ওয়্যারহাউজ সুবিধা দেওয়ার কথাও জানানো হয়েছে। তবে পুরো বিষয়টি নন-ডিজক্লোজ এগ্রিমেন্ট তাই এবিষয়ে কর্মর্তরা বেশি কিছু বলতে রাজি নন।
এবিষয়ে বাংলাদেশ রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর ভাইস প্রেসিডেন্ট আনোয়ার হোসেন যায়যায়দিনকে বলেন, ‘ আমরা যটুতটুকু জানতে পেরেছি তাতে দু-পক্ষের আলোচনা ইতিবাচক পর্যায়ে রয়েছে। অবশ্যই সরকার এই আলোচনায় দেশের স্বার্থকে সর্বচ্চো গুরুত্ব দিচ্ছে। কিছু বিষয় নিয়ে দ্বিমত রয়েছে আশাকরছি এগুলোও আলোচনার মাধ্যমে সমাধান হবে। তবে নতুন কোন কিছু সংযোজন বা বিয়োজন হলে হলে তা যেন স্টেক হোল্ডার যারা রয়েছেন দেশে তাদের সঙ্গে আলোচনা করে নেওয়া উচিত। বিশেষ করে আরএমজি খাত যুক্তরাষ্ট্রে সর্বচ্চো রপ্তানি করে তাই তাদের প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলোচনা করা প্রয়োজন’।
ইপিবির এই কর্মকর্তার মতে বাংলাদেশের রপ্তানিখাতে যুক্তরাষ্ট্র অন্যতম প্রধান ও গুরুত্বপূর্ন বাজার। এখানে রপ্তানির প্রবৃদ্ধি বেশ ভালো। তাই ভবিষতে এই বাজার আরও সম্প্রসারণ হওয়ার সুযোগ রয়েছে। তাই দেশটির যদি বিশেষ কোন খাতে শুল্কবৃদ্ধির প্রস্তাব দেয় তা বিবেচনায় নিয়ে আলোচনা চালিয়ে যাওয়া উচিত।
অন্যদিকে গার্মেন্ট সেক্টরের ব্যবসায়ীরা বলছেন, রেসিপ্রোকাল ট্যারিফ প্রত্যাহার নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনা কোন পর্যায়ে আছে, সে সম্পর্কে তাদের কিছুই জানানো হচ্ছে না। বাংলাদেশের তৈরি পোশাক প্রস্তুত ও রপ্তানিকারকদের সমিতি (বিজিএমইএ) -এর পক্ষ থেকে যুক্তরাষ্ট্রে লবিস্ট নিয়োগ দেওয়ার জন্য সরকারকে যে প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে, সে বিষয়েও কোন অগ্রগতি জানেন না তারা।
তারা বলেন, ‘সরকার ১২ জুন যে নন-ডিসক্লোজার অ্যাগ্রিমেন্ট স্বাক্ষর স্বাক্ষর করেছে, সেখানে কি আছে তার কিছুই আমরা জানি না। যেহেতু জি-টু-জি (সরকারের সঙ্গে সরকারের) গোপনীয়তার চুক্তি, তাই এ বিষয়ে জানতে চেয়েও কোন উত্তর পাওয়া যাচ্ছে না।
বাংলাদেশ চেম্বার অব ইন্ডাস্ট্রিজ এর সভাপতি আনোয়ার-উল আলম চৌধুরী পারভেজ বলেন, “বিজিএমইএ’র পক্ষ থেকে লবিষ্ট ফার্ম নিয়োগ দিতে সরকারকে প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। যেহেতু ৯ জুলাই ৩৭ শতাংশ শুল্ক স্থগিতাদেশের মেয়াদ শেষ হবে, তাই এ বিষয়ে আমাদের কনসার্ন বাড়ছে। কিন্তু, সরকারের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের আলোচনা কত দূর এগিয়েছে, তার কিছুই আমরা জানি না।”
সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, ২৬ জুন ইউএসটিআরের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠকে যুক্তরাষ্ট্র থেকে বাংলাদেশ আমদানি বাড়ানোর যেসব উদ্যোগ নিয়েছে, সেগুলো বিস্তারিতভাবে তুলে ধরেছেন ড. খলিলুর রহমান। এজন্য সরকার কি কি পরিকল্পনা করছে, সেগুলো তুলে ধরার পাশাপাশি পারস্পরিক আরোপের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের দেওয়া তথ্যে যে ভুল ছিল, সেটিও তুলে ধরেছেন তিনি।
এদিকে বাংলাদেশের উপর বাড়তি শুল্ক আরোপের সময় যুক্তরাষ্ট্র জানায় যে, বাংলাদেশ আমেরিকান পণ্যের উপর ৭৪ শতাংশ শুল্ক আরোপ করে। বাংলাদেশ মনে করে, যুক্তরাষ্ট্রের এই হিসাবে ভুল রয়েছে। এক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের পণ্যের উপর বাংলাদেশের আরোপিত প্রকৃত শুল্কহার আরোপের চিত্র ইউএসটিআর এর সভায় তুলে ধরেছেন খলিলুর রহমান। আগামী অর্থবছরের বাজেটে মার্কিন পণ্য আমদানিতে বাজেটে যেসব পরিবর্তন আনা হয়েছে, সেগুলোও তুলে ধরা হবে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রে ৮৩৬ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছে বাংলাদেশ। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানি হয়েছে ২২১ কোটি ডলারের পণ্য।###