হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (হাবিপ্রবি) দেশের উত্তরাঞ্চলের বৃহৎ একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। শুধু একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নয় দেশের গবেষণা ও উদ্ভাবনের এক অনন্য কেন্দ্র। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যতম একটি ক্লাব হলো হাবিপ্রবি ছায়া জাতিসংঘ। এই সংগঠন কেবল একটি শিক্ষামূলক প্ল্যাটফর্ম নয়, বরং তরুণদের মধ্যে নেতৃত্বের দক্ষতা, কূটনৈতিক চর্চা এবং মানবিক চিন্তাধারা বিকাশের একটি মঞ্চ। তারই আয়োজিত একটি কনফারেন্স এ বিশেষ অতিথি হয়ে এসেছিলেন বিবিসির ১০০ প্রভাবশালী নারীর তালিকায় জায়গা করে নেওয়া কুড়িগ্রামের রিখতা আখতার বানু।
হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ছায়া জাতিসংঘ বরাবরই নিজস্ব মানচিত্রে আলাদা অবস্থান তৈরি করেছে। হাবিপ্রবি ছায়া জাতিসংঘের মূল ইভেন্টগুলোর মধ্যে একটি হলো হাবিপ্রবি আন্তর্জাতিক ছায়া জাতিসংঘ সম্মেলন ২০২৪। এবারের সম্মেলনটি যুবদের সম্পৃক্ততার মাধ্যমে বৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য আইন প্রণয়ন, সামাজিক সমতাকে উন্নীত করা এবং প্রযুক্তিগত একীকরণকে এগিয়ে নেওয়াকে মূল প্রতিপাদ্য বিষয় রেখে গত অক্টোবরের ১৭ থেকে ১৯ তারিখ পর্যন্ত আয়োজন করা হয়। নতুন ভাবনা, নতুন উদ্যোগ এবং বিশ্বমঞ্চের প্রতিচ্ছবি হয়ে তারা প্রতিবার উপহার দেয় অনন্য কিছু। তবে এবারের মূল আকর্ষণ ছিল বাস্তব জীবনের এক সাহসী নায়িকা, মানবিকতার এক জীবন্ত কিংবদন্তি রিখতা আখতার বানু।
রিখতা আখতার বানু এক সংগ্রামী মায়ের প্রতিচ্ছবি। নিজের বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন কন্যাকে যখন স্কুলের শিক্ষকগণ আর পড়াতে চাননি । তিনি অনুভব করেছিলেন এই সংকট শুধুমাত্র তার একার নয়, আরও হাজারো বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুর অভিভাবকেরও। এই সমস্যা সমাধানে তিনি স্থির করলেন তার ‘মনি’র মতো হাজারো মনির জন্য গড়বেন এক বিশেষায়িত স্কুল, যেখান থেকে আর কোনো মনিকে বের করে দেওয়া হবে না বরং আদরে, হাসিতে পড়বে, খেলবে এই নয়নমণিরা। এই উদ্দেশ্যে ২০০৯ সালে ২৬ শতক জমিতে নিজেদের অর্থায়নে দোচালা একটি টিনের ঘর তুলে চারজন শিক্ষক নিয়ে শুরু হয় “রিকতা আখতার বানু (লুত্ফা) বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী স্কুল”। মেয়ের জন্য তৈরি স্কুলে ভর্তি করান মেয়ে তানভীন দৃষ্টি মণিকে। সেই থেকে নানা প্রতিবন্ধকতা ঠেলে ছোট্ট উদ্যোগটি ধীরে ধীরে বিস্তৃতি লাভ করে।
স্বল্প সময়ে বিদ্যালয়ে ৬৩ জন শিক্ষার্থী ভর্তি হয়। প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ২১ জন শিক্ষক-কর্মচারী শিশুদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশে কাজ করছেন। নানা কৌশলে শেখানো হয় পড়ালেখা। পাশাপাশি ফেসিয়াল মাসাজ, স্পিচ থেরাপিসহ নানা থেরাপির মাধ্যমে শিশুদের শারীরিক সমস্যাও সাড়াচ্ছেন শিক্ষক শিক্ষিকাগণ । বর্তমানে যেখানে ৩০০ এরও অধিক বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী শিশু লেখাপড়া করছে । তিনি দেখিয়ে দিয়েছেন কীভাবে ব্যক্তিগত চ্যালেঞ্জকে সমাজের জন্য একটি মাইলফলকে রূপান্তরিত করা সম্ভব। এই অসামান্য গল্প শুধু তার জীবনের নয়; এটি সকল মায়ের লড়াই, ভালোবাসা এবং ত্যাগের প্রতীক। তিনি যেন এক অদম্য সংকল্পের প্রতীক, সৃষ্টিশীলতার মাইলফলক, এবং নিঃস্বার্থ ত্যাগের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।
ছায়া জাতিসংঘ সম্মেলনে অংশগ্রহণ করা শিক্ষার্থীদের সামনে রিখতা আখতার বানুর গল্প তুলে ধরা হয়েছে শুধু একটি প্রদর্শনী হিসেবে নয়, বরং নতুন প্রজন্মকে আত্মবিশ্বাসী, দায়িত্বশীল হতে এবং মানবিকতার প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে উদ্বুদ্ধ করার জন্য বলে জানায় আয়োজকরা।
আয়োজকরা আরো বলেন, প্রতিবন্ধকতাকে জয় করে সমাজের জন্য তার অবদানের সম্মানসরূপ তিনি আজ বিবিসির ১০০ প্রভাবশালী নারীর তালিকায় জায়গা পেয়েছেন। তার এই আনন্দের দিনে তাকে জানাই আন্তরিক অভিনন্দন। রিখতা আখতার বানুর গল্প, তার সাহস এবং তার উদ্যোগ আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে একজন মানুষও সমাজ পরিবর্তনের পথপ্রদর্শক হতে পারে।
যাযাদি/এসএস