রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় (বেরোবি) আবাসিক হলে সিট না দিয়ে ১৬ বছরে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন প্রায় এক কোটি ৭০ লাখ টাকা উত্তোলন করেছে। প্রতি বছর উত্তোলন ১৪ লক্ষ টাকা।
এছাড়া ছাত্র সংসদ না থাকলেও ২০০ টাকা ফি বাবদ ৩৪ লক্ষ টাকা এবং কমন রুম না থাকলেও ১০০ টাকা ফি বাবদ ১৭ লক্ষ টাকা নেওয়া হয়েছে। যেটি এখনো চলমান।
প্রথম বর্ষের ভর্তির পে স্লিপে দেখা যায়, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষে ভর্তির সময় হল সংযুক্তি ফির নামে ১০০০ টাকা করে নেওয়া হয়৷ কিন্তু কাউকেই হলের আবাসিকতা দেওয়া হয় না। পরবর্তীতে হলে সিট পেতে হলে পুনরায় ১০০০ টাকা হল সংযুক্তি ফি দিয়ে হলের আবাসিকতা নিশ্চিত করতে হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ব্যাচ ২০০৮-০৯ সেশন থেকে যা চলমান রয়েছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের সূত্রে জানা যায়, বর্তমান শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় আট হাজার। তার বিপরীতে আবাসিক হল রয়েছে তিনটি। যেখানে শহীদ মুখতার ইলাহী হলে সিট রয়েছে ২৪০ টি বিজয়-২৪ (সাবেক জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান) হলে সিট রয়েছে ৩৫৫টি এবং মেয়েদের একটি মাত্র হল শহীদ ফেলানী (সাবেক বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব) হলের সিট রয়েছে ৩৪২ টি। অর্থাৎ সবমিলিয়ে আবাসিক হলে সিট রয়েছে এক হাজারও কম। বাকি ৭০০০ শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাহিরে মেস কিংবা বাসা ভাড়া নিয়ে থাকেন। এতে চরম মানবেতর জীবনযাপন করেন শিক্ষার্থীরা।
সেন্টার ডিজিটাল ট্রান্সফরমেশন সূত্রে জানা যায়, চলতি বছরে কোটাসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের ২২ বিভাগে শিক্ষার্থী ভর্তি হয়েছে ১৪ শও বেশি। বিশ্ববিদ্যালয় অ্যাকাডেমিক শাখা সূত্রে জানা যায়, এখন পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী ভর্তি হয়েছে ১৭ হাজারেরও বেশি।
হলে সিট না দিয়ে এরকম টাকা নেওয়ায় বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীরা ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন।
শিক্ষার্থীরা বলেন, আবাসিক হলে সিট না দিয়ে ভর্তির সময় এরকম ফি নেওয়া অযৌক্তিক। এ যাবৎকালে যত নেওয়া হয়েছে হাতে কীভাবে ব্যয় হয়েছে সেটিও প্রশাসনের জবাবদিহিতা করা উচিত।
হল সংযুক্তি ফি বিশ্লেষণ করে দেখা যায় সেখানে, আবাসিকতার ভর্তি ফি ২০০, আইডি কার্ড ফি ৫০, মাসিক সিট ভাড়া ২৫০, ক্রীড়া ফি ১০০, সাহিত্য ও সংস্কৃতি ফি ১০০,পত্রিকা ফি ১০০ এবং উন্নয়ন ফি ২০০ টাকা। সব মিলিয়ে ১,০০০ টাকা।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ছাত্র সংসদ, আবাসিক হল যুক্ত ফি ইত্যাদি টাকা নেওয়ার আলাদা অ্যাকাউন্ট তৈরি করা দরকার। সেই অ্যাকাউন্টে এই টাকা গুলো জমা থাকবে। কত টাকা কোন খাতে ব্যয় হবে সেটিরও স্বচ্ছতা থাকতে হবে। কিন্তু আমরা এ যাবৎকালে দেখেছি এই টাকা কোন খাতে কীভাবে ব্যয় হয় তা কেউই জানেন না। ব্যয়ের কোনো রশিদও কারো কাছে নেই।
ফাইন্যান্স এন্ড ব্যাংকিং বিভাগের শিক্ষার্থী হোসেন গাজী বলেন,যে টাকা আমরা একবার দিয়েছি সে টাকা আবার কেন দিব। আমি হলে সিটের জন্য আবেদন করার প্রেক্ষিতে আমার হলে সিট আসে,তারপর আমি যখন হলে উঠার প্রক্রিয়া সম্পর্কে জানতে চাই তখন প্রথমেই বলা হয় ১০০০ টাকা ফ্রি দেওয়া লাগবে,যেটা আমরা প্রথম বর্ষে ভর্তি হওয়ার সময় দিয়ে এসেছি। এখানে আসার পর, নিয়োগ বাণিজ্য নিয়ে অনেক কথা হয়েছে, কিন্তু হল বাণিজ্য নিয়ে কোন কথা হয় না।এ বিষয়ে আমাদের কথা বলা দরকার আমি মনে করি।
বিজয় ২৪ হলের আবাসিক শিক্ষার্থী হেলাল মিয়া বলেন, শতভাগ আবাসিকতা না থাকা স্বত্বেও বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার সময় একবার হল বাবদ এক হাজার টাকা ফি দিতে হয় আবার হলে ওঠার সময় এক হাজার টাকা ফি দিতে হয়।যা অযৌক্তিক এবং অগ্রহণযোগ্য।কারণ সব শিক্ষার্থী হলে আসন পান না কিন্তু টাকা দিতে হয়।
শহীদ মুখতার ইলাহী হলের আবাসিক শিক্ষার্থী খাদিমুল সরদার বলেন, মেস ছেড়ে হলে আসার সময় অনেক নতুন কিছু কেনাকাটা করতে হয়। তার ওপর এই হলে অতিরিক্ত ১০০০ টাকা দেয়া আমাদের জন্য অতিরিক্ত চাপ হয়ে যায়। আর ভর্তির সময় যখন হল সংযুক্তি ফি নিয়েই থাকে, তাহলে আবার নতুন করে টাকা দিয়ে হলে উঠার কোন যৌক্তিকতা দেখি না। তার থেকেও গুরুত্বপূর্ণ যেটা, আমরা শিক্ষার্থীরা জানিই না যে এভাবে দুই দুইবার করে আমাদের কাছ থেকে টাকা নেয়া হচ্ছে। এই টাকা কোথায় যাচ্ছে? আমাদের হলের জন্য কি উন্নয়ন হচ্ছে? সেটাও আমরা জানি না।
বিশ্ববিদ্যালয়ের একাউন্টিং এন্ড ইনফরমেশন সিস্টেমস বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ওমর ফারুক বলেন, যে খাতের জন্য টাকা নেওয়া হয় সেই খাতেই টাকা ব্যয় করা উচিত। শিক্ষার্থী কাছ থেকে এমন কোনো খাত থেকে টাকা আদায় করা উচিত নয় যা তার জন্য বাড়তি চাপ তৈরি করে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অর্থ ও হিসাব দপ্তর পরিচালক প্রফেসর ড.আর এম হাফিজুর রহমান বলেন, হল সংযুক্তি যে ফি নেওয়া হয় সেটি মেয়েদের টাকা মেয়েদের একটি হলে এবং ছেলেদের টাকা দুই হলে ভাগ করে দেওয়া হত। হল প্রশাসন সেই টাকা হলের জন্য ব্যয় করে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজয় ২৪ হলের প্রভোস্ট আমির শরিফ বলেন, প্রথম বর্ষের ভর্তি নিশ্চিতের সময় যে টাকা নেওয়া হয় সেটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন নেয়। আগে হল প্রশাসনকে দেওয়া হত কিনা জানি না। তবে এখন কিছু অংশ হলের জন্য দেওয়া হয় যা হলের উন্নয়নের জন্য ব্যবহার করা হয়।
প্রথম বর্ষেই হল সংযুক্তি ফি দেওয়া হলেও পুনরায় হলে একই টাকা নেওয়া কি যৌক্তিক কিনা জানতে চাইলে তিনি আরও বলেন, আমি আগে জানতাম না হলে আবার এই টাকা নেওয়া হয়। তাই আমি দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে এই টাকা নেওয়া বন্ধ করে দিয়েছি। তবে হলে খোঁজ নিয়ে জানা যায় টাকা এখনো নেওয়া হচ্ছে।
শহীদ মুখতার ইলাহী হলের প্রভোস্ট প্রফেসর ড.মো. কামরুজ্জামান বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় হল সংযুক্তি যে ফি নেয় সেটি ভর্তির আর এইটা হলের জন্য। যেখানে হলের একমাসের অগ্রীম বেতন, উন্নয়ন ফি ইত্যাদি থাকে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান অর্থ ও হিসাব দপ্তর পরিচালক প্রফেসর ড. মো.শাহজামান বলেন, আগে এই টাকা কীভাবে ব্যবহার হত আমার জানাই নাই। ভিসি স্যার আসার পর তিনি হল সংযুক্তি ফি, ছাত্র সংসদ ফি, কমন রুম ফি ইত্যাদির জন্য আলাদা অ্যাকাউন্ট তৈরি করা হয়েছে। আর সেই অনুযায়ী টাকা ব্যয় করা হবে।
এই ব্যাপারে বিশ্ববিদ্যালয় উপাচার্য প্রফেসর ড.মো. শওকাত আলীর সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, আগে কোন খাতে কীভাবে ব্যয় হয়েছে আমার জানা নাই। আমি আসার পর নতুন অ্যাকাউন্ট খুলেছি সেখানে এই টাকা জমা রাখা হয়।