মঙ্গলবার, ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১

চিরভাস্বর সালমান শাহ

মাতিয়ার রাফায়েল
  ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ১০:২১
চিরভাস্বর সালমান শাহ

বাংলাদেশের সিনেমায় একটা নতুন ক্রেজ হয়ে এসেছিলেন সালমান শাহ। তার সামগ্রিক চলন-বলনে আর ফ্যাশন সচেতনতায় এক নতুনত্বের ছোঁয়া লেগেছিল ঢাকাই সিনেমায়। আর এর প্রধান কারিগর ছিলেন সদ্য প্রয়াত বিশিষ্ট চলচ্চিত্র পরিচালক সোহানুর রহমান সোহান। সেই যে আজ থেকে ত্রিশ বছর আগে ১৯৯৩ সালে ঢাকাই ইন্ডাস্ট্রি ‘কেয়ামত থেকে কেয়ামত’ সিনেমায় পেয়েছিল এমন এক তরুণকে যার মধ্য দিয়ে শুধু এক নতুন নায়ক সালমান শাহেরই আবির্ভাব ঘটেনি, পরিচালক হিসেবে সোহানুর রহমান সোহানও তার এই তিন নাম্বার ছবির মধ্য দিয়েই নিজেকে নতুন নির্মাতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে ফেলেন। যিনি শুধু ছবিই নির্মাণ করেননি নতুন নায়ক-নায়িকাও নির্মাণ করতে জানেন- এটারও প্রমাণ দিয়ে গেছেন। আবার এটা এমনই নায়ক সংকটকালে যখন পুরনো প্রতিষ্ঠিত নায়করা একে একে চরিত্রাভিনেতার দিকে ঝুঁকছিলেন নিজ নিজ বয়সের কারণেই। প্রকৃত অর্থে সালমান শাহের যখন আবির্ভাব ঘটে তখন নায়করাজ রাজ্জাকের সোনালি সময়ের গোধূলী লগন। নিজেদের অন্তিম সময় দেখছিলেন সেই সময়ের আরও সব বাঘা বাঘা নায়করাও। প্রথমে গোটা ঢালিউড চিন্তিত হয়ে পড়েছিল রাজ্জাকের বিকল্প নিয়ে। এমন এক যুগ সন্ধিক্ষণেই ঢাকাই সিনেমায় দেখা দিলেন ২০/২১ বছরের তরুণ তুর্কী সালমান শাহ।

সালমান-মৌসুমী জুটি বেঁধে অভিনয় করলেন ‘কেয়ামত থেকে কেয়ামত’ ছবিতে। ছবিটির পরিচালক সোহানুর রহমান সোহানের হাত ধরে আসা সালমান শাহকে সেই থেকে একবারের জন্যও আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। ভক্তরাও দেখলেন তার মধ্যে নায়করাজ রাজ্জাকের প্রতিচ্ছবি। সেজন্য রাজ্জাক যেখানে ‘নায়করাজ’ সেখানে সালমান শাহ তার ভক্তদের কাছে হয়ে ওঠলেন ঢাকাই চলচ্চিত্রের ‘রাজপুত্র’। চিত্রপরিচালক হিসেবে সোহানুর রহমান সোহানও ছিলেন পাকা জহুরীমতো। তিনি শুধু ঢাকাই চলচ্চিত্রে সালমান শাহের মতো যুগসন্ধিক্ষণের নায়কই উপহার দেননি মৌসুমীর মতো প্রিয়দর্শিনী নায়িকাও উপহার দিয়েছিলেন। উপহার দিয়েছেন আজকের শাকিব খানকেও। বাংলাদেশের চলচ্চিত্র নতুন মুখ উপহার দেওয়ার ক্ষেত্রে তার আগে যিনি সবচেয়ে সফল তিনি এহ্তেশাম। তবে তিনি নতুন নায়িকাই বেশি উপহার দিয়েছিলেন। সোহানুর রহমান সোহান নায়ক-নায়িকা দুটোই।

তবে সোহানুর রহমান সোহানের এই আবিষ্কারের মধ্যে নিঃসন্দেহে সালমান শাহই এখনো পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি দর্শকপ্রিয় হয়ে আছেন। শুরু থেকেই তার জয়রথ যেভাবে ছুটছিল অনেকেই মনে করছিলেন জনপ্রিয়তার দিক থেকে তিনি নায়করাজ রাজ্জাককেও পেছনে ফেলতে পারেন। সেটা সম্ভব ছিল বলেই মৃত্যুর দুই যুগ পেরিয়ে যাওয়ার পরও তার আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তা ও আবেদন তার জীবদ্দশাকালীন সমান রয়ে গেছে। শুধু তাই নয় প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে আরও অনেক বেশি রঙিন হচ্ছে তাকে নিয়ে ভালোবাসার রং।

আমেরিকায় অকাল প্রয়াত হয়েছিলেন মেরিলিন মনরো। কিন্তু ভক্তের হৃদয়ে আজও চিরসবুজ হয়ে ধরা দেন তিনি তার প্রতিটি জন্ম ও মৃত্যুবার্ষিকীতে। বাংলাদেশে সালমান শাহও যেন সে রকমই একটি আবেদনময়ী নাম। এখনও ছোটপর্দায় তার অভিনীত ছবি প্রচার হলে দর্শক বিশেষ আগ্রহ নিয়ে দেখেন। ১৯৯৬ সালের ৬ সেপ্টেম্বর আকস্মিক মৃত্যুর আগ পর্যন্ত করা ক্ষণজন্মা এই নায়ক রেখে গেছেন ২৭টি চলচ্চিত্র এবং অগণিত ভক্ত। এই অর্জন তার চলচ্চিত্র জীবনের মাত্র চার বছরের। ঢাকাই চলচ্চিত্রে তো বটেই উপমহাদেশের চলচ্চিত্রে এতো সংক্ষিপ্ততম সময়ের মধ্যে এতগুলো জনপ্রিয় চলচ্চিত্র আর কারও ভাগ্যেই ঘটেনি। নব্বইয়ের দশকে রুপালি পর্দায় অবির্ভূত সালমান শাহ তার অভিনয়ের মধ্য দিয়ে হয়ে উঠেছিলেন কোটি তরুণ-তরুণীর স্বপ্নের নায়ক। কেউ তার মৃত্যুতে আত্মহত্যাও করেছেন আবার কেউ হয়ে গেছেন হঠাৎ উন্মাদের মতো নিরুদ্দেশ। সালমান শাহ এমন সময়ে ঢাকাই চলচ্চিত্রে আবির্ভূত হন যখন ঢাকাই চলচ্চিত্রের রুগ্নদশার শুরু। যে রুগ্নদশা দেখে সবাই বলছিলেন ঢাকাই চলচ্চিত্র মরে গেছে। ঢাকাই চলচ্চিত্র ডেড। সে রকম একটা দুঃসময়ে সময়ে আবির্ভূত হয়েই এক বিশাল সাফল্য দিয়ে সালমান শাহ যেন ফের প্রাণসঞ্চার করলেন মৃতপ্রায় ঢাকাই চলচ্চিত্রে। তারপর শুধুই ইতিহাস। কেউ কেউ বলে থাকেন, সালমানের মতো জনপ্রিয় নায়ক হয়তো আর কখনোই কোনো দিন জন্মাবে না এই ইন্ডাস্ট্রিতে।

আজ সেই অমর নায়কের জন্মদিন। ১৯৭১ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর সিলেটের জকিগঞ্জ উপজেলায় জন্মগ্রহণ করেন সালমান শাহ। বেঁচে থাকলে আজ তিনি ৫৩ পেরিয়ে ৫৪ বছরে পা রাখতেন। বাবা কমর উদ্দিন চৌধুরী এবং মা নীলা চৌধুরী। তিনি ছিলেন পরিবারের বড় ছেলে। সালমানের জন্মনাম শাহরিয়ার চৌধুরী ইমন। আর চলচ্চিত্রের মধ্য দিয়ে হয়ে গেলেন তিনি সবার কাছে সালমান শাহ।

সালমান শাহ পড়াশোনা করেন খুলনার বয়রা মডেল হাইস্কুলে। ওই স্কুলে চিত্রনায়িকা মৌসুমী তার সহপাঠী ছিলেন। নিয়তির কী লিখন! দীর্ঘদিনের বিচ্ছিন্ন এই দুই সহপাঠী পরে ১৯৯৩ সালে একই সঙ্গে একই চলচ্চিত্রে অভিষিক্ত হন! আর দু’জনেই চলচ্চিত্রে পা রাখেন সদ্য প্রয়াত হওয়া সোহানুর রহমান সোহানের হাত ধরে!

যাযাদি/ এস

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে