শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

ইলিশ স্বাদে যেমন অতুলনীয় পুষ্টি উপাদানেও ভরপুর

ইমরান সিদ্দিকী
  ০৭ আগস্ট ২০২২, ০০:০০

টানা ৬৫ দিনের নিষেধাজ্ঞা শেষে গত ২৩ জুলাই মধ্যরাত থেকে সমুদ্রে মাছ ধরা শুরু হয়েছে। এর মধ্যে ইলিশে সয়লাব হয়ে পড়েছে বাজার। ইলিশে ভরে গেছে ইলিশ মোকাম। দক্ষিণের সব ইলিশ মোকামে আসাতে ফিরেছে প্রাণচাঞ্চল্য। রাজধানীর বাজারগুলোতে চোখে পড়ছে ইলিশ নিয়ে হাঁকডাক। পড়া-মহলস্নায় ইলিশ পাওয়া যাচ্ছে। জেলেরা বলছেন নিষেধাজ্ঞা ওঠার পর গত বছর যে পরিমাণ মাছ উঠেছিল এবারে তার চাইতে চার থেকে পাঁচগুণ বেশি ইলিশ পাচ্ছেন তারা। এ বছর বর্ষাকালে বৃষ্টিপাত খুব কম হওয়ায় ধারণা করা হয়েছিল মাছের উৎপাদন কম হবে। কিন্তু ট্রলার ভর্তি করে মাছ আসায় খুশি আড়তদার ও খুচরা ব্যবসায়ীরা। বরগুনার পাথরঘাটা, পটুয়াখালীর কুয়াকাটা, বরিশাল থেকে ট্রাকের পর ট্রাক আসছে তাজা ইলিশ নিয়ে।

এবার ঝাঁকে ঝাঁকে ইলিশ ধরা পড়ছে জেলেদের জালে। ইলিশ বোঝাই নৌকা নিয়ে ঘাটে ফিরছেন বঙ্গোপসাগরের জেলেরা। পাখির কলরবে যখন ঘুম ভাঙে-সেই কাক ডাকা ভোর থেকেই ক্রেতা-বিক্রেতার হাঁকডাকে মুখরিত হয়ে উঠছে উপকূলীয় ফিশারিস ঘাটগুলো। শুধু ইলিশই নয়, একইসঙ্গে এসব ঘাটে পাওয়া যাচ্ছে সাগর থেকে আসা দেশীয় বিভিন্ন প্রজাতির মাছ।

ইলিশ বাঙালির প্রিয় খাবার। ইলিশ ভাজা, ইলিশের ভর্তা, সরিষা ইলিশ, ভাপা ইলিশ, ইলিশ পাতুরি, দই ইলিশ, পান্তা ইলিশ, ইলিশের ডিম ছাড়া যেন বাঙালির রসনায় তৃপ্তি আসে না। ইলিশ মাছ স্বাদে যেমন অতুলনীয়, তেমনি পুষ্টি উপাদানেও ভরপুর। ইলিশ যুগ যুগ ধরে দেশের মানুষের চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি অর্থনৈতিক উন্নয়ন, কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও নিরাপদ আমিষ সরবরাহে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। ইলিশ দেশের জাতীয় সম্পদ। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) বলছেন, ইলিশ উৎপাদনে বিশ্বে বাংলাদেশ প্রথম। মৎস্যবিষয়ক আন্তর্জাতিক সংস্থা ওয়ার্ল্ডফিশের গবেষণায় এ তথ্য উঠে এসেছে। ইলিশ উৎপাদনে ব্যাপক সাফল্য পেয়েছে বাংলাদেশ। বর্তমানে বিশ্বের মোট ইলিশের ৮৬ শতাংশই উৎপাদিত হচ্ছে বাংলাদেশে। মাত্র চার বছর আগেও এই উৎপাদনের হার ছিল ৬৫ শতাংশ। বাংলাদেশে ইলিশের আহরণ প্রতি বছর ৮ থেকে ১০ শতাংশ হারে বাড়ছে। ইলিশ আছে- বিশ্বের এমন ১১টি দেশের মধ্যে ১০টিতেই ইলিশের উৎপাদন কমছে। একমাত্র বাংলাদেশেই ইলিশের উৎপাদন বাড়ছে। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি দপ্তরের তথ্যানুযায়ী, বিশ্বব্যাপী মোট ইলিশের ৮৮ শতাংশের উৎস বাংলাদেশ। মাত্র চার বছর আগেও এই উৎপাদনের হার ছিল ৬৫ শতাংশ। ইলিশের অভয়আশ্রম ও নানা কার্যকর পদক্ষেপের ফলে ধারাবাহিকভাবে ইলিশের উৎপাদন বেড়েছে বলে মনে করছেন মৎস্য গবেষকরা। ইলিশের আকার ও স্বাদ বাড়ছে।

ইলিশে অন্যান্য মাছের তুলনায় স্যাচুরেট চর্বির পরিমাণ কম ও ওমেগা-৩ ফ্যাটি (ইপিএ ও ডিএইচএ) এসিড বেশি থাকে, যা রক্তের ট্রাইগিস্নসারাইড কমিয়ে দ্রম্নত ভালো চর্বি বাড়াতে সাহায্য করে। এতে হৃৎপিন্ড ভালো থাকে। রয়েছে উচ্চ পরিমাণে ওমেগা ৩ ফ্যাটি এসিড, নায়সিন, ট্রিপ্টোফ্যান, ভিটামিন বি১২, সোডিয়াম, ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেশিয়ামসহ অন্যান্য ভিটামিন ও মিনারেলস। ইলিশের ওমেগা থ্রি ফ্যাটি এসিডের কারণে শরীরে রক্ত সঞ্চালন ভালো হয়। এতে হার্ট অ্যাটাক ও স্ট্রোকের ঝুঁকি কমে। চর্বিসংক্রান্ত সব সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণেও ভূমিকা রাখে। ইলিশের ওমেগা ৩ ফ্যাটি এসিড ৪০ ঊর্ধ্ব ব্যক্তিদের দৃষ্টিশক্তি ভালো রাখতে সাহায্য করে। ইলিশে থাকা ভিটামিন 'এ' রাতকানা রোগ প্রতিরোধে সাহায্য করে। ইলিশে ভিটামিন সি থাকে- যা ত্বক সুস্থ রাখে। এর কোলাজেন ত্বকের তারুণ্য ধরে রাখতে সাহায্য করে। ওমেগা ৩ ফ্যাটি এসিড থাকায় ইলিশ পেটের সমস্যা যেমন আলসার, কোলাইটিস ইত্যাদি কমাতে সাহায্য করে। মানুষের মস্তিষ্কের ৬০ ভাগই চর্বি (ফ্যাট) থাকে। ওমেগা ৩ ফ্যাটি এসিড মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা বাড়ায়। ওমেগা ৩ ছাড়াও ইলিশে আছে ভিটামিন বি১২, যা স্নায়ুকোষকে সুস্থ রাখতে সাহায্য করে। স্মৃতিভ্রমের ঝুঁকি কমায়। ইলিশ ভিটামিন ডির ভালো উৎস। ভিটামিন ডি মানবদেহে ক্যালসিয়াম ও ফসফেটের কার্যকারিতা নিয়ন্ত্রণ করে। ইলিশে থাকা আয়োডিন, জিংক ও পটাশিয়ামের মতো বিভিন্ন খনিজ উপাদান রক্তের গস্নুকোজ নিয়ন্ত্রণে, কোষের সংক্রমণ কমাতে ও থাইরয়েড হরমোন নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। ওমেগা-৩ ফ্যাটি এসিড অবসাদের মোকাবিলা করতে পারে।

মাছ বিষয়ক আন্তর্জাতিক গবেষণা সংস্থা ওয়ার্ল্ড ফিশের পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, বঙ্গোপসাগর তীরের ভারত-মিয়ানমার, আরব সাগর তীরের বাহরাইন-কুয়েত, পশ্চিম মধ্য প্রশান্ত মহাসাগরের পাশে মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, মেকং অববাহিকার ভিয়েতনাম-কম্বোডিয়া, চীন সাগরের পাশে চীন ও থাইল্যান্ডে ইলিশের বিচরণ কমছে। আর বাংলাদেশে ইলিশের উৎপাদন বাড়ছে। ওয়ার্ল্ড ফিশের পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, বিশ্বের মোট ইলিশের প্রায় ৮৬ শতাংশ উৎপাদিত হয় বাংলাদেশে। ভারতে ৮ শতাংশ, মিয়ানমারে ৩ শতাংশ, আরব সাগর তীরবর্তী দেশগুলো এবং প্রশান্ত ও আটলান্টিক মহাসাগর তীরবর্তী দেশগুলোতে বাকি ইলিশ ধরা পড়ে।

গত ১০ বছর আগে দেশের ২১টি উপজেলার নদনদীতে ইলিশ পাওয়া যেত। বর্তমানে ১২৫ থেকে ১৩০টি উপজেলার নদনদীতে ইলিশ পাওয়া যাচ্ছে। দেশে প্রায় ৭ হাজার বর্গ কিলোমিটার জুড়ে রয়েছে ইলিশের অভয়াশ্রম। বাংলাদেশে ইলিশের জনপ্রিয়তা বলার অপেক্ষা রাখে না। স্বাদের কারণে পাশের দেশেও বাংলাদেশের ইলিশের কদর অনেক। বিশ্বব্যাপী এই রুপালি ইলিশের কদর রয়েছে। ওয়ার্ল্ড ফিশ সেন্টারের তথ্যমতে ২৫টি ভাষায় ইলিশের ১১০টি স্থানীয় নাম রয়েছে। এই মীনসন্তান নানা দেশে নানা নামে পরিচিত। তাই এক ইলিশের হরেক নাম।

দেশের বাজারে বড় আকারের ইলিশের সরবরাহ বেড়েছে। এর কারণ হিসেবে বিজ্ঞানীরা বলছেন, প্রজনন মৌসুমে ইলিশ ধরায় নিষেধাজ্ঞা এবং জাটকা নিধনে কার্যকরী পদক্ষেপের কারণে পাঁচ বছরের ব্যবধানে বড় আকারের ইলিশের উৎপাদন বেড়েছে। জেলেদের জালে ৮০০ গ্রাম থেকে ১ হাজার গ্রামের বেশি ওজনের ইলিশ আহরণ বেড়েছে। ২০১৯ সালে এই ওজনের ইলিশ ধরা পড়েছে মোট ইলিশের ২২ শতাংশ। যা ২০২১ সালে এসে দাঁড়িয়েছে ২৫ শতাংশে। ২০২০-২১ অর্থবছরে বর্তমানে ইলিশের উৎপাদন ৫ লাখ ৮৯ হাজার টন, যা এক দশক আগের তুলনায় দ্বিগুণ।

ইলিশ মূলত নোনা পানির মাছ। তবে প্রজনন মৌসুমে ডিম পাড়তে নদীর উজানের দিকে আসে ইলিশ। ফলে দেশের বৃহৎ নদীসমূহ যথা পদ্মা, যমুনা, মেঘনা ইত্যাদি নদীতে ধরা পড়ে রুপালি ইলিশ। ইলিশ মূলত বাংলাদেশের মাছ। ২০১৭ সালে বাংলাদেশের ইলিশ মাছ ভৌগোলিক নির্দেশক বা জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। বিশ্বে উৎপাদিত মোট ইলিশের ৮৬ শতাংশ ইলিশের উৎপাদন হয় বাংলাদেশে। তিনি বলেন, ইলিশ বাংলাদেশের জাতীয় মাছ। মাছের রাজা হিসেবে পরিচিত ইলিশ। ইলিশ মাছের মধ্যে ওমেগা-৩ নামে এক ধরনের তেল রয়েছে- যা হৃদরোগসহ বেশ কিছু রোগের ওষুধ হিসেবে বিশ্বজুড়ে ব্যবহৃত হচ্ছে। হাতে গোনা কয়েকটি মাছে এই তেল রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র, নিউজিল্যান্ড ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশে ইলিশ মাছের সু্যপ অনেক দামে বিক্রি হচ্ছে।

বাংলাদেশে মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) ইলিশের অবদান ১ দশমিক ১৫ শতাংশ। দেশের মোট মাছের ১২ শতাংশের উৎপাদন আসে ইলিশ থেকে। যার অর্থমূল্য আনুমানিক সাড়ে ৭ হাজার কোটি টাকা। উৎপাদিত ইলিশের যেটুকু রপ্তানি হয় তাতে ১৫০ থেকে ৩০০ কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা অর্জিত হয়। প্রায় পাঁচ লাখ লোক ইলিশ আহরণে সরাসরি নিয়োজিত এবং ২০ থেকে ২৫ লাখ মানুষ পরিবহণ, বিক্রয়, জাল ও নৌকা তৈরি, বরফ উৎপাদন, প্রক্রিয়াজাতকরণ, রপ্তানি ইত্যাদি কাজে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িত।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে