শনিবার, ১৮ মে ২০২৪, ৪ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১

দেশি ফলে বেশি পুষ্টি

প্রকৌশলী সাজ্জাদ হোসেন
  ০৫ মে ২০২৪, ০০:০০
দেশি ফলে বেশি পুষ্টি

দেশে এখন বারমাসি বাহারি ফল জন্মে। এসব দেশি ফল বিদেশি ফলের চেয়ে কোনো অংশে কম নয়। বরং দেশি ফলে বেশি স্বাদ ও পুষ্টিগুণ রয়েছে। শুধু স্বাদে-গন্ধেই নয়, পুষ্টিমানের বিচারেও উৎকৃষ্ট। দেশি ফলে পুষ্টি উপাদান বেশি। বিদেশি ফল আপেলে ভিটামিন 'সি' আছে খাদ্যোপযোগী প্রতি ১০০ গ্রামে মাত্র ৩.৫ মিলিগ্রাম। অন্যদিকে, বাংলার আপেলখ্যাত পেয়ারায় ভিটামিন 'সি' আছে ২১০ মিলিগ্রাম। অর্থাৎ পেয়ারায় আপেলের চেয়ে ৫০ গুণেরও বেশি ভিটামিন 'সি' আছে। আঙুরে খাদ্যশক্তি আছে ১৭ কিলোক্যালরি আর বড়ইতে খাদ্যশক্তি আছে ১০৪ কিলোক্যালরি- যা ৬ গুণেরও বেশি। আঙুরে ভিটামিন 'সি' আছে ২৮.৫ মিলিগ্রাম, বড়ইয়ে ভিটামিন 'সি' আছে ৫১ মিলিগ্রাম অর্থাৎ প্রায় দ্বিগুণ। পাকা আমে ক্যারোটিন আছে ৮৩০০ মিলিগ্রাম, পেঁপের মধ্যে আছে ৮১০০ মিলিগ্রাম, কাঁঠালে আছে ৪৭০০ মিলিগ্রাম। সে তুলনায় আঙুর, আপেল, নাশপাতি, বেদানায় ক্যারোটিন আদৌ নেই। বিদেশি ফল মাল্টা ক্যারোটিনশূন্য অথচ দেশি কমলায় ক্যারোটিনের পরিমাণ ৩৬২ মিলিগ্রাম।

বারোমাসি বৈশাখী, আশ্বিনা, শ্রাবণী, ভাদুরীসহ নানা জাতের আম; ভাবা যায়? শুধু আমই নয়, পরিকল্পিত চাষাবাদে পাওয়া যাবে অন্যান্য ফলও। ডেউয়া, সফেদা, বিলাতি গাব, করমচা, কাউফল, শরিফা, অড়বরই, বেতফল ও লটকনের মতো ফলগুলো এখন সারা বছরই পাওয়া যাচ্ছে দেশি ফল। এক সময় ফলের বাজারে বিদেশি ফলের আধিপত্য থাকলেও এখন দেশি ফলের চাহিদা সৃষ্টি হয়েছে। খাদ্যনিরাপত্তার কথা ভেবে মানুষ দেশি ফলের দিকে ঝুঁকছেন।

কয়েক বছর আগেও স্ট্রবেরি, ড্রাগন ফল ছিল বড় বড় সুপার শপের শৌখিন ফল। পেস্ননে বা জাহাজে চড়ে আসত বিদেশ থেকে। ধনীদের বাজারের থলেতে উঠত চড়া মূল্যের বিনিময়ে। বর্তমানে ফুটপাতেই ঝুড়িতে বিক্রি হচ্ছে এসব ফল। বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদন হচ্ছে দেশে। কমে এসেছে দাম। শুধু ড্রাগন বা স্ট্রবেরি নয়, দেশের মাটিতে ফলছে মাল্টা, কমলা, আঙুর, অ্যাভোকাডো, রকমেলন, পার্সিমন, রাম্বুটান, চেরি, থাই সফেদা, লংগান, টক আতা, আলুবোখারা, ব্রেড ফ্রুট, নাশপাতি, জাবটিকাবা, সুইট লেমন, থাই পেয়ারা, থাই বারোমাসি আম, থাই মিষ্টি তেঁতুল, থাই কুল, থাই পেঁপে, মালবেরি, ত্বিন, গোল্ডেন ক্রাউন (হলুদ তরমুজ)-সহ অর্ধ শতাধিক বিদেশি ফল মিলছে বছর ধরে।

এখন দেশি ফলের জন্য শুধু মধু মাসের জন্য অপেক্ষা নয়, এখন সারা বছরই মিলছে রসে ভরা টাটকা দেশি ফল। মধু মাস জ্যৈষ্ঠ আসতে অনেক সময় বাকি আছে। তারপরও ফলের বাজারে দেশি ফলের মৌ মৌ সুবাস। আম, কাঁঠাল, মাল্টা, আমড়া, কলা, ডালিম, হরীতকী, চালতা, আপেল কুল, কাঁঠাল, পেয়ারা, করমচা, জামরুল, লটকন ও আনারসে ভরপুর রাজধানীর ফলের বাজারগুলো। ঢাকার অলি-গলিতে মিলছে রসে ভরা সুস্বাদু দেশি ফল।

ঋতু বৈচিত্র্যের বাংলাদেশে সারা বছরজুড়েই থাকছে হরেক রকম ফলের সমাহার। বৈশাখ জ্যৈষ্ঠকে মধু মাস বলা হলেও এখন সারা বছর পাওয়া যায় রসাল নানান ফল। এক এক ঋতুতে এক এক স্বাদের ফল। কৃষিবিদরা বলছেন, পেঁপে, ডালিম ও কলা সারা বছরই ফলে। এই দুটি ফল সব সময় পাওয়া গেলেও সেপ্টেম্বর থেকে জানুয়ারি পর্যন্ত এই পাঁচ মাস আগে বাজারে দেশি ফলের সরবরাহ কম থাকতো। ষড় ঋতুর এই দেশে পাঁচ মাসের ফলের অভাব দূর করতে গত কয়েক বছরে কৃষি বিজ্ঞানীরা গবেষণা করে উদ্ভাবন করেছেন এ সময়ের আবহাওয়া উপযোগী একাধিক মৌসুমি ফল। এখন ওই পাঁচ মাস পাওয়া যাচ্ছে বাউকুল, আপেলকূল, সফেদা, দেশীয় উপযোগী থাই পেয়ারা, সাদা ও লাল জামরুল, ডালিম, আমলকী, কমলা, মাল্টা, আতা ফল ও আগাম জাতের তরমুজ। এতে বিদেশি ফলের নির্ভরতা অনেক কমেছে।

কৃষি তথ্য সার্ভিসের সাবেক পরিচালক কৃষিবিদ আজিজুর রহমান বলেন, এখন কয়েকটি বেদেশি ফল দেশেই চাষ হচ্ছে। বিদেশি ফল হলেও এগুলো দেশের উপযোগী করেছেন কৃষি গবেষকরা। এর মধ্যে অ্যাভোকাডো, স্ট্রবেরি, ড্রাগন ফল, প্যাশন ফল, পার্সিমন, নাশপাতি, রামবুটান ও সৌদি খেজুর। দেশি ফল খেলে দেহে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ে।

দেশি ফলে সুস্বাদু স্বাদের পাশাপাশি রয়েছে পুষ্টিগুণ। ভিটামিন এ এবং সি ছাড়াও রয়েছে ভেষজ গুণ। ফল খেলে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ে। এ বিষয়ে মিরপুর আলোক হাসপাতালের পুষ্টি বিশেষজ্ঞ ডা. সামিয়া সুলতানা টুসি বলেন, অসুস্থ রোগী দেখতে রোগীর আত্মীয়রা ফল নিয়ে আসে। কথায় বলে, ফলই বল। ফল খেলে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ে। দেশীয় ফলে ভেষজ গুণ রয়েছে অনেক। ফলে প্রচুর পানি ও অ্যান্টি-এসিডিক থাকে। এছাড়াও, ফলে প্রোটিন ও ফ্যাটের পরিমাণ কম থাকে। ফলে প্রচুর ভিটামিন এ এবং সি থাকে। ফল লো ক্যালরিযুক্ত খাদ্য। ফল খেলে মোটা হওয়ার ভয় নেই। ফলে থাকে ফাইবার- যা খাবার হজমে সাহায্য করে। ভিটামিন মিনারেল ও এনজাইম সমৃদ্ধ দেশি ফল রোগ প্রতিরোধে সাহায্য করে। বার্ধক্য প্রতিরোধেও মুখে বলিরেখা কমাতে ফল ভূমিকা রাখে। মানব দেহকে সুস্থ রাখতে প্রতিদিন ফল খাওয়া উচিত।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের হিসাবে, আম উৎপাদনে বিশ্বে সপ্তম স্থান বাংলাদেশের। পেয়ারায় ৮ম স্থানে রয়েছে। বিশ্বে কাঁঠাল উৎপাদনেও এক নম্বরে উঠবে বাংলাদেশের নাম। গত বছর ১৬ লাখ টন কাঁঠাল উৎপাদিত হয়েছে। বর্তমানে শীর্ষ স্থানে থাকা ভারতের উৎপাদনের চেয়ে কম। এখন দেশে দেশি ফলের আবাদের পাশাপাশি বিদেশি ফলও চাষ হচ্ছে। ফলে দেশের মানুষ টাটকা ফল খেতে পারছে। ফলে বর্তমানে দেশে ১৫৭ প্রজাতির ফল উৎপাদন হচ্ছে। হারিয়ে যাওয়া অনেক জনপ্রিয় ফলকে ফিরিয়ে আনা হয়েছে। কৃষি বিজ্ঞানীরা এখন সারাদেশের যে কোনে স্থানে আমড়া, পেয়ারা, ডালিম ও কুল ফলানোর উপযোগী জাত উদ্ভাবন করেছে। ফলে সারাদেশেই এখন এসব ফল উৎপাদন হচ্ছে।

বছরের পুরো সময়টায় দেশি ফলের সরবরাহ বাড়াতে সরকার নানা উদ্যোগ নিয়েছে। এ বিষয়ে একটি প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। কৃষি অধিদপ্তরের 'সারা বছরব্যাপী ফল উৎপাদন ও পুষ্টি উন্নয়ন'। প্রকল্পের মাধ্যমে বছরব্যাপী দেশি ফলের উৎপাদন বাড়াতে নানা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। বারোমাসি জাতের আম, মাল্টা, কুল, জামরুল, ডালিম ও কাঁঠাল ফলের উৎপাদন বাড়ানো হয়েছে। বছরব্যাপী ফল উৎপাদনের মাধ্যমে পুষ্টি উন্নয়ন প্রকল্পের মাধ্যমে দেশের ৭টি বিভাগের ৪৫টি জেলার ৩৬২টি উপজেলায় ৪৫ লাখ পরিবারে মধ্যে কার্যক্রম চলছে।

দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে দেশি ফল ঢাকার ফলের আড়তে আসে। সেখান থেকে খুচরা বিক্রেতার হাত হয়ে আসছে ক্রেতার নাগালে। রাজধানীর প্রধান ফলের পাইকারি বাজার হচ্ছে- পুরান ঢাকার বাদামতলী এবং পুরানা পল্টন, শান্তিনগর, কারওয়ান বাজার আড়ত।

পুরানা পল্টনে বাংলাদেশ হাউজ বিল্ডিং ফাইন্যান্স করপোরেশনের পাশের গলিতে এই ফলের বাজারে চার যুগ ধরে ফল বিক্রি করছেন আলকাছ উদ্দীন। তিনি বলেন, আগে শীতের আগে বাদামতলী ও যাত্রাবাড়ী আড়ত থেকে বিদেশি ফল এনে বিক্রি করতাম। এখন আর যেতে হয় না। এখন দেশের বাজারেই রাম্ভটান, ডালিম, আগাম আম, লিচু, জাম ও মাল্টা পাওয়া যাচ্ছে। পাইকাররা এসব ফল দোকানে পৌচ্ছে দিচ্ছে। তবে দেশে সারা বছরই চাহিদার তুলনায় দেশি ফলের সরবরাহ কম। মানুষ দেশী ফলই খেতে চায়, কিন্তু সরবরাহ না থাকায় তারা বিদেশি ফল কেনে। ব্যবসার জন্য আপেল, নাসপাতি ও খেজুর বিক্রি করি।

মিরপুর দশ নম্বর ফল মার্কেটের ফল বিক্রেতা শফিকুল বলেন, গত ২১ বছর ধরে এখানে ফল বিক্রি করছি। তিনি সারা বছরই কলা, পেপে, পেয়ারা, জামরুল, আপেল কুল, ডালিম, মাল্টা বিক্রি করছেন। তিনি বলেন, আগে শীতের আগে আগে দেশি ফলের সরবরাহ থাকত না। এখন ওই সময়ে আতা ফল, আগাম জাতের তরমুজ, থাই পেয়ারা, ডালিম বাজারে উঠে। তিনি বলেন, দেশি ফলের সামনে কোনো ফল নেই। যারা জানে তারাই কেনে। এখন সচেতন ক্রেতা বেড়েছে। বিদেশি ফলে ফরমালিন বেশি থাকে বলে তারা দেশি ফল কিনেন।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
X
Nagad

উপরে