শুক্রবার, ০৩ মে ২০২৪, ২০ বৈশাখ ১৪৩১

নিতুদের পৌষ পার্বণ

ডা. খোন্দকার শাহিদুল হক
  ১৩ জানুয়ারি ২০২৪, ০০:০০
নিতুদের পৌষ পার্বণ

গত বছর পৌষ মাসের শেষ দিন পৌষ সংক্রান্ত্রি বা পৌষ পার্বণ পালনের জন্য নিতুদের বাড়িতে অনেক কিছুর আয়োজন করা হয়েছিল। পৌষ পার্বণ মানেই যেন বাঙালিদের এক নতুন উৎসব। মাঠের ধান ঘরে উঠলেই শুরু হয়ে যায় পিঠার প্রস্তুতি। গৃহিণীদের মুখে নতুন রবির আলোর মতোই মিষ্টি হাসি যেন লেগেই থাকত। উৎসবের আগে ঘটা করে নতুন ধান ঝাড়াই মাড়াই করে কুটিয়ে নেওয়া হতো। দুজন অনবরত ঢেঁকিতে পাড় দিত, আর সেই তালে তালে গর্তের মধ্যে চাল ঢালা হতো। এই গর্তকে বলে গড়। ঢেঁকির মাথা যখন গড়ের ওপর থাকবে তখনই গর্তের মধ্যে হাত দিয়ে চাল দেওয়া বা আঁটা তোলার কাজ সেরে নিতে হয়। এভাবেই চলত দিন-রাত চাল কোটানোর পালা। ঢেঁকিতে ধান ভানা কিংবা চাল কোটানোর সময় সুর করে গান গাইত- 'অ বউ ধান ভানে রে, ঢেঁকিতে পাড় দিয়া, বউ নাচে ঢেঁকি নাচে হেলিয়া দুলিয়া, বউ ধান ভানে রে।' আগের দিনের মতো এখন আর তেমন ঢেঁকিতে ধান ভানা কিংবা চাল কোটানো হয় না। একই সাথে গ্রাম-বাংলার সেই গানও আজ হারিয়ে যেতে বসেছে। কিন্তু নিতু গ্রাম বাংলার এই ঐতিহ্য থেকে দূরে সরে যেতে চায় না। ঢেঁকি থাকুক বা না থাকুক পৌষ পার্বণের এই ধারা যেন বাঙালির চেতনায় জেগে থাকে।

নিতুর মা নেই। নিতুরা দুই বোন। বৃদ্ধ বাবাকে নিয়ে তাদের ছোট্ট একটা সংসার। নিতু অবিবাহিতা। সে এবার তেত্রিশে পা দিয়েছে। নিতু বড় আর প্রিতু তার চেয়ে পাঁচ-ছয় বছরের ছোট। নিতু মাস্টার্স পাস করে চাকরির জন্য অনেক চেষ্টা করেছে। কিন্তু চাকরি নামক সোনার হরিণ তাকে ধরা দেয়নি। এদিকে তার ইচ্ছা ছিল প্রতিষ্ঠিত না হয়ে বিয়ে করবে না। কিন্তু এখন বয়স বেড়ে যাওয়ায় তেমন আর বিয়ের প্রস্তাবও আসে না। বৃদ্ধ বাবার সেবা-যত্ন আর দুই-একটা টিউশনি করে তার দিন কাটে। গায়ের রং শ্যামলা হওয়ায় তাকে আরও বেশি বিড়ম্বনার শিকার হতে হয়েছে।

নিতুর মা বলত- মেয়ের পড়াশোনা শেষ না হওয়া পর্যন্ত বিয়ে নিয়ে চিন্তাই করবে না সে। অথচ নিতুর বাবা বলত, মেয়ের বয়স বিশ-বাইশে গেলেই বিয়ে দিয়ে দেওয়া উচিত। পড়াশোনা করলে বিয়ের পরেও করা যায়। অন্যথায় পরে আর ভালো পাত্র পাওয়া যায় না। আজকালকার ছেলেরাও এর চেয়ে বেশি বয়সি মেয়েদের বউ হিসেবে পছন্দ করে না। এদিকে নিতুর বিয়ে হচ্ছে না দেখে প্রিতুরও বিয়ে দিতে দেরি হয়ে যাচ্ছিল। প্রিতুর কাছে বিষয়টি মোটেও পছন্দের ছিল না। এই অবস্থায় প্রিতু একদিন বলেই বসে আপার বিয়ে হোক বা না হোক সে ঠিকই বিয়ে করবে। এটা শুনে নিতুর মা অনেক রাগ করেছিল। কিন্তু তাতে কোনো লাভ হয়নি। প্রিতু ঠিকই গত বছর পৌষ পার্বণের কয়েকদিন আগে কাউকে না জানিয়ে পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করে। তার মা এটা মেনে নিতে পারেনি। ফলে সে পরের দিনই লোকলজ্জা আর অপমানের ভারে অধিক দুশ্চিন্তায় হার্ট অ্যাটাকে মৃতু্যর কোলে ঢলে পড়ে।

নিতু তার একমাত্র ছোট বোনকে খুবই ভালোবাসে। ছোট বোনের পড়াশোনার প্রতিও তার দৃষ্টি ছিল। ছোট বোন অনার্সে পড়লেও সব সময় মোবাইল নিয়ে পড়ে থাকত। বোন কষ্ট পাবে দেখে কিছু বলতে গিয়েও বলত না সে। কখনো চায়নি ছোট বোন তার ব্যবহারে সামান্য কষ্ট পাক। আজও সে মায়ের অবর্তমানে ছোট বোনকে মায়ের অভাব বুঝতে দিতে চায় না। মেয়ের শ্বশুরবাড়িতে গুড়, নারকেল চালের গুঁড়ো পাঠাবার রীতি এখনো বাঙালি পরিবারগুলোতে রয়েছে। নিতু এই লোকাচার মনে রেখেছে। তাই তার মা নেই তো কী হয়েছে! সে ছোট বোনের শ্বশুরবাড়িতে এসব পাঠানোর ব্যবস্থা ঠিকই করেছে। এছাড়া মা থাকতে তারা একসাথে উঠোনে বসে মিঠে রোদ গায়ে মেখে নলেন গুড় সহযোগে নারকেলের পিঠে, চিতই পিঠে কিংবা পাটিসাপটা খেতো। নিতুর ইচ্ছা তার ছোট বোনকে নিয়ে আগের দিনের মতোই এবারও উঠোনে বসে পিঠা পায়েস খাবে। তাই সে প্রিতুকে তার স্বামীসহ আসার জন্য বলাতে প্রিতু এই প্রথম বাড়িতে আসতে রাজি হয়েছে। এতে নিতুর সে কী আনন্দ! যেন সব দুঃখ কষ্ট সে এক নিমিষেই ভুলে গেছে।

নিতুর অসুস্থ বাবা মেয়ের এসব পাগলামি দেখে মুখ লুকিয়ে অনেক কেঁদেছে। মেয়েকে যথাসময়ে বিয়ে দিতে না পারার যে কী যন্ত্রণা তাও সে কাউকে বোঝাতে পারে না। বড় মেয়ের ভবিষ্যৎ চিন্তা করতে করতে তার শরীরের অবস্থাও এখন অনেক খারাপের দিকে। সংসারের কোনো কিছুতেই তার আর মন বসে না। তবু পৌষ পার্বণে তার ছোট মেয়ে বাড়িতে বেড়াতে আসবে শুনে যেন অনেকটা সুস্থতা বোধ করছে। বড় মেয়েকে কাছে ডেকে বলল, নিতু, প্রিতু কি জানে যে আমি তাকে ক্ষমা করে দিয়েছি?

নিতু বলল, তুমি যে কথা কখনো বলনি সে কথা কী করে জানবে বাবা। আজ আমি ঠিকই তাকে জানিয়ে দেব। নিতুর বাবা চোখের পানি মুছেতে মুছতে বলল, নিতু- পৌষ পার্বণে অনেকেই ঘুড়ির উৎসব করে। দেখিস, আমাদের মনের আকাশেও অনেক ঘুড়ি উড়বে আজ।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে