শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

নারীদের জীবনে সরকারি আইনগত সহায়তা কার্যক্রমের প্রভাব

বাংলাদেশের সহায়-সম্বলহীন, গরিব, অনগ্রসর মানুষের জন্য বিনামূল্যে আইনি সেবাপ্রদান সরকারের একটি যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত। বাংলাদেশের বিচার বিভাগের ইতিহাসেও এ সিদ্ধান্ত অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ। বিনামূল্যে সরকারি আইনি সেবার মাধ্যমে আদালতে আইনি প্রতিনিধিত্বের মাধ্যমে ক্ষমতায়ন করা হয়েছে সহায়-সম্বলহীন, গরিব, অনগ্রসর মানুষের। বিশেষ করে নারীর ক্ষমতায়নে সরকারি আইনগত সহায়তা কার্যক্রমের অবদান এবং সাফল্য দুর্দান্ত। নারীর ক্ষমতায়নে সরকারি আইনগত সহায়তা কার্যক্রমের অবদান নিয়ে দুই পর্বে লিখেছেন সিনিয়র সহকারী জজ ফারহানা লোকমান, যিনি কুমিলস্নার জেলা লিগ্যাল এইড অফিসার হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। আজ ছাপা হলো শেষ পর্ব
নতুনধারা
  ২০ এপ্রিল ২০২১, ০০:০০

কুমিলস্না জেলা লিগ্যাল এইড অফিসার হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে আমার তত্ত্বাবধানে

নিষ্পত্তি হওয়া কিছু কেস স্টাডি

শেয়ার করছি-

কুমিলস্না জেলার বরুড়া উপজেলার আদ্রা ইউনিয়নের মহিলা মেম্বার আয়েশা বেগম। মেম্বার হয়েও তার মেয়ে সানজিদার উপর শ্বশুরবাড়ির লোকজনের করা নির্যাতনের ব্যাপারে পারিবারিকভাবে ও গ্রাম্য সালিশে কোনো সমাধান করতে না পেরে তিনি জাতীয় আইনগত সহায়তা প্রদান সংস্থার হটলাইন নাম্বার ১৬৪৩০-তে ফোন করে আইনগত পরামর্শ নিয়ে জেলা লিগ্যাল এইড অফিস কুমিলস্নাতে আসেন। এডিআর বা আপস-মীমাংসার মাধ্যমে মেয়ে তার দেনা-পাওনা বুঝে পায়। সানজিদা শ্বশুরবাড়ির চাপে বন্ধ হয়ে যাওয়া পড়াশোনা আবার শুরু করেছে এবং অন্যত্র বিয়ে করে সুখে-শান্তিতে বসবাস করছেন। একটি অনলাইন পেজে কাজ করে অর্থনৈতিকভাবে সে এখন স্বাবলম্বী। জেলা লিগ্যাল এইড অফিস থেকে বিনা হয়রানিতে বিনা খরচে সেবা পেয়ে আয়েশা বেগম বর্তমানে তার এলাকার সব অসহায় দরিদ্র মানুষের বিশেষ করে অসহায় নারীদের আইনি সমস্যা-সমাধানে তাদের নিয়ে জেলা লিগ্যাল এইড অফিসের দ্বারস্থ হন।

চাচাতো ভাই রাকিবের (ছদ্মনাম) যৌন নিপীড়নে অতিষ্ঠ হয়ে নাহিদা (ছদ্মনাম) মা-বাবাকে বিষয়টা জানালেও তারা তাকে চুপ থাকতে বলেন। সরকারি লিগ্যাল এইড কার্যক্রমের অধীনে উঠান বৈঠক থেকে এই কার্যক্রম সম্পর্কে জানতে পেরে নাহিদা জেলা লিগ্যাল এইড অফিসে আসেন। তার অভিযোগ শুনে তাকে মামলা করার পরামর্শ দেওয়া হয় এবং তার মা-বাবাকে ডেকে এনেও তাদের বিষয়টা বোঝানো হয়। নাহিদা তার মা-বাবাকে সঙ্গে নিয়ে রাকিবের বিরুদ্ধে যৌন নিপীড়নের অভিযোগে মামলা করেছেন এবং রাকিব হাজতে আছে। নাহিদা আবার কলেজে যাওয়া শুরু করেছে।

তাহমিনার ৩ মাস বয়সে তার বাবা-মায়ের মধ্যে তালাক হয় এবং তার দুই বছরের মাথায় তার মায়ের মৃতু্য হয়। সেই থেকে তার নানি তাকে দেখাশোনা করত। একপর্যায়ে তাহমিনার খরচ চালাতে অপারগ হয়ে তার নানি জেলা লিগ্যাল এইড অফিস কুমিলস্নার শরণাপন্ন হন। অফিস থেকে পাঠানো এডিআরের জন্য নোটিশ পেয়ে বাবা হাজির হলে মধ্যস্থতার মাধ্যমে তাহমিনাকে তার বাবা নিয়মিত ভরণপোষণ ও উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্য সম্পত্তি থেকে তাকে কোনোরূপ বঞ্চিত করবেন না বলে চুক্তি স্বাক্ষর করেন। নানি মারা গেলে তিনি তাহমিনার দেখাশোনার দায়িত্ব নেবেন বলেও সম্মত হন। দশ বছরের তাহমিনা ও তার ৭৫ বছরের নানি এভাবেই বিনা কষ্টে, বিনা অর্থ ব্যয়ে তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করেন।

লনী রানী কর্মকার মৃত স্বামীর সম্পত্তিতে নিজ ও তার পুত্রের অধিকার নিশ্চিত করতে জেলা লিগ্যাল এইড অফিস, কুমিলস্নায় আসেন ও সরকারি খরচে বণ্টনের মামলা করেন। মামলার শুনানি শেষে তিনি ও তার পুত্র সঞ্জয় হিন্দু আইনের বিধান মতে তার স্বামী নিখিল কর্মকারের ওয়ারিশ সূত্রে সম্পত্তি বুঝে পান। এখন তিনি ছেলেকে নিয়ে তার স্বামীর বসতভিটায় বসবাস করছেন ও একটা চাকরি করে সন্তানকে বড় করছেন।

সাবরিনা আক্তার পরিবারের অমতে সুমনকে ভালোবেসে বিয়ে করে। এক বছরের মাথায় তাদের সংসারে ফুটফুটে পুত্র সন্তানের জন্ম হয়। কিন্তু সুমনের বাড়ির লোকজন সাবরিনাকে কখনোই মন থেকে মেনে নেয়নি। সুমন বিদেশ যাওয়ার পর সুমনের পরিবার এমনকি সুমনের সঙ্গেও সাবরিনার সমস্যা শুরু হয়। পরিবারের লোকজন তাকে প্রায় মারধর করত। সুমন বিদেশ থেকে ঠিকমতো ভরণপোষণ পাঠাতো না। সাবরিনাকে বারবার মৌখিকভাবে তালাকও দিয়েছে সুমন। একরাতে তাকে ও তার ছেলেকে ঘর থেকে বের করে দেয় সুমনের পরিবারের লোকজন। সাবরিনার বাবার বাড়ির লোকজনও তাকে রাখতে রাজি না হওয়ায় এক মহিলা মেম্বারের বাড়িতে আশ্রয় নেন তিনি। পরদিন তিনি আদালতপাড়ায় এসে ঘুরতে ঘুরতে শেষে সাইনবোর্ড দেখে জেলা লিগ্যাল এইড অফিসে এসে হাজির হন। অফিস থেকে এডিআরের ব্যবস্থা গ্রহণ করে সাবরিনাকে সমাজসেবা অধিদপ্তরের অধীনের সেইফ হোমে পাঠানো হয়। মধ্যস্থতার মাধ্যমে সাবরিনা সুমনকে তালাক দেন। তিনি তার দেনমোহর ও বাচ্চার ভরণপোষণের টাকা বুঝে পান। এখন সাবরিনা ছেলেকে ডে কেয়ার সেন্টারে রেখে চাকরি করেন। নিজে বাসা ভাড়া করে থাকেন।

উপরের কেস স্টাডিগুলোতে যে আয়েশা, নাহিদা, তাহমিনা বা লনী রানী বা সাবরিনাকে দেখা যাচ্ছে তারা আসলে সারা দেশের ৬৪ জেলার জেলা লিগ্যাল এইড অফিসের মাধ্যমে সম্পত্তির অধিকার পাওয়া, আইনগত অধিকার বুঝে পেয়ে ঘুরে দাঁড়ানো, আইনের আশ্রয় পাওয়া, নির্যাতনের বিচার পাওয়া, নিজের পায়ে দাঁড়ানো নারীদের প্রতিনিধিত্ব করে। সারাদেশে এই কার্যক্রমের মাধ্যমে এই পর্যন্ত ৫৮৫৩৮১ জন ব্যক্তি আইনগত সহায়তা পেয়েছে তার মধ্যে প্রায় ২৮৩৮৭৪ জন নারী। ক্ষতিগ্রস্ত নারী ও পুরুষের পাওনা ও ক্ষতিপূরণবাবদ আদায় করে দেওয়া হয়েছে ৫৪,৬৯,৫২,৭০৮/ (চুয়ান্ন কোটি উনসত্তর লাখ বায়ান্ন হাজার সাতশত আট) টাকা।

সরকারি আইনগত সহায়তা প্রাপ্তির হটলাইন নাম্বারে (১৬৪৩০) ঘরে বসে ৩৭৯৫৫ জন নারী আইনগত পরামর্শ নিয়েছেন। এই নারীদের বেশিরভাগই প্রাথমিক বা মাধ্যমিকের গন্ডি পার না করা, নিম্নবিত্ত বা নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের অন্যের উপর অর্থনৈতিক ও সামাজিকভাবে নির্ভরশীল নারী। সেই অবস্থানে থেকে এই কার্যক্রম না থাকলে ২৮৩৮৭৪ জন নারীর অনেকেই হয়তো আইনগত অধিকার বাস্তবায়ন করতে পারতেন না, অধিকার চাইতেও পারতেন না অথবা নানা হয়রানির স্বীকার হয়ে হাল ছেড়ে দিতেন। এই কার্যক্রম শুধু তাদের নয় উদাহরণ সৃষ্টির মাধ্যমে তাদের আশপাশের নারীদেরও ক্ষমতায়িত করছে।

জাতীয় আইনগত সহায়তা কার্যক্রমের বার্তা এখনো তৃণমূল পর্যায়ে সবার কানে পৌঁছেনি। এখনো দেশের সব জেলায় পার্মানেন্ট লিগ্যাল এইড অফিসার নিয়োগ দেওয়া হয়নি। তবে সরকার তথা জাতীয় আইনগত সহায়তা প্রদান সংস্থা দেশের সব সুবিধাবঞ্চিত মানুষের কাছে আইনগত সহায়তা কার্যক্রম পৌঁছে দিতে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন।

দেশের জনগণের জন্য আইনের শাসন নিশ্চিত করা এবং নারীর ক্ষমতায়নকে অগ্রাধিকার দিয়ে বর্তমান সরকার নানামুখী পদক্ষেপ নিয়েছেন ও নিচ্ছেন। আমি আশা রাখি ধীরে ধীরে বাংলাদেশ নারীর ক্ষমতায়নে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছাবে এবং জাতীয় আইনগত সহায়তা কার্যক্রম এই যাত্রার সারথি হয়ে পাশে থাকবে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে