শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

নারী কেন যৌন নির্যাতন সহ্য করবে?

স্ত্রী চাকরি করলে স্বামীর হক আদায় হয় না/ স্ত্রী চাকরি করলে সন্তানের হক আদায় হয় না/স্ত্রী চাকরি করলে তার কমনীয়তা নষ্ট হয়/ স্ত্রী চাকরি করলে পরিবার ধ্বংস হয় / স্ত্রী চাকরি করলে পর্দা নষ্ট হয়/ স্ত্রী চাকরি করলে সমাজ নষ্ট হয়। বলা বাহুল্য যে, তার এই পোস্টের গুনগান এই দেশের লাখো কোটি মানুষের হৃদয় ছুঁয়ে গেছে। আর এই হৃদয় ছুঁয়ে যাওয়ার ব্যাপারটা এতই গভীর যে, এর বিরুদ্ধে কেউ দ্বারালেই সে ইসলাম বিদ্বেষী বা ধর্ম বিদ্বেষী বলে ফতোয়া দেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এমন কাঁদা ছোড়াছুড়ি সবাই দেখেছেন বলে আমার বিশ্বাস। এই যে একটি দেশের কয়েকটি কোটি মানুষ বিশ্বাস করছে, স্ত্রী অর্থাৎ নারী চাকরি করলে পরিবার ধ্বংস হয়, নারী চাকরি করলে সমাজ ধ্বংস হয়, ধর্মীয়ভাবে বিষয়টি আসলে কতটুকু যৌক্তিক?
তাজুল ইসলাম
  ০৫ ডিসেম্বর ২০২৩, ০০:০০

নারী মুক্তির বাসনা আমারা মনে প্রাণে লালন করি। আমরা দেখাই, আমাদের কত অর্জন, নারীর স্বাধীনতা নিয়ে। এটা সন্দেহ নেই যে, বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের আমল থেকে এখন পর্যন্ত নারীরা অনেক এগিয়ে গেছে। তবে যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে নারী কতটা উন্নত রূপে আবির্ভূত হলো, সে প্রশ্নের উত্তর হয়তো খুব বেশি সাফল্যমন্ডিত হবে না। এর পেছনে কারণও রয়েছে। আমাদের মূলত উন্নয়ন হয়েছে গঠনগত জায়গায়। কিন্তু মানসিক উন্নয়নের দিক দিয়ে আমরা সেই জাহেলি যুগেই পড়ে আছি। আর এই জাহেলি যুগে পড়ে থাকার মূল অস্ত্র ধর্ম। ধর্মে কি আছে- সেটা বোঝার আগেই, সাধারণ কিংবা জানলেওয়ালা মহলেও ধর্মের দোহাই দিয়ে নারীদের ছোট করা হচ্ছে। গ্রাম, সমাজ, পাড়া, বস্তি, শহর সবখানে একই চিত্র। একই জিনিস সবখানে বেঁচা হচ্ছে বিনা মূল্যে, ছড়ানো হচ্ছে গর্বের সাথে- নেক আমলের নিয়তে। জান্নাতের লোভ জাগাতেই অনেক সময় বাদবিচারহীনভাবে ধর্মীয় গুজব চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে সমাজের ভেতরে ও দেশের ভেতরে। সম্প্র্রতি আলোচনায় এসেছে, জাতীয় ক্রিকেট দলের বোলার তানজিম হাসান সাকিবের কয়েকটি ফেসবুক পোস্টে। এই ঘটনার কথা উলেস্নখ করার পেছনে একটা কারণ আছে, আর তা হলো- এতে সব থেকে বেশি উঠে এসেছে নারীর সমন্ধে আমাদের সমাজের বিশ্বাস। তানজিম হাসান সাকিব তার একটা পোস্টে লিখেছিলেন- স্ত্রী চাকরি করলে স্বামীর হক আদায় হয় না/ স্ত্রী চাকরি করলে সন্তানের হক আদায় হয় না/স্ত্রী চাকরি করলে তার কমনীয়তা নষ্ট হয়/ স্ত্রী চাকরি করলে পরিবার ধ্বংস হয় / স্ত্রী চাকরি করলে পর্দা নষ্ট হয়/ স্ত্রী চাকরি করলে সমাজ নষ্ট হয়। বলা বাহুল্য যে, তার এই পোস্টের গুনগান এই দেশের লাখো কোটি মানুষের হৃদয় ছুঁয়ে গেছে। আর এই হৃদয় ছুঁয়ে যাওয়ার ব্যাপারটা এতই গভীর যে, এর বিরুদ্ধে কেউ দ্বারালেই সে ইসলাম বিদ্বেষী বা ধর্ম বিদ্বেষী বলে ফতোয়া দেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এমন কাঁদা ছোড়াছুড়ি সবাই দেখেছেন বলে আমার বিশ্বাস। এই যে একটি দেশের কয়েকটি কোটি মানুষ বিশ্বাস করছে, স্ত্রী অর্থাৎ নারী চাকরি করলে পরিবার ধ্বংস হয়, নারী চাকরি করলে সমাজ ধ্বংস হয়, ধর্মীয়ভাবে বিষয়টি আসলে কতটুকু যৌক্তিক? নারীর বাহিরে চাকরি করতে যে কোনো বাধা নিষেধ নেই এটা কি তাদের অজানা! না। অজানা নেই। তবে এ ঘটনাগুলো উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলা যেতে পারে। নারী সমন্ধে সমাজের মানুষের বিশ্বাস এভাবেই উঠে আসে। একজন নারী যদি বাহিরে চাকরি না করে, তাহলে মহিলাদের সেবা কে দেবে? এই উত্তর কী ওই মানুষের কাছে আছে? নাকি একজন নারী সিজার করাবে পুরুষ ডাক্তারের আওতায়? এটা কি আমাদের সামাজিক রীতি মেনে নেবে? অনেক প্রশ্নই থেকে যায়। যেখানে একটি নারী বিদ্বেষী পোস্টের অনুসারী কোটি ছাড়িয়ে যায়, সেখানে নারীর ঘরের নির্যাতন স্পষ্ট অনুমেয়। এই ঘরের নির্যাতন নিয়েও রয়েছে ধর্মীয় বাধা। এ দেশের কোটি কোটি মানুষ এটা বিশ্বাস করে যে, স্ত্রী কে স্বামী চাইলে, যখন তখন নিজের মন খুশি মতো যৌন কাজে ব্যবহার করতে পারে এবং সবাই এটাও বিশ্বাস করে যে, এই ক্ষমতা স্বং আলস্নাহই তাদের দিয়েছেন। এই মন খুশিমতো ব্যবহার করা, কোনো ধরনের নির্যাতন করে ব্যবহার না করা- তা কয়জন জানে বা মানে! জানলেই বা কী হবে? এর প্রচারণা কে করবে, পুরুষ? কখনো করেনি, করবেও না। এতে পুরুষের আধিপত্য কমে যাবে। এটা পুরুষের ভালোভাবে জানা। এটা নিয়ে কথা বললে এ দেশের বেশির ভাগ পুরুষরা মনে করে- যারা কথা বলে তারা ধর্ম বিদ্বেষী। আসলে কী তাই? ধর্ম কি তাহলে নির্যাতন করতে উৎসাহ দেয়! না। পৃথিবীর কোনো ধর্মই মানব কল্যাণের বিপক্ষে কথা বলে না। সব ধর্মেই কল্যাণের বিষয় প্রায় এক রকম বার্তা দেয়। কিন্তু ধর্মীয় ব্যানারে বিষদ্গার প্রচার যে কম হচ্ছে এমনটাও নয়। এই বিষদ্গার ও সমাজের প্রচলিত দৃষ্টিভঙ্গি ধীরে ধীরে নারীর প্রতি সহিংসতা বৃদ্ধি করছে। ধর্ষণ সম্বন্ধে আমরা সবাই জানি। এ দেশের মানুষ ও শাসন ব্যবস্থা ধর্ষণটাকে শুধু ঘৃণা এবং অন্যায়ের চোখেই দেখে না, এখানে ধর্ষণকারীর সর্বোচ্চ শাস্তি মৃতু্যদন্ড বিধান রাখা হয়েছে। তবে বর্তমানে বৈবাহিক ধর্ষণের ব্যাপারে খুব বেশি আলোচনা হচ্ছে। অনেকেই এটাকে ধর্ষণ বলতে নারাজ। কারণ ধর্ষণকারী হিসেবে আমরা সাধারণত দাম্পত্য সম্পর্কের বাইরের কাউকেই বিবেচনায় আনি। এখানে বৈবাহিক ধর্ষণ বিষয়টি অনেকেরই অজানা। এমনকি নারীদেরও বৈবাহিক ধর্ষণের বিষয়টি নিয়ে অজ্ঞতা আছে। এ দেশের অধিকাংশ পুরুষ বৈবাহিক ধর্ষণের বিষয়টিকে কোনো অপরাধ বলেই মনে করেন না। সাধারণত 'বৈবাহিক ধর্ষণ' বলতে স্বামী কর্তৃক স্ত্রীর ওপর এমন আচরণকে বোঝায়, যেখানে স্ত্রীর সম্মতি ছাড়া এবং অনিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও স্বামী জোরপূর্বক স্ত্রীর সঙ্গে শারীরিক সম্পর্কে লিপ্ত হন। প্রকৃত পক্ষে বাংলাদেশসহ বিশ্বের অধিকাংশ দেশে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার পর জোরপূর্বক যৌন সম্পর্ক স্থাপনের বিষয়টি ধর্ষণ হিসেবে স্বীকৃত নয়। যার ফলশ্রম্নতিতে পুরুষের দ্বারা নারীরা প্রতিনিয়ত এমন বৈবাহিক ধর্ষণের শিকার হচ্ছেন। ২০২০ সালে মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন দ্বারা প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শুধু এপ্রিল মাসে ৪ হাজার ২৪৯ জন নারী পারিবারিক সহিংসতার শিকার হয়েছে। ওই জরিপের আরো তথ্য অনুযায়ী, শুধু স্বামীর হাতে শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ৮৪৮ নারী, মানসিক নির্যাতনের শিকার ২ হাজার, যৌন নির্যাতনের শিকার ৮৫ জন। বাংলাদেশে ধর্ষণসংক্রান্ত কঠোর আইন থাকলেও বৈবাহিক ধর্ষণের কথা বলা হয়নি এবং সুনির্দিষ্ট কোনো আইনও নেই। প্রায় সব আইনেই ধর্ষণকে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে, স্ত্রী ব্যতীত অন্য কোনো নারীর স্মৃতির বিরুদ্ধে যেয়ে তার সঙ্গে যৌন সম্পর্ক স্থাপন করা। এখন প্রশ্ন হলো, স্ত্রীর সম্মতি ছাড়া স্বামী যখন ধর্ষণকারীর ভূমিকায় হাজির হন, তখন কি ধর্ষণের ভয়াবহতা কমে যায়? সেটা কি যৌন নির্যাতন না? ১৮৬০ সালের দন্ডবিধির ৩৭৫ ধারা অনুযায়ী, ১৩ বছরের ঊর্ধ্বে নারীর ক্ষেত্রে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে সহবাস বা ধর্ষণ হিসেবে স্বীকৃতি পায় না। এই আইনটিও এখন খুব সাংঘর্ষিক অন্যান্য আইনগুলোর সঙ্গে। যেখানে আমাদের মেয়েদের বিয়ের সাধারণ বয়স ১৮ বছর। যুগ অনুযায়ী এই আইনটিও যুগোপযোগী করা প্রয়োজন। প্রশ্ন হলো, বিয়ে ব্যতিরেকে কোনো নারীর সঙ্গে জোরপূর্বক যৌন সম্পর্ক স্থাপনের বিষয়টি যদি ধর্ষণ হিসেবে স্বীকৃত হয়, তবে বৈবাহিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে সেই জবরদস্তি কেন ধর্ষণ হিসেবে গণ্য হবে না? বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়ে স্বামী-স্ত্রী হলেই কি ঘটনাটির ভয়াবহতা কমে যায়! ব্যাপারটি কিন্তু মোটেও সে রকম না বরং দিনের পর দিন একটি সম্পর্কে জড়িয়ে ধর্ষণের অভিজ্ঞতায় ট্রমা অনেক বেশি থাকে এবং কঠিন বিষয় হলো, তখন এখান থেকে পরিত্রাণের আর কোনো উপায়ও থাকে না। এই যে কিছু নারী প্রতিনিয়ত এই সমাজে দিনের আলোয় আলোকিত হয়ে রাতের অন্ধকারে বদ্ধ পরিকর হয়ে জোরপূর্বক ধর্ষণের স্বীকার হচ্ছে, এর দায়ভার কে নেবে? নারী কি তার বিয়ের পর এমন ধর্ষণ হাসি মুখে মেনে নেবে? কেন নেবে? কোনো উত্তর আমাদের কাছে আছে?

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে